একটু আগেই বলেছি, কবি জয়শ্রীর অসবর্ণ বিবাহ সমর্থন করেছিলেন। নন্দিতার ক্ষেত্রে তাকে আরো উদার হতে দেখা গেল। কৃষ্ণ কৃপালনী যখন তার কাছে নন্দিতার পাণিপ্রার্থনা করলেন তখন অনুমতি দিতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেননি রবীন্দ্রনাথ। বিস্মিত হয়েছিলেন কৃপালনী স্বয়ং। তিনি বাঙালী বা ব্রাহ্মণ বা ব্রাহ্ম কিছুই নন তবু কবির সানন্দ সমর্থন তাকে অভিভূত করে দিয়েছিল। কবি বিয়েতে নাতনীকে উপহার দিলেন পত্রপুট, নবজীবনের মাধুর্য থাকবে যার কাণায় কাণায় ভরে। বিয়ের পরেও নন্দিতা ছিলেন কবির খুব কাছে। দারুণ অসুখের সময় নন্দিতা অন্যান্য শুশ্ৰষাকারিণীদের সঙ্গে সমানে সেবা করেছেন দাদামশাইকে। প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত এক নাগাড়ে সেবা করতেন নন্দিতী, অমিতা থাকতেন তার সঙ্গে। অমিতার এখনো মনে হয়, সেবাশুশ্রুষা করবার ও পরিশ্রম করবার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল নন্দিতার। কবিও যেন সেই সেবার মধ্যে পেয়েছেন সান্ত্বনা :
দিদিমণি–
অফুরান সান্ত্বনার খনি।
কোনো ক্লান্তি কোনো ক্লেশ
মুখে চিহ্ন দেয় নাই লেশ।
কোনো ভয় কোনো ঘৃণা কোনো কাজে কিছুমাত্র গ্লানি
সেবার মাধুর্যে ছায়া নাহি দেয় আনি।
এই সেবার প্রয়োজনও একদিন ফুরল। এরপর নন্দিতা জড়িয়ে পড়লেন নানা কাজে।
১৯৪২ সালে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে শুরু হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলন। স্বাধীনতা আন্দোলন বাংলা দেশে নারী সমাজের মধ্যে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল তার বুঝি তুলনা হয় না। প্রতিটি ঘরের শিক্ষিত অশিক্ষিত মেয়েরা এগিয়ে এসেছিলেন প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে। বাস্তবিক পক্ষে বাঙালী নারীসমাজের পূর্ণমুক্তি ঘটেছে এই বিপ্লবকে কেন্দ্র করেই। চিরলাঞ্ছিত অপমানিতা নারীদের মনে স্বাধীনতার বাণী এত সাড়া জাগিয়েছিল কি করে কে জানে? নন্দিতাও কবির মৃত্যুর পর মহাত্মাজীর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন নন্দিতার জ্যাঠতুতো বোন অরুণ গঙ্গোপাধ্যায়ও। পরে যিনি অরুণ আসফ আলী নামে পরিচিত হন। এ সময় সক্রিয় রাজনীতির উন্মাদনা কম। শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, বীণা দাস, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওহদেদারের সাহসিক কার্যকলাপ হয়ে উঠেছে গল্প। এসেছে আগস্ট বিপ্লব। বহু নারী এই বিপ্লবে যোগ দিয়েছিলেন। এগিয়ে এসেছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা, বাসন্তী দেবী, অমল দাস, আরো অনেকে। যোগ দিয়েছিলেন নন্দিতা, শ্ৰীমতী, রাণী চন্দ ও আরো অজস্র বঙ্গললনা। তাদের গ্রেপ্তার করা হলে নন্দিতারও কারাদণ্ড হল ছ মাসের জন্যে। তিনি এসময় রাজশাহী জেলে কারারুদ্ধ ছিলেন।
মায়ের মতোই আত্মপ্রচারে বিমুখ নন্দিতার অধিকাংশ গুণই ঢাকা পড়ে। আছে। সব কিছুতেই তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছেন। না হলে তার সম্বন্ধে তথ্য এত কম পাওয়া যাবে কেন? কাজ তো তিনি কম করেননি। শান্তিনিকেতনে থাকার সময় তিনি শিখেছিলেন বাটিক, চামড়ার কাজ, কাপড়ের ওপর ব্লক প্রিন্টিং। ছবি আঁকা শিখেছিলেন নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, রামকিংকর প্রমুখ শিল্পীদের কাছে। এখনো চীনা ভবনের দেওয়ালে একটা ফ্রেসকো পেন্টিং তার শিল্প-দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। গানের ক্ষেত্রেও নন্দিতা আত্মপ্রকাশ করেননি। একটিমাত্র রেকর্ডের