শেষ জীবনে তার মন ঝুকেছিল তথাগতের আদর্শের প্রতি। কিছু মানসিক অশান্তি তাকে আরো ঠেলে দিয়েছিল মহাবোধি সোসাইটির দিকে। পারিবারিক ট্র্যাডিশন অনুযায়ী তিনি একটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাগবাজারে। নাম সাবিত্রী শিক্ষালয়। ঘুরে ঘুরে চাঁদা তুলে অনেক পরিশ্রম করে তিনি এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করেন লেখিকা প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, পরে সেখান থেকেও নীরবে সরে এসেছিলেন রমা। নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন মহাবোধি সোসাইটির সৌম্য-শান্ত বুদ্ধদেবের চরণতলে। সেখানে তিনি একটি রচনা সংকলন প্রকাশ করেন লর্ড বুদ্ধ এ্যাণ্ড হিজ মেসেজ নামে। তাতে তার নিজের লেখা না থাকলেও তিনি সংগ্রহ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, ইন্দিরা, অসিত হালদার, সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের রচনা। রমার শেষ জীবনের কথা বলেছিলেন তার মেজো বোন এণা। দিদির লেখা-আঁকা সযত্নে তিনি রেখে দিয়েছিলেন। জিনিষ হারায় না, মানুষ হারায়। তাই ভাইবোনদের মধ্যে এখন তাদের এক বোন ছাড়া কেউ নেই। দিদির মতো গাইতে না পারলেও এণা শিখেছিলেন বাঁশী আর সেতার বাজাতে। বিচিত্রায় যে ট্যাবলো অভিনীত হত তাতে এণাও যোগ দিতেন। একবার সেজেছিলেন শকুন্তলা। এণা বিয়ে করেছিলেন রাজেচন্দ্র রায়কে। বিয়ের ব্যাপারে ঠাকুরবাড়ির ট্র্যাডিশন ভেঙেছিলেন তিনিই। তাই পরিণয়ে প্রগতির লেখিকা শৈলসুতা দেবী তার গ্রন্থে এই বিয়ের কথা বর্ণনা করেছেন। আধুনিক সমাজকে ব্যঙ্গ করে প্রগতিশীলদের নিয়ে লেখা অনেকের কথাই পরিণয়ে প্রগতিতে আছে! লেখিকা এণা ও রাজেন্দ্রের প্রসঙ্গে বইয়ের ২১৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন :
এণা দেবী জোড়াসাঁকো ঠাকুর-বংশের কন্যা। মিঃ আর. সি. রায়ের পূর্বপুরুষরা হিন্দু ছিলেন, জাতিতে তারা বৈদ্য। মিঃ রায়ের পিতা গোপাল রায় খ্রস্টধর্মে আস্থাবান …এ বিদুষী ও গুণবতী। তাহার সহিত পরিচয় লাভে আর. সি. রায় মুগ্ধ হইলেন; এণও তাঁহার প্রতি অনুরাগিনী হইয়া পড়িলেন। দুজনে বিবাহ সম্বন্ধে পরামর্শ হইল—এই স্থির হইল যে ধর্মগত বিভেদের জন্য তাহারা পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিবেন না। বিবাহে আবদ্ধ হইয়াও নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাস বজায় রাখিবেন।
বিয়ের পর এ চলে গিয়েছিলেন ঢাকায়, একেবারে ভিন্ন পরিবেশে। সেখানেও যে অনুকূল পরিবেশ ছিল না তা নয়, তবু এণ ইচ্ছে করেই হাই সোসাইটির কেন্দ্রমণি হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি। ঘরের মধ্যে ছোট্ট একটা সুখের সংসার গড়তেই তার ভাল লেগেছিল। তার মেয়ে কৃষ্ণা বর্তমানে ফ্রান্সে নানারকম সাংস্কৃতিক কাজে-কর্মে জড়িয়ে আছেন।
সুধীন্দ্রনাথের ছোট মেয়ে চিত্রা কিছুদিন ছিলেন শান্তিনিকেতনে। নাচ-গান অভিনয়ের ধারা মিশেছিল তার রক্তে তাই খুব সহজেই তিনি এ তিনটি জিনিষ আয়ত্ত করে ফেললেন। বিশেষ করে নাচে তাঁর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেল। শান্তিনিকেতনে প্রতিমার পরিকল্পনা মতো নাচ শেখানো তখন সবে শুরু হয়েছে। নৃত্যশিক্ষক হিসেবে এসেছেন মণিপুরী শিক্ষক নবকুমার। অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির যে তিনটি মেয়ে এ সময় নাচ শেখেন তারা হলেন চিত্রা, নন্দিতা ও নন্দিনী। অন্য মেয়েদের মধ্যে ছিলেন শ্রীমতী হাতিসিং, গৌরী ব, নিবেদিতা দেবী, অমিত চক্রবর্তী, মালতী সেন, উমা দেবী, অমল রায় চৌধুরী, যমুনা দেবী এবং আরো অনেকে। এঁদের মধ্যে শ্ৰীমতী ও অমিতা পরে ঠাকুরবাড়ির বৌ হয়েছিলেন। চিত্রা নাচের দলে ছিলেন ট্র্যাডিশন ভাঙার সময়। ঠাকুরবাড়ির উঠোনে প্রথম যে নৃত্যানুষ্ঠান হয় তাতে নেচেছিলেন চিত্রা ও নন্দিতা। তারপর নেচেছিলেন ঋতুরঙ্গে সবার রঙে রঙ মেশাতে হবে গানটির সঙ্গে। নিউ এম্পায়ারে সরলাদেবীর পরিচালনায় যে মায়ার খেলার অভিনয় হয় চিত্রা তাতে সেজেছিলেন মায়াকুমারী। আলোড়ন জাগিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালের ১৮ অগাস্টের The Englishman জানিয়েছে,…an entirely novel Indian dance by Miss Chitra Tagore and another by Miss Reba Roy…were greatly appreciated by the larger audience.
Forward কাগজের প্রতিনিধিও অনুরূপ কথাই লিখেছেন, The Dances forined a salient feature of the play. It was a sheer delight to watch Sm. Reba Ray and Sm, Chitra in their movements. In the magic of Chitras feet was revealed the enchantment of first love.
সরলাদেবীর মায়ার খেলা হয়ে যাবার কয়েকদিন পরে ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েদের উদ্যোগে আরেকবার মায়ার খেলা হয়। এই অনুষ্ঠানে চিত্রা পরিবেশন করেছিলেন একটি স্বতন্ত্র জাপানী নৃত্য। Forward কাগজের প্রতিনিধি ১৯২৭-এর ১৩ সেপ্টেম্বর পুনরায় লিখেছেন :
Srimati Chitra, who excelled in her Japanese dayce, came in for the largest share of the claps. Her quick and jumpy steps, though an adaptation from the west, seemed to have a fascination all their own.
শুধু নৃত্য নয়, অভিনয়েও চিত্রা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। নটির পূজায় তিনি সেজেছিলেন বাসবী। তপতী নাটকে নিয়েছিলেন মঞ্জরীর ভূমিকা। এই নাটকের গানের দলেও গান গাইতেন তিনি। এর পরেও অন্যান্য অনুষ্ঠানে চিত্রা যোগ দিয়েছেন। চিরকুমার সভার অভিনয়ে নৃপবালা সেজে অবাক করে দিয়েছেন সবাইকে কিন্তু পরে খুব বেশি অনুষ্ঠানে তিনি আর যোগ দেননি।