পূর্ণিমার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যোগ অন্যান্য বৌয়েদের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি দ্বিপেন্দ্রনাথের দৌহিত্রী আবার সুরেন্দ্রনাথের পুত্রবধূ। মনে হতে পারে, কেমন করে সম্ভব হল। সাধারণত এত নিকট সম্বন্ধের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ নিষিদ্ধ না হলেও প্রায়ই হয় না; কিন্তু ঠাকুরবাড়ি নিজেদের মধ্যেই একটা সমাজ গড়ে নিয়েছিল। না হলে পিরালী ও ব্রাহ্ম এই দুই বাধা অতিক্রম করতে অনেক সমষেই খুব কষ্ট হয়েছে। দ্বিপেরে মেয়ে নলিনীর বিয়ে হয়েছিল বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারে। অর্থাৎ নলিনী তার দুই পিসী প্রতিভা ও ইন্দিরার ছোট জা হয়েছিলেন। তার তিন মেয়ে সুরমা, অপর্ণা ও পূর্ণিমা। অপর্ণার কথা আগেই বলেছি। তার বিয়ে হয়েছিল গগন ঠাকুরের ছেলের সঙ্গে। পূর্ণিমার বিয়ে হয়েছিল সুবীরেন্দ্রের সঙ্গে। ডায়াসেশন থেকে বি এ পাশ করে পূর্ণিমাও যোগ। দিয়েছেন পারিবারিক গান ও অভিনয়ের আসরে। তবে খুব বেশি নয়। তার মেয়ে সুপূর্ণ। রবীন্দ্রসঙ্গীতের আসরে সুপরিচিতা, নাতনী শ্রীনন্দার নামও ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ণিমা ছোটখাট আসরেই যোগ দিতেন বেশি। লক্ষ্মীর পরীক্ষায় লক্ষ্মী, বাল্মীকি-প্রতিভায় বালিকা, মায়ার খেলায় অমর, চিরকুমার সভায় পুরবালা এই সব চরিত্রে অভিনয় করতেন। পূর্ণিমা গ্র্যাজুয়েট হবার পর রবীন্দ্রনাথ বললেন নলিনীকে, তোর মেয়েকে নিয়ে যাব। আমার স্কুলে ইংরেজী পড়াবে। স্কুলে পড়ানো ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েদের রক্তে আছে। তাই খুব সহজেই পূর্ণিমা শান্তিনিকেতনে এসে একটানা দেড় বছর ইংরেজী পড়ালেন। এসময় তার সঙ্গে আলাপ হল লীলা মজুমদারের। আজও তাঁদের মধ্যে নিবিড় সখ্য অটুট রয়েছে।
সুবীরেন্দ্রের সঙ্গে বিয়ে হয় গৌড় বিল অনুসারে, রেজিষ্ট্রি করে। সেজন্য পুরোহিত পাওয়া গেল না। পৌরোহিত্য করেন ঠাকুরবাড়িরই দুজন মহিলা সরলা ও হেমলতা। ঘটনাটি ইন্দিরা তার অপ্রকাশিত আত্মজীবনী শ্রুতি ও স্মৃতিতে উল্লেখ করেন। এর পরেও পূর্ণিমা শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। ঘরের কাজ ছাড়াও ছিল আলপিনী সমিতি ও নারী-কল্যাণ সমিতি। সব কাজেই তিনি সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেতেন তার। নমা অর্থাৎ ইন্দিরার কাছ থেকে। জন্ম থেকেই দেখছেন সেই মহিয়সী নারীকে। তাই ইন্দিরার মৃত্যুর পরে পূর্ণিমা নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন একটা গুরুতর কাজ। কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে তিনি শুরু করলেন ইন্দিরার প্রামাণ্য জীবনচরিত লিখতে। ইন্দিরা-সংক্রান্ত সমস্ত উপাদান ও স্মৃতিকথা জড় করা হল। সত্যি কথা বলতে কি, যে কাজে অনেকদিন আগেই হাত দেওয়া উচিত ছিল অথচ আজও মনোযোগ দেওয়া হয়নি ঠিক সেই কাজটাই ধরেছেন পূর্ণিমা। বান্ধবী লীলা মজুমদার উৎসাহ ও প্রেরণা জোগালেন। আপাতত লেখা শেষ, শুধু প্রেসে দেওয়া বাকি। তার লেখাটি মন দিয়ে পড়লে লক্ষ্য করা যাবে, অতি প্রিয়জনের জীবনী লিখতে বসেও পূর্ণিমা নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন অনেক দূরে। তিনি ইন্দিরার খুব কাছের মানুষ, স্বাভাবিক কারণেই বইয়ের মধ্যে একটি চরিত্র হয়ে উঠেছেন। কিন্তু কোথাও বিনা কারণে তাকে পাওয়া যাবে না। এই সংযম আছে তার লেখার মধ্যেও। ইন্দিরার জীবনী লিখছেন তিনি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ও চৌধুরীবাড়ির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে তিনি ইন্দিরার জীবনকথা আলোচনা করেছেন এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে যারা ইন্দিরাকে দেখেছেন তাঁদের রচনাংশও উদ্ধৃত করা হয়েছে। এর ফলে ইন্দিরার জীবনী যতটা প্রামাণ্য গবেষণাধর্মী হয়ে উঠেছে ততখানি সরস হয়ত হয়নি কিন্তু ঘরোয়া ইন্দিরাকে যেন এখানেই সবচেয়ে বেশি আপন করে পাওয়া গেল। পূর্ণিমার লেখার ভাষাটিও সাবলীল। অনাবশ্যক গল্প করে বইকে লঘু ও সরস করে তোলার প্রলোভন যেমন জয় করেছেন তেমনি মানবী ইন্দিরাকে জীবন্ত করে তুলেছেন। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বিশ্বভারতীর উপাচার্য। হিসেবে ইনিরাকে অনেক কাজ করতে হত। একবার এক অধ্যাপক, বিশ্বভারতীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। পুলিশ-এনকোয়ারী ইত্যাদি হলে তিনি খুব সরস করে অন্তরঙ্গদের বলতেন, দেখ, জীবনে নানারকম অভিজ্ঞতা হয়েছে দীর্ঘায়ু হবার দরুন—কিন্তু এ এক অভিনব পরিস্থিতি। শেষ বয়সে জেলে গিয়ে না লপসী খেতে হয়। পূর্ণিমার বই প্রকাশিত হলে ইন্দিরার সম্বন্ধে অনেক নতুন কথা জানা যাবে। পূর্ণিমার প্রসঙ্গে আরো তিনজনের কথা এখানে বলে নিতে পারি। সুরেন্দ্রের অপর তিন পুত্র প্রবীরেন্দ্র, মিহিরেন্দ্র ও সুণতেন্দ্র। প্রবীরেন্দ্রের স্ত্রী অণিমা, মিহিরেন্দ্রের স্ত্রী লীলা ও সুণতেন্দ্রের স্ত্রী সতীরাণী। এঁদের মধ্যে সতীরাণী সুগায়িকা হিসেবে যথেষ্ট পরিচিত।
হেমেন্দ্ৰপরিবারে এসেছেন ভিন্ন পরিবারের আরো পাঁচটি মেয়ে। অমিয়া, মেনকা, আরতি, পারুল ও স্মৃতি। শেষের তিনজনের কথাই আগে বলি। কারণ এঁরা ঠাকুরবাড়ির বৌ হলেও আমাদের নির্দিষ্ট কালসীমার একেবারে শেষ পর্বে তারা এসেছেন। শুভো ঠাকুরের স্ত্রী আরতি মুলেখিকা। লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়ার কয়েকটি বইয়ের অনুবাদ ছাড়াও আরতি লিখেছেন দু-তিনটি উপন্যাস অসমিয়া ও বাংলা উভয় ভাষায়। ছায়ারঙ্গ স্বচ্ছন্দ গতিতে লেখা অধুনিক উপন্যাস। তার অনূদিত বেজবড়ুয়ার আমার জীবন স্মৃতি ও লক্ষ্মীনন্দন বরার গাঙচিলের ডানা অত্যন্ত সুখপাঠ্য সরল অনুবাদ। সিদ্ধীন্দ্রনাথের স্ত্রী পারুল প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। তার মা প্রেমিকা দেবীও পাথুরেঘাটার ঠাকুরবাড়ির মেয়ে। পারুল নিজেও প্রথম যুগের কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করেন। তাঁকে আমরা কেশবচন্দ্র সেনের নাতনী সাধনা বস্তুর সমসাময়িক বলতে পারি। বাসবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী স্মৃতি জানেন ভাল ছবি আঁকতে। এঁরা তিনজনেই ঋতেন্দ্রনাথের তিন পুত্রবধূ। এরপর আমরা গান-পাগল ঠাকুরবাড়ির দুটি সুযোগ্যা বন্ধুর কথায় আসি। অমিয়া ও মেনকা দুজনেই সুগায়িকা, অসাধারণ সুকণ্ঠের অধিকারিণী।