শ্ৰীমতী ঠাকুরবাড়ির বৌ হয়েছিলেন ১৯৩৭ সালে। এই প্রথম ঠাকুরবাড়ির ছেলের সঙ্গে গুর্জর তনয়ার বিয়ে। রাজনৈতিক জীবনে সৌম্যেন্দ্র ছিলেন চরমপন্থী। কিন্তু শ্ৰীমতী যোগ দিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে, গিয়েছিলেন জেলে। তারপরের জীবনে শ্ৰীমতী সরে এসেছেন রাজনীতির জগৎ থেকে। সংগঠনের কাজে তার কৃতিত্ব কম ছিল না। চল্লিশের দশকে রচনা নামে নারী প্রতিষ্ঠান তারপর অভিযান, বৈতনিক, সবশেষে সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আট তার গঠনমূলক কাজের পরিচয় বহন করে। শিল্প জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ থাকলেও তার কোন সার্থক উত্তরাধিকারী নেই। বাংলা দেশে নৃত্য নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। এসেছেন উদয়শংকর ও অমলাশংকর। শান্তিনিকেতনেও হয়েছে রবীন্দ্র-নৃত্যধারার সযত্ন অনুশীলন তবু শ্ৰীমতীর প্রতিভা সার্থক হল না অন্যের মধ্যে। এখনও কবিতার সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন, ঝুলন, ঝড়ের খেয়া বা শিশুতীর্থের সঙ্গে ভাবনৃত্য পরিকল্পনা অসম্ভব রকমের আধুনিক।
অমিতার সঙ্গেও রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ বহুদিনের। তিনি একাধারে কবির নাতনী, নাতবৌ এবং মহিষী। অমিতা লাবণ্যলেখার মেয়ে। যাকে কবি নিজের মেয়েদের সঙ্গে পরম স্নেহে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। অকালবৈধব্যের অভিশাপ থেকে বাঁচাবার জন্যে পুনর্বিবাহ দিয়েছিলেন স্নেহাস্পদ অজিত চক্রবর্তীর সঙ্গে। অমিতা তারই মেয়ে, পরে তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের এক পৌত্র অজীনেন্দ্রনাথের। অভিনয় এবং গান শান্তিনিকেতনের অনুকূল পরিবেশে খুব সহজেই শিখতে পেরেছিলেন অমিতা। তবু শংকা ঘুচত না। একরকম জোর জার করেই রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথ তাকে স্টেজে নামাতেন। নন্দিতাকে লেখা কবির চিঠি পড়লে দেখা যায় তিনিও লিখছেন, বহু কষ্টে অমিতাকে সুদর্শনার পালায় নামাতে পেরেছি। শেষ পর্যন্ত টিকলে হয়।
অভিনয় অবশ্য ভালই করতেন অমিতা। নটীর পূজায় অমিত সাজতেন মালতী। আকন্দ ফুলের মালা জড়ানো বেণী চূড়ো করে বেঁধে, গলায় কুঁচ ফলের মালা, একটু উঁচু করে পরা শাড়ির আঁচলটি কোমরে জড়িয়ে আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে আকুল স্বরে তিনি যখন বার ডাকে আমার ভাই গেল চলে। যার ডাকে আমার— বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়তেন তখন সমস্ত দর্শক যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত। অভিনয় শেখাতেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং।
তপতীর অভিনয় হয়েছিল আরো পরে। অমিত তখন জোড়াসাঁকোয় বৌ হয়ে এসেছেন। হঠাৎ ডাক এল। তপতীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য প্রথমে ইতস্ততঃ করেছিলেন। ও কি পারবে? এ. বেশ শক্ত মেয়ের কাজ। তবু দিনেন্দ্রনাথের প্রস্তাবে দ্বিধান্বিত মন নিয়ে ডেকে পাঠালেন অমিতাকে। অভিনয় দেখে অবশ্য খুব পছন্দ হয়ে গেল। এক নাগাড়ে মাস খানেক রিহার্সাল চলল। তারপর অভিনয়। রাজা বিক্রম রবীন্দ্রনাথ আর অমিতা তার মহিষী। সে অনবদ্য অভিনয় যারা দেখেছেন তারা ভোলেননি। একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী অবন ঠাকুর। তিনি নটীর পূজায় নন্দলাল বসুর মেয়ে গৌরীর অভিনয় দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলেন তেমন অভিভূত হয়েছিলেন তপতী দেখে। অমিতা তপতী সেজে অগ্নিতে প্রবেশ করেছে। সেও এক অদ্ভুত রূপ। প্রাণের ভিতরে গিয়ে নাড়া দেয়। সেই সঙ্গে স্বীকার করেছেন পরে যত অভিনয়ই হয়ে থাক অমন আর দেখলুম না।