সমবেত সঙ্গীতে ধরা আছে। নন্দিতার কণ্ঠ। গান দুটি হল জনগণমন অধিনায়ক ও যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে। নন্দিতার বাকী তিনজন সহশিল্পী ছিলেন শান্তিদেব ঘোষ, সুধীন দত্ত ও অমল দত্ত। ভারত যেদিন স্বাধীন হয় সেদিন মধ্যরাতে সুচেতা। কৃপালনীর সঙ্গে নন্দিতাও গেয়েছিলেন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। এতে বোঝা যায়, নন্দিতার আত্মপ্রচারবিমুখতা কুণ্ঠার গুণ্ঠনে ঢাকা নয়। এ তার স্বাভাবিক নিস্পৃহতা। নয়ত যখন যেখানে ডাক পড়েছে দেশে কিংবা বিদেশে, নন্দিতা এগিয়ে এসেছেন হাসিমুখে। ১৯৪০ সালে মৃণালিনী সরাভাইয়ের নৃত্যদলের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকা যাত্রা এবং ১৯৬০ সালে সোভিয়েট সরকারের আমন্ত্রণে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে সেখানে গিয়ে Kuibyshey on the Volga ব্যালেতে চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য শিখিয়ে আসা এমনি দুটি ঘটনা। অবশ্য দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলের ভারতীয় দূতাবাসে সাংস্কৃতিক মন্ত্রকের অধিকা ছিলেন কৃষ্ণ কৃপালনী। নন্দিতা স্বামীকে নানাভাবে সাহায্য করেন; তাছাড়া ব্রাজিলের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গেও পরিচিত হন এবং সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় তার দক্ষিণ আমেরিকা সফরের বিষয়ে কিছু লেখেন। নন্দিতার লেখার হাত ভাল হলেও তিনি লেখিকা নন। কিছু চিঠিপত্র এবং সফর কাহিনীতে তাঁর কলমের শক্তির পরিচয় ছড়িয়ে আছে। তবে নন্দিতার সব কিছুই যেন অসমাপ্ত-অধসমাপ্ত রয়ে গেছে। নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, লেখা-কোন কিছুতেই সবাইকে ছাপিয়ে ওঠেননি। অন্যান্য অসমাপ্ত জিনিষের সঙ্গে আরো একটা জিনিষ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। সেটি হল একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নন্দিতা তাতে মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন কিন্তু অর্থাভাবে চিত্রটি সম্পূর্ণ হয়নি। রবীন্দ্রনাথ তার এই দিদিমণিটিকে নিয়ে অনেক কিছু লিখেছেন। কিন্তু নন্দিতাকে নিয়ে এখনো পর্যন্ত ভালরকম আলোচনা হয়নি বললে ভুল হবে না। অনেকেই কবি-দৌহিত্রী হিসেবে নন্দিতাকে খুব মনে রেখেছেন কিন্তু নন্দিতাকে স্বতন্ত্রভাবে দেখবার চেষ্টা করা হয়েছে খুব কম। নিকট আত্মীয়রূপে নন্দিত যে মহামানবকে পেয়েছিলেন, তার নিবিড় সান্নিধ্য নন্দিতার একক ব্যক্তিত্বকে যেমন খানিকটা ঢেকে রেখেছিল তেমনি কয়েকটি রাবীন্দ্রিক গুণেরও অধিকারী করে তুলেছিল। অপরিসীম রোগযন্ত্রণা নীরবে সহ করে তিনি যেদিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন প্রকৃতপক্ষে সেদিনই ঠাকুরবাড়ির অঙ্গন থেকে মুছে গেল শেষ রবিরেখা! রেখে গেল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে অতুল বৈভব!
১৬. অস্তরবির শেষ আশীর্বাদ
অস্তরবির শেষ আশীর্বাদ নিয়ে যে কয়েকটি মেয়ে এ যুগেও নিবু নিবু প্রদীপের সলতে উস্কে দিয়ে ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রেখেছেন বা এই সেদিন পর্যন্ত রেখেছিলেন তারা এসেছিলেন বধূরূপে। এঁদের নাম শ্ৰীমতী, অমিতা, অমিয়া, মেনকা ও পূর্ণিমা। এ প্রসঙ্গে আরেক জনের নাম করতে পারি তিনি নন্দিনী, রথীন্দ্র ও প্রতিমার পালিতা কন্যা। কবির আদরের পুপে দিদি সে গল্প এঁকে শোনানোর জন্যেই লেখা হয়েছিল। তিনিও বিভিন্ন নৃত্যগীতানুষ্ঠানে নিয়মিত যোগ দিতেন। এবার তাকানো যাক অন্যান্যদের মুখের দিকে।