পারুল ঠাকুরও এ বাড়ির দৌহিত্রী। সৌদামিনীর বড় মেয়ে ইরাবতী, তার মেয়ে পারুল। দুই বাড়ির দুই সৌদামিনীর মধ্যে ভারি ভাব ছিল। দুজনেরই এক নাম, তাই সই পাতিয়েছিলেন দুজনে। ইরাবতীর তিন দিনের মেয়েকে দেখে তার সঙ্গে নাতি অলোকেন্দ্রের বিয়ে ঠিক করেছিলেন সৌদামিনী। তাঁর কথার নড়চড় হয়নি। অবনীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্রবধু হয়েই এলেন পারুল। তখন অবশ্য সৌদামিনী পরলোকে। পাঁচ নম্বরে তখনও সাবেকী রীতি বজায় আছে। বৌদের সকালে যেতে হয় তরকারি বানানোর আসরে। তিন শাশুড়ীর একজন এসে বসতেন চৌকীতে। সামনে দু পাশে সার দিয়ে আসন পেতে বসে পড়তেন বৌ-ঝিরা। দাসীরা তরকারির খোসাটোসা ছাড়িয়ে এনে দিলে তারা গিন্নীর নির্দেশে কুটতেন ঝালের তরকারি, ঝোলের ব্যঞ্জন, কালিয়ার আলু, ঘণ্টর আলু কিংবা ডালনার তরকারি। পারুলের কাজ শেখার শুরুও এমনিভাবে। নাচগান-অভিনয়ে তার বড় সংকোচ। তবু রবীন্দ্রনাথ জোর করে তাকে একবার নামিয়েছিলেন বর্ষামঙ্গলে। হে ক্ষণিকের অতিথি গানের সঙ্গে তার নীরব আবির্ভাব হবে শরৎলক্ষ্মী রূপে। কথা বলতে হবে না, গান গাইতে হবে না শুনে রাজী হলেন পারুল। তা বলে যে গান শেখেননি তা নয়। বিয়ের আগে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে গান ও সেতার শিখতেন, বিয়ের পরে শ্যাম সুন্দর মিশ্রের কাছে। ছবি আঁকা শেখাতেন নন্দলাল বসু, তবু এসবে বড় সংকোচ। শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেঘের মতো একটাল চুল এলিয়ে সাজলেন শরৎলক্ষ্মী। গানের সঙ্গে তাঁর নীরব আবির্ভাব আবার পিছনে হেঁটে প্রস্থান এই ছিল তার ভূমিকা। এখনকার মতো সেকালে তোল অডিয়েন্সের দিকে পিছন ফিরে প্রস্থানের রেওয়াজ ছিল না। তাই পিছনে পায়ে পায়ে সরে গিয়ে প্রস্থান করা হত! মাঝে মাঝে পারুল গিয়ে বসতেন রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রার আসরে। শুনেছিলেন প্রথম শেষের কবিতা পাঠ। সেখানে তিনি দেখেছিলেন কবি যখন হাসির গল্প পড়তেন তখন তিনি নিজে হাসতেন না, অন্যের প্রতিক্রিয়া ক্ষ্য করতেন। পারুল তার নাতনী তাই ভয়টা কম; হেসে গড়িয়ে পড়তেন। কবি জিজ্ঞেস করতেন, তোরা হাসছিস কেন? অন্যরা চুপ করে যেতেন। পারুল হেসে বলতেন, তুমি হাসির কথা বলছে, হাসবো না? গল্পটা আমরা তার মুখেই শুনেছি।
পুরনো দিনগুলো কেটে গেছে স্বপ্নের মতো। সুখের স্মৃতির মতো ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এই পর্বে যেন নিজেদের অনেকখানি গুটিয়ে নিয়েছেন। শুক্তি যেমন সযত্নে মুক্তোটিকে লুকিয়ে রাখে এঁরাও তেমনি সযত্নে নিজেদের মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন সে যুগের সেই দুর্লভ স্মৃতি আমাদের কাছে এসব গল্প, কিন্তু সুরূপা, সুজাতা, সুরমা, পারুলের কাছে তো গল্প নয়। বৈঠকখানা বাড়ি আর নেই, মিশে গেছে মাটির সঙ্গে ধূলো হয়ে তবু মনে তার নিত্য যাওয়াআসা। স্মৃতির সরণি বেয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে সেই রূপকথার ঘুমন্ত রাজবাড়িটিতে। এখনো তাদের বুকে মৌন বেদনা গুমরে গুমরে ওঠে কেন ভাঙা হল বাড়িটা? মহর্ষিভবনের মত নব কলেবর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও যে মাঝে মাঝে দেখে আসা যেত নিজেদের হারানো শৈশবকে।
