আত্মরক্ষা সমিতি সেই মেয়েদেরই প্রতিষ্ঠান, যারা সমাজে, সংসারে, অর্থনীতি আর রাজনীতি ক্ষেত্রে আত্মপ্রতিষ্ঠা পায় না কোনদিন, বঞ্চিত হয় সকল রকম অধিকার থেকেই। এই মেয়েদের সঙ্গত অধিকারের দাবি নিয়েই আত্মরক্ষা সমিতির আন্দোলন। যে সমাজ এবং শাসনব্যবস্থা নারীর শক্তিকে করে অপচয়, বঞ্চিত করে তাকে মানুষের অধিকার থেকে—সে ব্যবস্থাকে সুশাসক বা সুবিচার বলে মেনে নেয়নি আত্মরক্ষা সমিতি, নেবেও না কোনদিন। এই বঞ্চিত মানুষের কথাকেই ঘরে বাইরে পৌঁছে দেবে ঘরে ঘরে।
চার পাঁচ সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর ঘরে বাইরে প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। মঞ্জুশ্র আর একটা পত্রিকা প্রকাশ করেন জয়া নামে কিন্তু ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কমুনিস্ট পার্টি ভারতে নিষিদ্ধ হলে বঙ্গীয় সরকার পত্রিকাটির প্রচার বন্ধ করে দেন। এই ঘটনার মাসখানেক আগেই মঞ্জুশ্রী মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তাই সকলের সঙ্গে তিনিও কারারুদ্ধ হন। সঙ্গে ছিলেন মণিকুন্তলা সেন ও আরো অনেকে। সমস্ত কমুনিস্ট কর্মীরা এ সময় অনশন আরম্ভ করেন। প্রথমে পুরুষেরা এবং পাঁচ দিন পরে মহিলারা এই অনশনে যোগ দিয়েছিলেন। মঞ্জুশ্রীও অন্যান্যদের সঙ্গে একটানা অনশন করেছিলেন একান্ন দিন। তার বয়সের কথা বিবেচনা করে সকলেই তাকে বারণ করেন কিন্তু কোন নিষেধই তাকে টলাতে পারেনি। প্রায় একবছর কারাবাস করার পর ১৯৫১ সালে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলে মঞ্জুশ্রী মুক্তি পান। এর পরে তিনি আর রাজনীতির সঙ্গে বিশেষ যোগ রাখেননি তবে ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে চীন যাত্রা করেন The First Asian and Pacific Peace Conference-a catat catata জন্যে। এই দলে ছিলেন সয়ীফুদ্দীন কিচলু, ডাঃ জ্ঞানদ প্রমুখ অনেকে। মঞ্জুশ্রকে তারাই নির্বাচন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের নাতনী হিসেবে।
অবশ্য চীনে গিয়ে মঞ্জুশ্রী সেখানকার রাজনৈতিক বা সামাজিক জীবনের সঙ্গে খুব বেশি পরিচয় লাভের সুযোগ পাননি, তবে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন ক্যান্টন রেল স্টেশনের একটি সামান্য কুলিকে তন্ময় হয়ে লু সুনের গল্প পড়তে দেখে। একজন সাধারণ শ্রমিকের এই সাহিত্যপ্রীতি তার চোখে নতুন লেগেছিল, ভালও লেগেছিল। কোন সম্মেলনের প্রতিনিধি হয়ে কোথাও গিয়ে তো আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেশ দেখা যায় না তবু যা দেখেছিলেন তাই নিয়েই পরে লিখেছিলেন একটি গ্রন্থ নয়াচীনে যা দেখেছি। সে বইও এখন পাওয়া যায় না, ধূসর স্মৃতির ধূলো মাড়িয়ে আর অতীতে ফিরে যেতে চান না মঞ্জুশ্রী নিজেও।
