বাণী স্বতন্ত্র প্রতিভার অধিকারিণী। ডক্টর বাণী চ্যাটার্জী নামে তিনি স্বদেশে যত পরিচিত বিদেশেও তাই। বিদেশীদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত উপভোগে প্রধান বাধা ভাষা। তাই বাণী হাত দিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত অনুবাদের কাজে। কবির সুর ও ছন্দকে বজায় রেখে তিনি যে গানগুলির অনুবাদ করেছেন সেগুলি বিদেশে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বাণীর কম্পােজ করা আনন্দলোকে মঙ্গলালোকের অনুবাদ In the realms of joy and good যিনি শুনেছেন তিনিই এর গুরুত্ব বুঝতে পারবেন। কবি নিজেও চেয়েছিলেন বাণীর কম্পােজ করা গান শুনতে। বাণীর কম্পােজ করা জয় ভারতের জয় গানের প্রশংসা শুনে কবির ইচ্ছে ছিল তার জনগণমন অধিনায়ক জয় হে গানটিকেও ওয়েস্টার্ন হারমনিতে পরিণত করবার জন্য বাণীকেই অনুরোধ জানাবার। সে, আর হয়ে ওঠেনি। এখন তো সেই জনগণমনের একটা স্তবক জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। অথচ বাণীর বেশ মনে পড়ে, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে সময় সংক্ষেপ করার জন্যে জনগণমনের কিছু অংশ বাদ দিয়ে গাওয়ার অনুমতি চাওয়া হলে কবি সম্মত হননি। তাই গোটা গানটাই গাওয়া হয়। ঐ গানের দলে ছিলেন বাণী।
বাণীর সঙ্গীতের জ্ঞান সহজাত। তাই সুরসৃষ্টি করা ছাড়াও বাণী মন দিয়েছিলেন একটা নতুন কাজে। তিনি সঙ্গীতশাস্ত্র ও সঙ্গীতবিজ্ঞান নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় তো ছিলই, স্বামী ডঃ শচীকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিদেশে গিয়ে সে পরিচয় আরো পাকা করে এলেন। এরপর তিনি কতকটা আপন মনেই মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সঙ্গীতকে বিচার করতে বসেন। জিনিষটা একেবারেই নতুন। পরে তার আলোচনা সমাদর লাভ করে ও তিনি এসিয়াটিক সোসাইটি থেকে বেশ কয়েকটা বক্তৃতা দেবার জন্যে আমন্ত্রিত হন।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তার বিষয়টা কি ছিল। কোন একটা বিষয় নয় অবশ্য। বাণী সঙ্গীতকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করবার চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় এবং য়ুরোপীয় উভয় সঙ্গীতের প্রভাবে মনস্তাত্ত্বিক কিংবা অন্য কোন পরিবর্তন বাস্তবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সত্যিই কি সম্ভব? বাণীর প্রশ্ন এটাই। উত্তর দেবার চেষ্টাও করেছেন তিনি। আমরা সব সময় শুনে থাকি গানের মতো শক্তিশালী প্রভাবশালী জিনিষ আর নেই। গানে পাষাণ গলে, বনের পশু বশ হয়। মানুষের মন? সে তো না বদলালে পাষাণকেও হার মানায়। প্রশ্ন, সত্যি সত্যি এই পরিবর্তন সম্ভব কি না? তা যদি হয় বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে তার বিচার বিশ্লেষণ করা যায় কি না। না গেলে ভারতীয় সঙ্গীতজ্ঞরা এক একটা রাগ ও রাগিণীর মানবায়িত রূপ দিলেন কি করে? কি করে বললেন দীপক রাগে আগুন জ্বলে, মেঘ রাগ বৃষ্টি নামায়। বাণীর মতে গানের শব্দ হাওয়াতে যে কম্পন সৃষ্টি করে তারই সাহায্যে নানারকম পরিবর্তন সম্ভব হয়। ভারতের সঙ্গীতশিল্পীরা এর সন্ধান রাখতেন এবং এর সাহায্যে গড়ে উঠেছিল রাগ দর্শন :
This encourages tis to look forward confidently for the time when the truths underlying the science of Raga-Music should be further unearthed and extricated by scientists from the leap of accuinulated debris of iguorance and colourful iuter polationis perhaps, the hieroglyphics of the Raga-Music deciphered and the subline philosophy of the Raga-Music, in all its purity, to its pristine glory restored.
বাণীর মতে প্রাচ্য বিজ্ঞানের একটা বিরাট সম্ভাবনাময় দিক লুকিয়ে আছে ভারতীয় সঙ্গীতের রাগরাগিণীর মধ্যে। রাগসঙ্গীতের চর্চা এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণে হয়ত সেই সম্ভাবনার স্বর্ণদুয়ার খুলে যেতেও পারে। এ নিয়ে বিতর্ক নিশ্চয় আছে। তবু পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ নেই। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের জার্নালে বাণীর কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধের কিছু অংশ ছাপা হয়। অবশ্য তার আগেই তিনি য়ুরোপ সফর করবার সময় এসব বিষয়ের ওপর বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তার বক্তৃতার প্রধান বিষয় ছিল, সাইকোলজি অ্যান্ড মিউজিক (১৯৩৪), সাইকো-মিউজিক ইন্ ওয়ার অ্যাণ্ড আফটার (১৯৪৪) ও মিউজিক ইন্ বেসিক এডুকেশন সাইকোলজি (১৯৪৯)। পাশের সালগুলো অবশ্য পুস্তিকা প্রকাশের সময়, বক্তৃতাও দিয়েছিলেন এ সময়েই বা একটু আগে।
এখানকার এসিয়াটিক সোসাইটিতে আরো কয়েকটা বক্তৃতার হদিশ মেলে, ভাইভারসনাল থেরাপি অ্যামিউজিক, টেগোর অ্যাণ্ড মিউজিক, এ্যাপলায়েড মিউজিক, কালচারাল কনট্যাক্ট অ্যাণ্ড মিউজিক, দি ভেদিক সঙস অ্যাণ্ড দি টেগোর, ওয়েস্টার্ন মিউজিক অ্যাণ্ড রাগরাগিণীজ, দি ওয়েস্ট অ্যাণ্ড দি ইস্ট ইন মিউজিক দে মীট, ইডিয়ান্ মিউজিক অ্যাণ্ড সিলটেইনিয়াস হারমনি ও কপ্যারেটিভ স্টাডিজ অব মিউজিক।
শেষোক্ত বিষয় নিয়ে বাণী গবেষণা করছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতে ভারতীয় রাগরাগিণীর প্রভাব খুঁজছিলেন। মানুষের মধ্যে, মানব প্রবৃত্তির মধ্যে যদি সাদৃশ্য থাকে তবে গানে কেন থাকবে না? ভাষাহীন সুরেই তো দুটি ধারার সাদৃশ্য থাকার কথা। তিনি দেখেছিলেন ভারতীয় সঙ্গীতের মধ্যেও আছে Harmony যা একান্ত ভাবে বিদেশী বলেই পরিচিত। শেষ জীবনে বাণী প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের তুলনামূলক ইতিহাস লিখছিলেন কিন্তু সে আর শেষ হয়ে উঠল না।