এর একটা উল্টোদিকও ছিল অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে নতুন কিছু করতে বারবার বিরুদ্ধ সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। রাজা ও রাণীর প্রথম অভিনয়ের সময় হয়েছিল, এবারও হল। এই যুগেও একজন সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করে লিখলেন, কবি রবীন্দ্রনাথ নিজে রাজার ভূমিকা গ্রহণ করিয়া ভ্রাতুস্পুত্রবধূকে রানী সাজাইয়া অভিনয় করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথ যে দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন, অন্য সকলে তাহাই অনুসরণ করিতেছে মাত্র। কিংবা চুল দাড়িতে কলপ মাখিয়া কচি সাজিয়া তিনি কখনো কখনো কিশোরী কুমারীদের সঙ্গে নাট্যাভিনয় করেন। সুতরাং যুগ বদলালেও জ্ঞানদানন্দিনীকে যে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল অমিতাকেও সেই পরিস্থিতিতে পড়তে হল। তবে। ঠাকুরবাড়ির কেউই এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাননি, অমিতাও না।
তপতী সাজবার পরে কবি অমিতাকে ডাকতেন মহিষী বলে। পাঠাতেন পত্রলিপি :
মহিষী
তোমার দুটি হাতের সেবা
জানি না মোরে পাঠালো কেবা
যখন হোলো বেলার অবসান–
দিবস যখন আলোক হারা
তখন এসে সন্ধ্যা তারা
দিয়েছে তারে পরশ সম্মান।
৩ বৈশাখ ১৩৪৬ বিক্রম।
অমির হাতের সেবা ছাড়াও আরো একটা দুর্লভ গুণ ছিল। তিনি লিখতে পারতেন। কিন্তু বড় সংকোচ। মা বকেন। কতজন এসে কবিকে লেখা দেখায়, ভুল শুধরে নিয়ে যায় আর অমিত পারবেন না? শেষে বাধ্য হয়েই ভীরু পায়ে গেলেন গুরুদেবের কাছে। কবি বললেন, তুই লিখিস, না? পড়ে খুশি হয়ে বললেন, এত সহজ তোর ভাষা যে আমি আর এতে হাত দিতে চাই নে।
উৎসাহ পেয়ে অমিতার খাতা ভরে ওঠে। ছাপা হয় অঞ্জলি আর জন্মদিন। আশ্চর্য সহজ সরল প্রাণের কবিতা :
যবে শুধায় সকলে মোরে, তুমি কি পেয়েছ
কই দেখালে না আজি?
মৌন নতমুখে থাকি, কি দিব উত্তর–
কি পেয়েছি আমি?…
অন্তহীন পাওয়া সে যে ঋতুতে ঋতুতে।
বর্ণে গানে বিচিত্রিতা মাঝে,
শূন্য পাত্র পূর্ণ করি রাখে যে সদাই
তাই মোর দুঃখ কিছুই নাই।
কবিতার মতো অমিতার গদ্য লেখার হাতও ভাল। মনেই হয় না যে প্রবন্ধ পড়ছি। প্রবন্ধ পড়তে পড়তে স্মৃতিকথা, ছবি আঁকা, গল্প বলা—একটার পর একটায় আপনি মন চলে যায়, পড়া শেষ হলে পর মনের কোণে মিশে থাকে মাধুরীর বেশ। দেখা যায়, অমিতা খুব সংক্ষেপে একটা চরিত্রকে চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। অথচ জীবনী-স্মৃতিকথা-প্রবন্ধ কোনটাই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। একবারও স্মৃতি এসে হাত চেপে ধরেনি প্রবন্ধের, তত্ত্ব এসে ঘুরিয়ে দেয়নি মাথা। অমিতার প্রবন্ধ থেকে রবীন্দ্রনাথের অভিনয় এবং অভিনয় সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, কবি কণ্ঠস্বরের ওপর জোর দিতেন। নজর রাখতেন। শেষের কথাগুলি অস্পষ্ট বা অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে না যায়। কবি প্রায়ই সংলাপ ভুলে যেতেন বলে সহ-অভিনেতাদের সব সময় কবির ডায়লগ মনে রাখতে হত, নয়ত তিনি নতুন কথা বানাতে শুরু করে দিতেন, আর তাল রাখতে হিমসিম খেতে হত অন্যদের। অমিতা এখনও বড় করে বিশেষ কিছু লেখেননি। ছোট ছোট প্রবন্ধেই অনেক কথা বলতে চেয়েছেন। রেকর্ডেও গেয়েছেন একটিমাত্র গান, সেও পঞ্চকন্যা নামক এল পি রেকর্ডে। গানটি হল তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে। অমিতার মেয়ে স্মিতাও অভিনয়ে পারদর্শিনী, অনেক অভিনয় করেছেন, এখনও করছেন। অমিয়ার স্মৃতিকথা কী ধ্বনি বাজে পড়ে জানা যা ছোট বেলা থেকেই স্মিতা গানের দলে যোগ দিয়েছিলেন।