জয়শ্রী আত্মপ্রকাশে বড়ই অনিচ্ছুক। ছোটবেলায় দিদির সঙ্গে তিনিও বিলেতে একসঙ্গে লেখাপড়া শিখেছেন, কোন কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন, একবার বিসর্জনে সেজেছিলেন সরস্বতী। কিন্তু বড় হয়ে আর সে সব নিয়ে বিশেষ মেতে ওঠেননি। একবার ঋতুরাজ সেজেছিলেন ঋতুরঙ্গে, পেছন থেকে গান করেছিলেন সাহানা দেবী। জয়শ্রীর বিয়ে হয়েছিল কুলপ্রসাদ সেনের সঙ্গে। অসবর্ণ বিবাহ। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী বাধা এসেছিল, আপত্তিও উঠেছিল। সুরেন্দ্রনাথ শোনেননি। বলেছিলেন, আমরা সকলেই যখন উচ্চ কণ্ঠে প্রচার করে আসছি যে দেশমাতা এক, আমরা সকলেই তার সন্তান, তখন মেয়ে অন্য জাতে বিয়ে করবার ইচ্ছে প্রকাশ করলে কোন্ মুখে আপত্তি করব? আমাদের বাপ-দাদা তাদের পূর্বপুরুষের প্রচলিত পথের বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, আমরা আবার বাপ-দাদার প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে যাচ্ছি, সুতরাং তাদের অনুরূপ কাজই করছি। এই বিবাহে পৌরোহিত্য করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। অসবর্ণ বিয়ে হলেও এখানে রেজিস্ট্রি করার কথা ওঠেনি।
হেমেন্দ্রনাথের চারজন পৌত্রী—গায়ত্রী, মেধা, গার্গী ও বাণীর মধ্যে বাণী সঙ্গীতের জগতে অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এই বাড়িতে নিরন্তর যে সঙ্গীতের স্রোত বয়ে চলেছিল বাণী তার যথার্থ উত্তরাধিকারিণী। অবশ্য হেমেন্দ্র-পরিবারের আরো দুটি বৌ-অমিয় ও মেনকাও গানের জগতে সুপরিচিত। কিন্তু সে শুধু সঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে। বাণী গানের সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা করেছেন সঙ্গীতশাস্ত্রের। তারা চার বোনই দেশী-বিলিতি বহু গান শিখেছিলেন। গায়ত্রী ও মেধা হিতেন্দ্রনাথের মেয়ে আর গার্গী ও বাণী ক্ষিতীন্দ্রনাথের মেয়ে। প্রথম তিন জনকে আমরা সংসার-জীবনের বাইরে খুব বেশী দেখতে পাইনি। গান গাওয়া, পিয়ানো বাজানো, কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দেওয়া, স্কুলে এবং কলেজে পড়া—ঘরের কাজের ফাঁকে ফাঁকে এ সবই ছিল তাদের জীবনে। গায়ত্রী খুব ভাল পিয়ানো বাজাতে পারতেন। মেধার গানের গলাটিও ছিল চমৎকার। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ অনেক হিন্দী গান শুনতেন, সেই সব গান ভেঙে নতুন গান তৈরি হত। তার মুখে অব তো মেরে কাণ শুনে কবি কার বাঁশি নিশিভোরে বাজিল রে গানটি তৈরি করেন। মেধা সেই গানটি গেয়েছিলেন শেষ বর্ষণের অভিনয়ের সময়। তার স্বভাবটি ছিল সলজ্জ-মধুর, কমনীয়। আত্মপ্রকাশে উৎসাহ ছিল না বলে একরকম চোখের আড়ালেই রয়ে গেলেন তিনি, তাঁর গানের সঙ্গেও সকলের পরিচয় ঘটল না। তিনি গান শিখেছিলেন গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। গার্গীও গান। জানতেন। কারুর গান শুনলেই সেটা তুলে নিতে পারতেন। ঘর-সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি মাঝে মাঝে হাতে লেখা কিশলয় পত্রিকায় দুটোএকটা লিখেওছেন। তবে সে সব পত্রিকা এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না।