সৌদামিনী-সুকুমারীর বোন স্বর্ণকুমারী বাংলাসাহিত্যে প্রথম সার্থক লেখিকা। অবশ্য স্বর্ণকুমারীর আরো একজন দিদি ছিলেন শরৎকুমারী নামে। তিনি রান্নাঘর এবং রূপচর্চাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। স্বর্ণকুমারীর ছোট বোন শম রীও দু-একটি ক্ষেত্রে অভিনয় করা ছাড়া বিশেষ কিছুই করেননি। কিন্তু স্বর্ণকুমারী যেন সব দিক থেকে এক বিরল ব্যতিক্রম। তার সোনলি ছটায় Fরবাড়ির অন্দরমহল আলোকিত। স্বর্ণকুমারীর সাফল্য ও কৃতিত্বের সঙ্গে ওতপ্রাতভাবে জড়িয়ে আছেন আরো একজন মহিলা, তিনি ঠাকুরবাড়ির মেজো বৌ জ্ঞানদানন্দিনী। যদিও তিনি এ বাড়ির মেয়ে নন, বিবাহসূত্রে এসে পড়েছেন ঠাকুরবাড়ির অঙ্গনে। কিন্তু ঠাকুরবাড়ির কৃতিত্ব ও ঐতিহ্য থেকে তাঁকে আলাদা করে দেখবে কে? এখানকার শিক্ষাদীক্ষা চিন্তাভাবনা সব কিছুর সঙ্গেই যে তিনি জড়িয়ে-মিশিয়ে আছেন। সত্যি কথা বলতে কি, জ্ঞানদা নন্দিনীই তো সবার আগে সবরকম বাধা-নিষেধের বেড়া টপকে বৃহত্তর জগতে এসে মেয়েদের মুক্তির পথ খুলে দিয়েছেন। তারপর পর্দা আর আবরু ঘোচাতে মেয়েদের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। তাই স্বর্ণকুমারীর সঙ্গে, বা বলা যায় তার আগেই জ্ঞানদানন্দিনীর প্রসঙ্গ সেরে নেওয়া যেতে পারে। তবে এঁদের কাউকেই আলাদা করে দেখা যায় না কারণ এরা এসেছেন একই সময়ে, একই সঙ্গে এবং একই পরিবারের সদস্য হয়ে।
জ্ঞানদানন্দিনী মহর্ষি পরিবারের মেজো বৌ। স্বাভাবিকভাবেই বড় বৌয়ের কথা মনে পড়বে। দার্শনিক দ্বিজেন্দ্রনাথের স্ত্রী সর্বসুন্দরীর ভূমিকা ঠাকুরবাড়িতে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি। এক-একজনের লেখায় তিনি হঠাৎ-হঠাৎ উঁকি মেরে গেছেন চওড়া লাল-পেড়ে শাড়ির পাড় থেকে। ঘোমটার সীমানা বুঝি চিবুক ছাড়িয়ে উঠত না তাই তার ছোটখাট দেহটি একেবারে মিশে গেছে অন্দরমহলের থামের আড়ালে। তার স্বল্পায়ু জীবনের অধিকাংশই তো কেটেছে। পরের সেবায়। শাশুড়ী-ননদ-জা আত্মীয়স্বজন সবাইকে আপন করে নিতে নিতে এবং ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করতে করতে তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন বিরাট পরিবারের অসংখ্য মানুষের মধ্যে। সেকালে তো মেয়েদের জীবন এমনি করেই কাটত। কিন্তু জ্ঞানদানন্দিনী হারিয়ে ফুরিয়ে যাবার মতো মেয়ে ছিলেন না। তীক্ষ্ণ জেদী একরোখা মেজাজ ও অদম্য প্রাণ প্রাচুর্য নিয়ে তিনি মেয়েদের অগ্রগতির অনেকটা পথই খুলে দিয়েছিলেন। সব কাজে সহায় ছিলেন তাঁর স্বামী, প্রথম ভারতীয় আই. সি. এস. অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জ্ঞানদানন্দিনীর বাবা গৌরীদান করেছিলেন সাত বছরের মেয়েকে। তখন তার অক্ষর-পরিচয় সবে শুরু হয়েছে গ্রামের পাঠশালাতে। তারপর সবার যা হয় তাই হল। পুতুলখেলার ঘর সাজাতে সাজাতে নিজেই একদিন মোমের পুতুলটি সেজে ঢুকে পড়লেন রাজবাড়ির মতো সদর-অন্দর-দেউড়ি-দালানওলা বিরাট বিশাল ঠাকুরবাড়িতে। পায়ে গুজরি-পঞ্চম, মাথায় এক গলা ঘোমটা। সেই ঘোমটাখানি হয়ত দুহাতে সন্তর্পণে তুলে ধরে ভীত-চকিত হরিণীর দুটি কাজলটানা ব্যাকুল চোখ বারবার পথ খুঁজেছিল পিছন ফিরে চাওয়ার। বলাবাহুল্য পায়নি। ঠাকুরবাড়ির কোন্ বৌ তার পূর্ব জীবনের সংস্কার মনে রাখতে পেরেছে? কিন্তু এগিয়ে যাবার জন্যে নতুন পথ খুঁজে পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী। সে একটা ইতিহাস!
শুধু প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান অফিসার নয়, বাংলার স্ত্রী-স্বাধীনতার পথিকৃৎ সত্যেন্দ্রনাথ তার লজ্জাবতী বালিকাবধূটিকে সব বিষয়ে ভারতীয় নারীর আদর্শ করে তুলতে চেয়েছিলেন। বিলেতে গিয়ে তিনি দেখলেন স্বাধীনচেতা বিদেশিনীদের। ঘরে-বাইরে তাদের অবাধ বিহার—স্বচ্ছন্দ, সুন্দর, সাবলীল। কই কোথাও তো ছন্দপতন ঘটছে না। সব গেল সব গেল রব তুলে রসাতলে যাচ্ছে না বিলিতি সমাজ। তাহলে? যে মেয়েরা জীবন-উদ্যানের পুষ্প তাদের আলো-বাতাস থেকে বঞ্চিত করে ঘরের মধ্যে শুকিয়ে মারলে কি মঙ্গলের সম্ভাবনা?
সত্যেন্দ্র স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন। তিনি অন্তঃপুরের ঝরকা ভেঙে ফেলছেন, তার স্ত্রী এসেছেন কালাপানি পাড়ি দিয়ে বিলেতে। মন জাগবার আগেই মনের মানুষ বলে তার পরম আদরের জ্ঞেনুমণি যাকে বরণ করে নিয়েছেন, জগৎসভায় স্বয়ম্বরা হয়ে সকলের মধ্যে বেছে নিয়ে তাকেই আবার পরিয়ে দিচ্ছেন প্রেম-পারিজাতের বরণমালা। শুরু হল স্ত্রীকে গড়ে তোলার সাধনা। লেখা চলল চিঠির পর চিঠি।
তোমার মনে কি লাগে না আমাদের স্ত্রীলোকেরা এত অল্প বয়সে বিবাহ করে যখন বিবাহ কি তাহারা জানে না, ও আপনার মনে স্বাধীনভাবে বিবাহ করিতে পারে না। তোমার বিবাহ তো তোমার হয় নাই, তাহাকে কন্যাদান বলে। তোমার পিতা কেবল তোমাকে দান করিয়াছেন। সাগর পার থেকে আসা চিঠি জ্ঞানদানন্দিনীর কানে কানে শোনায় নতুন খবর :
আমরা স্বাধীনতাপূর্বক বিবাহ করিতে পারি নাই। আমাদের পিতামাতারা বিবাহ দিয়াছিলেন। জ্ঞানদানন্দিনীর বুক কাঁপে, কি বলতে চায় চিঠি, তুমি যে পর্যন্ত বয়স্ক, শিক্ষিত ও সকল বিষয়ে উন্নত না হইবে, সে পর্যন্ত আমরা স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধে প্রবেশ করিব না। এসব চিঠির উত্তরে জ্ঞানদানন্দিনী কি লিখতেন কে জানে? তার লেখা একটি চিঠিও পাওয়া যায়নি। সত্যেন্দ্রর চিঠিতে অন্তরঙ্গ সম্বোধন থাকলেও তার ভাষা কেতাবী ধরনের সাধুভাষা, হয়ত সে সময় দাম্পত্য পত্রালাপের ভাষাও সাধুভাষাই ছিল। হেমেন্দ্রনাথকেও সাধুভাষা ব্যবহার করতে দেখা গেছে, তবে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখতেন মুখের ভাষায়। এক একটি চিঠিতে ঝরে পড়ত সত্যেরে মনের কথা :