ঠাকুরবাড়ির বৌ হবার অনেক আগেই শ্ৰীমতী রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসেছিলেন। আমেদাবাদের অভিজাত হাতিসিং পরিবারের মেয়ে শ্ৰীমতী মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে সেখানকার কলেজে পড়া ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন শান্তিনিকেতনে। সেটা বোধহয় ১৯২১ সাল। উদ্দেশ্য ছিল ছবি আঁকা শেখা। শুরুও করেছিলেন কিন্তু তার প্রতিভা বিকাশের মাধ্যম হল চিত্র নয়, অন্য একটি শিল্প। শান্তিনিকেতনে তখন প্রতিমার তত্ত্বাবধানে ভাবনৃত্য শেখার ব্যবস্থা হচ্ছে, মণিপুর থেকে এসেছেন নৃত্যশিক্ষক নবকুমার তাদের দলেই ভিড়লেন শ্ৰীমতী। নৃত্যছন্দে নূপুরের ঝংকারে দেহভঙ্গিতে ফুটে উঠল নতুন রূপ। তবে নন্দিতা-যমুনা-নিবেদিতার মতো শ্ৰীমতীকে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী বোধহয় বলা চলে না কারণ তার নৃত্য ছিল তার একান্ত নিজস্ব আবিষ্কার। তবু তাঁর শিক্ষা শুরু হয়েছিল শান্তিনিকেতনেই তাতে সন্দেহ নেই। প্রচলিত ধরাবাঁধা কোনো নাচের মধ্যেই শ্ৰীমতীর নৃত্যভাবনা সার্থক রূপ নিতে পারেনি। তাই তিনি নৃত্যকে নতুন রসে পুষ্ট করে সৃষ্টি করলেন নব্য আঙ্গিকের। সেই প্রথম পর্বে এটা কি করে সম্ভব হল কে জানে, তবে শ্ৰীমতীর নাচ আজও একটা ব্যতিক্রম বলেই মনে হবে।
শান্তিনিকেতনের শিক্ষা শেষ করে শ্রীমতী জার্মানীতে গিয়েছিলেন শিশুশিক্ষা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে। কিন্তু ওখানে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত পক্ষে যা শিখলেন তা হল নাচ। য়ুরোপে তিনি নানা জায়গায় ঘুরেছেন, নাচ দেখেছেন, দেখিয়েছেনও। বিদেশে তিনি দেখাতেন ভারতীয় নৃত্য—যার সবটাই তার নিজস্ব, মণিপুরী আঙ্গিকের ওপর গড়ে তোলা অভিনব নৃত্যভঙ্গিমা। শোনা যায়, এসময় তিনি য়ুরোপের মডার্ণ ডাসের আঙ্গিক আয় করেন মেরি উইম্যান প্রবর্তিত আধুনিক নাচের স্কুলে, জার্মানীতে। নাচের স্কুলে ধরাবাঁধা শিক্ষা তিনি খুব বেশি নেননি, তবে নাচ দেখেছেন প্রচুর। ভারতে ফিরে শ্ৰীমতী যখন তাঁর নতুন আঙ্গিকের ভাবনৃত্য রবীন্দ্রনাথকে দেখালেন তখন কবিও খুব আনন্দিত হলেন।
ভারতবর্ষে শ্ৰীমতী নৃত্য পরিবেশন করেন রবীন্দ্র-কবিতা আবৃত্তির সঙ্গে। সে এক নতুন জিনিষ। গানের সঙ্গেও নেচেছেন শ্ৰীমতী কিন্তু তেমন আনন্দ পাননি। ছন্দ-সুরের দোলায় মন যে আপনি নেচে ওঠে। শ্ৰীমতীর নৃত্যে যে অমিত বিত্ত রয়েছে তার চরম ঘূর্তি ঘটবে কিসে? প্রথমে ঝুলন কবিতা আবৃত্তির সঙ্গে নিজস্ব আঙ্গিকে নেচে শ্ৰীমতী সবাইকে মুগ্ধ করলেন। দেখা গেল, যে কবিতায় সুরের দোলা নেই, সেই কবিতাকে অবলম্বন করেই শ্ৰীমতীর ভাবনা রূপের মধ্যে আকার নিয়েছে। স্কুলনের পর শিশুতীর্থ আরো কঠিন। আরো দুরূহ! তা হোক। সহজের সাধনায় মন ভরে কই? শিশুতীর্থ কবিতা নাচের পক্ষে বড়ো শক্ত। কল্পনাটাই কষ্টকর। শ্ৰীমতী তাকেই বেছে নিলে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথও। য়ুনিভারসিটি ইন্সটিটিউট হলে সব ব্যবস্থা। রবীন্দ্রনাথের আবৃত্তির সঙ্গে শ্ৰীমতী দেখালেন তার নিজস্ব আঙ্গিকে ঝুলন ও শিশুতীর্থের ভাবনৃত্য। এখনকার দিনেও এ পরিকল্পনা অসম্ভব রকমের আধুনিক কবিতার সঙ্গে ভাবনৃত্য পরিবেশনে শ্ৰীমতীর সঙ্গে আরো একজনের নাম অবশ্য আমরা করতে পারি। তিনি কবি অমিয় চক্রবর্তীর বিদেশিনী স্ত্রী হৈমন্তী। তিনি নেচেছিলেন কল্পনার দুঃসময় কবিতার সঙ্গে। কিন্তু এঁদের উত্তরসূরি হিসেবে আর কাউকে এখনও পাওয়া যায়নি। শ্ৰীমতীর নিপুণ নৃত্যভঙ্গি মুগ্ধ করেছিল কবিকে। মুগ্ধ হয়ে তিনি লিখলেন :