১৫. আবার ফিরে আসি মহর্ষিভবনে
আবার ফিরে আসি মহর্ষিভবনে। এখন অবশ্য ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। বাড়িতে রয়েছেন অনেকগুলি নাতনী আর নাতবৌ। কবির নতুন নাটকে তারা পার্ট নেবেন, ভরে দেবেন নতুনগানের ডালি। এখন আর কোন একক ভূমিকা যেন স্পষ্ট নয়। এখন সারা বাংলার মেয়েরা এগিয়ে এসেছেন নব জাগৃতির পথ বেয়ে। সেই প্রথম পায়ে চলা একহারা সরু পথটা কোথায়? সেই বুঝি পথ হারিয়েছে। রবীন্দ্রনাথও ধরলেন বেলা শেষের গান। এই শেষ বেলাকার রাগিনীর ধুয়ো ধরতে এগিয়ে এলেন আরো কয়েকজন।
সুধীন্দ্রনাথের তিনটি মেয়ে—রমা, এণা, চিত্রা। তিনজনেরই নানারকম সুকুমার কলায় দক্ষতা ছিল। যদিও কেউই সাময়িকতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। রমার গানের গলা ছিল অসাধারণ। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভালবাসতেন কবি স্বয়ং। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের কথায় তার দিদির গলায় এই যে কালো মাটির বাসা, না গো এই যে ধূলা আমার না এ, সাঁঝের রঙে রাঙিয়ে গেল হৃদয় গগন, সন্ধ্যা হল মা বুকে ধবো এই গানগুলো যারা কখনো শোনবার সৌভাগ্য লাভ করেছে তারা কখনো ভুলবে না। কবি বলতেন, তাঁর গান রমার গলায় যেমন রূপ নেয় এমনটি খুব কম লোকের গলাতেই নেয়। আমাদের দুর্ভাগ্য তাঁর গানের কোন রেকর্ড হয়নি। যারা শুনেছেন তারা বলেন সে গানে মিশে থাকত মাধুর্য আর গভীরতা।
লেখা এবং লেখানো, গান গাওয়া এবং শেখানো সবেতেই রমার উৎসাহ ছিল। অভিনয়ও করেছেন বারকতক। মায়ার খেলায় একবার কুমার আরেকবার শান্তা সেজেছিলেন রমা। দুবারই সুন্দর হয়েছিল তার অভিনয়। প্রফুল্লময়ীর আমাদের কথা হয়ত কোনদিনই শোনা যেত না, যদি না রমা থাকতেন। আগ্রহ আর উৎসাহ নিয়ে তিনি বসতেন দিনের পর দিন বলো নদিদি বলো তোমার কথা বলে। ধীরে ধীরে খুলত স্মৃতির দুয়ার—অনেক চোখের জল মাড়িয়ে প্রফুল্লময়ী এই নাতনীর আবদারেই ফিরে যেতেন নিজের কৈশোরে। এ কি কম কৃতিত্ব! নিজেও লিখতেন রমা। শান্তিনিকেতনে বেরোত মেয়েদের কাগজ শ্রেয়সী। তাতে তিনি দু-একটা ইংরেজী গল্প স্বচ্ছন্দ অথচ সাধু ভাষায় অনুবাদ করেছেন। স্নেহলতা দেবীর একটা গল্প সাপুড়ের গল্প নামে অনুবাদ করেন রমা। ইন্দিরার ভারি ইচ্ছে ছিল রবীন্দ্রনাথের নারী সংক্রান্ত রচনাগুলি একত্র করবার। বলেছেন একে তাকে, কেউ যদি সমগ্র রবীন্দ্র সাহিত্য অনুসন্ধান করে মেয়েদের সম্বন্ধে কোথায় কি তিনি লিখেছেন তা একত্র করে প্রকাশ করতে পারেন তবে মস্ত একটা কাজ হয়। সেই ভার নিয়েছিলেন রমা। রবীন্দ্র সাহিত্যে নারীর স্থাকোথায় তাই দেখার জন্যে। শ্রেয়সীর কয়েকটা সংখ্যায় রবীন্দ্র সাহিত্যে নারী নাম দিয়ে অনেক রচনা সংকলনও করেন। তবে সময়ের অভাবে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেননি।