বরণের পরে মা ছেলের কাছ থেকে কনকাঞ্জলি নেবে। ছোট একটি থালাতে অল্প একটু আতপ চাল, একটি টাকা দিয়ে ছেলের হাতে দিতে হয়, দিয়ে মা সামনে আঁচল পেতে দাঁড়ায় ও ছেলেকে তিনবার জিজ্ঞাসা করে, বাবা কোথায় যাচ্ছে? ছেলে বলে, মা তোমার বৌ আনতে যাচ্ছি।…তিনবার সেই কথাটি বলে মায়ের আঁচলে ঐ চাল ঢেলে দিয়ে নারায়ণ প্রণাম ও মাকে প্রণাম করে যাত্রা করে। সম্প্ৰদান হয়ে গেছে এই খবর মায়ের কানে দিতে হয়; দিলে সারাদিনের উপোসের পর ঐ কনকাঞ্জলির চাল মা একটু ফুটিয়ে মুখে দেন ও দুধ মিষ্টি খান।
মাধবিকা এভাবে খুঁটিনাটির দিকে নজর দিয়ে যত্ন করে লিখেছেন। তবে বইয়ে তার নাম লেখা হয়েছে শুধু মাধবী।
মাধবিকার ছোট বোনেরা কোথাও কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেননি বা করতে চাননি। তাঁর যমজ বোন মালবিকা ছোটবেলায় মুখে মুখে ছড়া বানিয়ে সবাইকে হাসাতে পারতেন। একবার এক আত্মীয়াকে নিয়ে ছড়া বানাতে গিয়ে খুব ধমক খেয়েছিলেন। দিদিমা সৌদামিনী ধমক দিলেও ছড়া শুনে না হেসে পারেননি। পরবর্তীকালে কিন্তু এই আমুদে মহিলাটির ছড়া লেখায় উৎসাহ ছিল কিনা জানা যায়নি। তবে কমলা কিছু কিছু কবিতা লিখতেন। তিনি দু-একটি নারী সমিতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখা কয়েকটা অপ্রকাশিত কবিতা এখনো আছে। মেয়ের মৃত্যুর পরে লেখা একটা কবিতায় দেখা যাচ্ছে তিনি বেছে নিয়েছেন গদ্য ছন্দের আঙ্গিক :
আমার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে কেড়ে
নিয়েছে কে তাকে, সব শূন্য করে দিয়ে
তারপরে তার বন্ধু দুটি এসে
বসলো আমার কাছে, একবার
আমার দিকে চেয়ে মাথা বইল
নীচু করে, চোখের জল নিলে
সাম্লে আমার কাছে, মাসীমা
বলে ডাকলে আমায় তারা;
এ জন্মের মতো সে গেল চলে, রেখে
গেল বুঝি, এদের আমার কাছে
ভোলাতে আমায়।
বৈঠকখানা বাড়ির বৌয়েদের কথাও এই ফাঁকে সেরে নেওয়া যাক। আমাদের কালসীমার মধ্যে ঐ বাড়িতে বৌ হয়ে এসেছেন কনকেন্দ্রের স্ত্রী সুরমা, নবেন্দ্রের স্ত্রী অপর্ণা ও অলোকেন্দ্রের স্ত্রী পারুল। গগনঠাকুরের বড় ছেলে গেহেন্দ্র ও তার স্ত্রী মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল অল্প বয়সে। মেজো ছেলে কনকেন্দ্র। সুরমা ছিলেন ভাল অভিনেত্রী। ঘরোয়া আমোদ আদে মেতে উঠতেন। তাঁর গায়ের রঙ ছিল খুব ফরসা আর গাল দুটি পাকা। ডালিমফলের মতো লাল। হাসলে আরো টুকটুকে হয়ে উঠত। বিচিত্রায় হত নানারকম অনুষ্ঠান। একবার হল শকুন্তলা ট্যাবলো। সুরমা সেজেছিলেন দুষ্যন্ত আর সুধীন্দ্রনাথের মেয়ে এণা শকুন্তলা। সুন্দর হয়েছিল সে অভিনয়! আরেকবার হয়েছিল মৃণালিনী নাটক। সুরমা সেজেছিলেন পশুপতি আর মনোরমার ভূমিকায় পূর্ণিমা। মেয়ে মহলের ব্যাপার বলে অভিনয়ের শেষটা বদলে দেওয়া হয়। পশুপতির মৃত্যুর পর মনোরমা বিধবা হবে—সে দৃশ্যের বদলে দেখান হল পশুপতি মনোরমার হাত ধরে কাশী চলে যাচ্ছে।
সুরসিক গগনেন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে মজার কাজ করতেন। একবার একজন প্রৌঢ়া মহিলাকে ঠকাবার জন্যে তিনি সুরমাকে রাজা যতীন্দ্রমোহনের বাড়ির দারোয়ান সাজিয়ে দিলেন। সুরমা এসে লাঠি ঠুকে দাঁড়ালেন। মাথায় পাগড়ি, মস্ত গোঁফ-কে বলবে ভোজপুরী দারোয়ান নয়। সেই ভদ্রমহিলাও চলো যাই বলে যতীন্দ্রমোহনের বাড়িতে ফিরে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই সবাই হেসে উঠলেন। এ ভাবেই রসের হাট জমে উঠত।
