অরুণেন্দ্রনাথের তিনি মেয়ের কথাও এ প্রসঙ্গে সেরে নেওয়া যেতে পারে। ললিতা (লতিকা), সাগরিকা ও কণিকা তিনজনেই ছিলেন সহজ, সরল এবং সাংসারিক। অত্যন্ত হাসিখুশি আমুদে ললিতা ও তার স্বামী জ্ঞানদাভিরাম বড়ুয়া গোড়ায় গলদ নাটকে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। ক্ষান্তমণি। সেজেছিলেন ললিতা, যেন বইয়ের পাতা থেকে সশরীরে আবির্ভূত হয়েছিল ক্ষান্তমণি। ললিতার ছোট বোন কণিকাও ভাল অভিনয় করতেন। তিনি ও তার দিদি সাগরিকা দুজনেই খুব পড়তে ভালবাসতেন। যদিও ডিগ্রী-ডিপ্লোমা নেবার কোন রকম ঝোঁক এঁদেরও ছিল না। গান শিখেছিলেন, কণিক। সেতারও বাজাতে পারতেন। সাগরিকাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রথম মেয়ে, যিনি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন। তার আগে রবীন্দ্রনাথের মেয়েরা ছাড়া ঠাকুরবাড়ির কোন মেয়েই শান্তিনিকেতনে যাননি। কণিকার অভিনয়ের কথা আগেই বলেছি। তিনি লেখা-পড়া, গানবাজনা, ইংরেজীতে কথা বলা, অভিনয় করা সবই শিখেছিলেন। গোড়ায় গলদে সেজেছিলেন ইন্দুমতী। চিরকুমার সভায় নীরবালা, নীরবালাকে হাসি-গানে-অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলা কঠিন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন কণিকার অভিনয়ে প্রাণ পেয়েছিল নীরবালা। কিন্তু দ্বিজেন্দ্র পরিবারের ধারা অনুযায়ী কোন মেয়েই বাইরে ছড়িয়ে পড়েননি।
সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই মেয়ে মঞ্জুশ্রী ও জয়শ্রীর মধ্যে মঞ্জুশ্রী কবির সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন বেশি। শান্তিনিকেতনের ছোট ছোট অনুষ্ঠানেই তাঁর গান এবং অভিনয় সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অসামান্য সুকণ্ঠের অধিকারিণী মঞ্জুশ্ৰ৷ আরো একটি দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারিণী। বিসর্জন নাটকের একটি অভিনয়ে তিনি কবির সঙ্গে অভিনয় করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেজেছিলেন জয়সিংহ। বৃদ্ধ হয়েও অসামান্য প্রতিভার সাহায্যে তিনি রূপায়িত করেছিলেন পূর্ণ যুবক জয়সিংহকে। অপর্ণা হয়েছিলেন রানু অধিকারী কিন্তু তিন দিনের অভিনয়ের একদিন তিনি অভিনয় করতে পারেননি। তাই সেদিন কবির একান্ত আগ্রহেই অপর্ণার ভূমিকায় অভিনয় করতে সম্মত হন মঞ্জুশ্রী। সুন্দর হয়েছিল সে অভিনয়। অভিনয়ে মঞ্জুশ্রীর মা সংজ্ঞাও অভিনয় করেছিলেন। তিনি সেজেছিলেন গুণবতী কিন্তু দুদিন অভিনয় করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তৃতীয় অভিনয়ে পুনরায় মঞ্জুশ্রীকেই নিতে হয়েছিল গুণবতীর ভূমিকা। পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না, দুটি ভিন্নধর্মী চরিত্রকে পর পর দুটি রাত্রে দর্শকদের সামনে সার্থকভাবে উপস্থিত করাও খুব সহজ নয়। দর্শকরাও ঘরের মানুষ ছিলেন না, ছিল না শান্তিনিকেতনের ঘরোয়া আসর তবু কোন অসুবিধেই হয়নি। এমনিই সহজ সাবলীল ছিল মঞ্জুশ্রীর অভিনয়। তার অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় আরেকবার পাওয়া যায় ভৈরবের বলি নাটকের অভিনয়ে। রবীন্দ্রনাথ রাজা ও রাণীকে নতুন রূপ দিলেন ভৈরবের বলিতে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ১৯২৯ সালে দুদিন অভিনয়ের আয়োজনও হয়! মঞ্জুশ্রী রাণী সুমিত্রার ভূমিকায় খুব ভাল অভিনয় করেন। এই ভূমিকাতেই প্রথম অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন মঞ্জুশ্রীর পিতামহী জ্ঞানদানন্দিনী। রাজার ভূমিকা গ্রহণ করেন মঞ্জুশ্রীর স্বামী ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। এ সময় রবীন্দ্রনাথ বিদেশ সফরে যাত্রা করায় তার আর দেখা হয়ে ওঠেনি। একবার মঞ্জুশ্ৰীও কবির সঙ্গে যুরোপ-ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তারপর লণ্ডনের একটি বোর্ডিং হাউসে বছর খানেক থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসেন।
পরবর্তী জীবনে মঞ্জু ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর স্বামী ক্ষিতীশপ্রসাদ ছিলেন কংগ্রেসের অন্যতম নেতা, অসহযোগ আন্দোলনের উদ্যোক্তা। কিন্তু মঞ্জুশ্রী প্রখর রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেননি, দিয়েছিলেন সহানুভূতি ও সমবেদনার দুর্বার আবেগে। এই সমবেদনাই তাকে টেনে এনেছিল কম্যুনিস্ট পার্টিতে।
১৩৫০-এর ভয়াবহ মন্বন্তরের সময় মঞ্জুশ্রী রয়েছেন কৃষ্ণনগরে। দুর্ভিক্ষের আঁচে ঝলসে যাওয়া কলকাতার খবর তার অজানা। হঠাৎ কি করে যেন হাতে এসে পড়ল একটা কম্যুনিস্টপন্থী পত্রিকা। আলতোভাবে চোখ বোলাতে গিয়ে শিউরে উঠলেন একটা প্রবন্ধ পড়ে। উঃ কী ভয়ঙ্কর! প্রবন্ধটি হল সোমনাথ লাহিড়ীর tieties of Death in Calcutta. পড়ার পর দু চোখ জলে ভরে গেল। অনাহারে অনুশোচনায় বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে মনস্থির করে ফেললেন মঞ্জুশ্রী। কিছু করতেই হবে। এদের জন্যে কিছু করতেই হবে। পরদিনই কলকাতায় ফিরে এসে স্বামীর সাহায্যে কিছু অর্থসংগ্রহ করে ফেললেন। আত্মীয়স্বজনেরাও মঞ্জুশ্রীর ঝুলি ভরে দিলেন সাধ্যমতো। মঞ্জু শ্ৰ সংগৃহীত অর্থ নিয়ে ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের পরামর্শ মতো কিছু ওষুধপত্র কিনে নিয়ে ফিরে গেলেন কৃষ্ণনগরে। মহামারী দূর করবার জন্যে বাড়িতেই খুলে ফেললেন রিলিফ সেন্টার। এসময় তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিল স্থানীয় কমুনিস্ট পার্টির সদস্যরাও। তখনও পার্টির কোন মহিলা-সমিতি গড়ে ওঠেনি। মঞ্জুশ্রীই কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন মহিলা আত্মরক্ষা-সমিতি। এই সমিতিরই মুখপাত্র ছিল ঘরে বাইরে। সম্পাদিকাও মঞ্জুশ্রী নিজেই। সমিতির উদ্দেশ্য ছিল, যে সব মেয়েরা সমাজসংসার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা পায়নি তাদের সঙ্গত অধিকার দাবি করা। তিনি দেখেছিলেন সাধারণত এই ধরনের প্রতিষ্ঠাহীন মেয়েরাই বঞ্চিত হয় সব রকম অধিকার থেকে। তাই তাদের জন্যেই তিনি সংগ্রাম শুরু করেছিলেন :