She takes delight in evolving new dance forms of her own in rythmic representation of ideas that offer scope to her spirit for revelling in its own everchangiug creations which according to me is the proper function of dance and a sure sigo of her geuius. It has often caused me great surprise to see how with perfect trutlı aid forcefuluess she has harmouised her movemeuts with my owu recitation of my poems–a most difficult task requiring not ouly a perfect Auency of techuique but sympathy which is creative in its adaptability. Her dance is never languid and suggestive of allurements that cheapen the art. She is alert and vigorous and the cadence of her limbs carries the expression of au inner meaning and never are ou exhibition of skill bound by some external canous of traditiou.
পরবর্তী জীবনে শ্ৰীমতী আরো রবীন্দ্র-কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন কম তবে নাচ দেখিয়েছেন অনেক জায়গায়, সুদূর মাদ্রাজে, সিংহলে। সর্বত্র পেয়েছিলেন অভাবিত সমাদর। নাচ দেখেওছেন—রুক্মিণী দেবীর নাচ শ্ৰীমতীর খুব ভাল লেগেছিল। তার নিজের বিশ্বচ্ছন্দ, লীলাবৈচিত্র কিংবা দি রোড টু ফ্রিডম্ ব্যালেও বেশ নতুন ধরনের। অভিসার কবিতা অবলম্বনে বাসবদত্তা নৃত্যানুষ্ঠানে নাম ভূমিকায় শ্রীমতীর অনবদ্য নৃত্য যারা দেখেছিলেন তারা ভুলতে পারেননি। তাঁর সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য নাচের অনুষ্ঠান হয় নিউ এম্পায়ারে ১৯৫০ সালে। সেখানে তিনি সৌম্যেন্দ্রনাথের আবৃত্তির সঙ্গে স্বপরিকল্পিত নাচ দেখিয়েছিলেন। এ কবিতাটি একটি অসাধারণ নির্বাচন কারণ ঝড়ের খেয়া কবিতার দূর হতে কী শুনিস মৃত্যুর গর্জন-কে নৃত্যভঙ্গিমায় ফুটিয়ে তোলা কষ্টসাধ্য। শিল্পকলার প্রতিটি শাখাই যেন শ্ৰীমতীর স্পর্শে শ্রীময়ী হয়ে উঠেছিল। তার মধুর কণ্ঠে গাওয়া ভজন শুনতে মহাত্মা গান্ধী খুব ভালবাসতেন। পরেও ভজন গানের কয়েকটা রেকর্ড করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে শিখেছিলেন ছবি আঁকা। শেষ জীবনেও ছবি আঁকা, কারুশিল্প এসব নিয়েই থাকতেন। সব সময় চেষ্টা করতেন নিজের পারিপার্শ্বিককে কিভাবে সুন্দর করে ভোলা যায়। তাই মাঝে মাঝে লিখতেনও নাচ কিংবা ছবি সম্বন্ধে দু-চারটে প্রবন্ধ। গানের স্কুল, আর্ট স্কুল প্রভৃতির সঙ্গেও তার যোগ ছিল তবে আন্তরিক উৎসাহ ছিল নাচের বেলায়। কলকাতায় নিজের বাড়িতে একটা স্কুল খুলেও ছিলেন কিন্তু সত্যিকারের উৎসাহী ছাত্রের অভাবে হতাশ হয়েই তাকে বন্ধ করতে হল নৃত্যকলা। গতানুগতিকের পুনরাবৃত্তি তার কাছে ছিল অসহ্য।