সুরমার ছয় মেয়ে—অনুভা, গৌরী, বকুল, করবী, শুক্লা ও সীমা। তারা প্রত্যেকেই গুণী শিল্পী। গান-বাজনা-সেলাই-বাটিকের কাজ প্রভৃতি নিয়ে বেশ নাম করেছেন। এঁদের মধ্যে অনুভা ঠাকুরের নাম আর একটি কারণেও উল্লেখযোগ্য। তিনি গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রথম যুগে দুখানি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন। গান দুটি হল দেখো দেখো শুকতারা আঁখি মেলি চায় ও নাই বা এলে যদি সময় নাই। আজ রেকর্ডটি দুষ্প্রাপ্য। কবির সত্তর বৎসর পূর্তি উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান হয় তাতেও তিনি গান গেয়েছিলেন। ছোটবেলায় একবার সেজেছিলেন বিসর্জনের হাসি, একটু বড় হয়ে ভৈরবের বলি নাটকে ইলার সখী। কিন্তু বিয়ের পর রুড়কিতে চলে যাওয়ায় অনুভ। আর
অভিনয় ও সঙ্গীতচর্চার সুযোগ বেশি পাননি। এ সময় তিনি সমাজ সেবার। কাজে যোগ দিয়ে একটা চাইল্ড সেন্টার গড়ে তোলেন। বম্বেতেও তিনি বাটিক শেখর স্কুল, নিউ ওয়ার্ক সেন্টার প্রভৃতি নিয়ে কাজের মধ্যে ডুবে থাকতেই ভালবাসতেন। সীমাও গানের ক্ষেত্রে তার যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। গৌরী ভাল সেলাই জানেন। শান্তিনিকেতনে যোগ দিয়েছেন সমবেত গানে। কখনো ভৈরবের বলি কখনো বা শাপমোচনে। এই সুরমারই এক পৌত্রী চিত্রাভিনেত্রী শর্মিলা। সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার-এ তাঁর প্রথম চিত্রাবতরণ থেকে ক্রিকেট খেলোয়াড় পতৌদির নবাব মনসুর আলি খানের বেগম আয়েস। সুলতানা হয়ে ওঠার গল্প আজ সকলেই জানে। সুরমার অপর পৌত্রী ঐন্দ্রিলাও শৈশবে কাবুলীওয়ালা চিত্রের মিনির ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন।
অপর্ণা দ্বিপেন্দ্রনাথের দৌহিত্রী। তারা তিন বোন সুরমা, অপর্ণা আর পুর্ণিমা। তাদের মা নলিনীর বিয়ে হয়েছিল সেই বিখ্যাত চৌধুরী পরিবারে, যেখানে বধূ হয়ে প্রবেশ করেছিলেন প্রতিভা ও ইন্দিরা। কাজেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের যা যা গুণ থাকে তার সবই ছিল বোনেদের মধ্যে। অপর্ণা ও পুর্ণিমার বিয়ে হয়েছিল ঠাকুরবাড়িরই দুই ছেলের সঙ্গে। অপর্ণার স্বামী গগনেন্দ্রর ছেলে নবেন্দ্র আর পূর্ণিমার বিয়ে হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথের পৌত্র সুধীরেন্দ্রর সঙ্গে। অপর্ণার গান ও বেহালা বাজানোর কথা ইন্দিরা বারবার বলেছেন। শোনা গেছে দুটি রবীন্দ্র সঙ্গীত দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার ও যদি প্রেম দিলে না প্রাণে তার কণ্ঠে যত ভাল শোনাত অমনটি আর কেউ গাইতে পারতেন না। এক একটা গান বা অভিনয় সম্বন্ধে শোনা যায় এক একজনের কৃতিত্বের কথা। এভাবে যদি কেউ রবীন্দ্রসঙ্গীত বা রবীন্দ্ৰনাটকের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস লেখেন তাহলে দেখা যাবে সঙ্গীত ও নাটকের প্রয়োগরীতির দিক থেকে কবি তাঁদের বাড়ির ছেলেদের চেয়েও মেয়েদের সাহায্য পেয়েছেন অনেক বেশি। ভৈরবের বলি ও আরো দু-একটা নাটকে অভিনয়ও করেছেন অপর্ণা। ভৈরবের বলিতে তিনি সেজেছিলেন ইলা।