কলকাতায় মেয়েদের জন্য যখন বেথুন স্কুল প্রথম স্থাপিত হয় তখন ছাত্রী। পাওয়া কঠিন হইল। তখন পিতৃদেব আমাকে এবং আমার খুড়তুত ভগিনীকে সেখানে পাঠাইয়া দেন। হরদেব চাটুজ্জ্যেমশায় আমার পিতার বড় অনুগত ছিলেন, তিনিও তাহার দুই মেয়েকে সেখানে নিযুক্ত করিলেন। ইহা ছাড়া মদনমোহন তর্কালংকার মহাশয় ও তাঁহার কয়েকটি মেয়েকে বেথুন স্কুলে পড়িতে পাঠাইয়া দেন। এইরূপে অল্প কয়েকটি মাত্র ছাত্রী লইয়া বেথুন স্কুলের কাজ। আরম্ভ হয়।
এ যেন শুধুই খবর। তফাৎ এই যে, এ কথা তৃতীয় ব্যক্তির রিপোর্ট না হয়ে বেথুনের একেবারে প্রথম দিকের একটি ছাত্রীর লেখা নিজের কথা। অথচ সৌদামিনী কত খবরই না দিতে পারতেন। বেথুনে-পড়া মেয়েদের নিয়ে তো কম ছড়া আর প্রহসন লেখা হয়নি। বলাবাহুল্য সৌদামিনীকেও কতকটা বিরুদ্ধ আবহাওয়ার মধ্যে দিয়েই এগোতে হয়েছে। যেমন হায়-হায় করে উঠলেন গুপ্ত কবি যত ছুড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে। তখন এ. বি. শিখে বিবি সেজে বিলাতি বোল কবেই কবে। যদিও ঈশ্বর গুপ্ত স্ত্রীশিক্ষা বিরোধী ছিলেন না বরং উৎসাহীই ছিলেন বলা চলে। লেখা শুরু হল বেথুনে-পড়া। অতএব বিপথগামিনীদের নিয়ে নানারকম প্রহসন—স্বাধীন জেনানা, বৌবাবু, পাশ করা মাগ, শিক্ষিত বউ, মাগ-মুখো ছেলে, শ্ৰীযুক্তা বৌবিবি, পাশ-করা আদুরে বৌ, কলির মেয়ে ও নব্যবাবু, বরবদল, পণ্ডিত মেয়ে, ফচকে ছুঁড়ির কীর্তিকাণ্ড, হুড়কো বৌ-এর বিষমজ্বালা, কলির বৌ হাড়-জ্বালানী, মাগসর্বস্ব, বেহদ্দ বেহায়া, মেয়েছেলের লেখাপড়া আপনা হতে ডুবে মরা—নামের শেষ আছে! বিষয়বস্তু সবারই এক, বক্তব্যও একটাই, গেল গেল সব গেল। সব লেখা হয়েছে পঞ্চাশ বছর পরে। এমন কি বিশশতকের গোড়ার দিকেও। সৌদামিনী যে এই জাতীয় সামাজিক বাদানুবাদের খবর রাখতেন না তা নয়। তাঁর লেখা থেকেই জানতে পারি জোড়াসকোয় মহর্ষিভবনের কম্পাউণ্ডের ওপারেই ছিল দেবেন্দ্রনাথের পিসতুত ভাই চন্দ্রবাবুর বাড়ি। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা খোলা ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখে তিনি একদিন এসে বললেন, দেখ দেবেন্দ্র, তোমার বাড়ির মেয়েরা বাহিরে, খোলা ছাতে বেড়ার আমরা দেখতে পাই, আমাদের লজ্জা করে। তুমি শাসন করিয়া দাও না কেন? সৌদামিনী জানিয়েছেন, আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল ছেলেরা বিজয়ার দিনে নৃতন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে চলিত—আমরা মেয়ের। সেইদিন তেতলার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম, তখন বংসরের মধ্যে সেই একদিন আমরা তেতলার ছাদে উঠিবার স্বাধীনতা পাইতাম। উদারপন্থী দেবেন্দ্রনাথ এর মধ্যে কোন দোষ দেখতে পাননি, তার চেয়েও বড় কথা তিনি বুঝেছিলেন দিন-বদলের পালা শুরু হয়েছে। তাই হেসে বলেছেন, আমি আর কিসের বাধা দিব। যাহার রাজ্য তিনিই সমস্ত ঠিক করিয়া লইবেন।
তবে সৌদামিনীর পিতৃস্মৃতি পড়ে দেবেন্দ্রনাথকে নব্যপন্থী ভাবলে ভুল করা হবে। যতক্ষণ না ছেলেমেয়েরা মন্দের দিকে যাচ্ছে ততক্ষণ কিছু বলতেন না। হিন্দু সমাজের বহু সংস্কার তিনি ব্রাহ্ম হয়ে ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। বিধবা বিবাহ, অসবর্ণ বিবাহ, মেয়েদের অবাধ স্বাধীনতা কোনটাই তার সমর্থন পায়নি। আবার পারিবারিক প্রথা বা স্ত্রী-আচরাকে নির্মূল করার জন্যেও তার কোন আগ্রহ ছিল না। কারণ তিনি জানতেন, এই সব তুচ্ছ প্রথা আর আচারের তলা দিয়ে বয়ে চলেছে বাঙালীর নিজস্ব প্রাণধারা, ওপর থেকে টান দিলে তার মূল যাবে ছিঁড়ে, রস যাবে শুকিয়ে। তখনকার পরিস্থিতিতে স্থির মস্তিষ্কে এই ধরনের চিন্তা করে দুটো বিপরীতমুখী স্রোতের মধ্যে দিয়ে সংসার তরণীখানিকে পার করে নিয়ে যাওয়াই ছিল অসাধারণ কৃতিত্বের কথা। সুখের বিষয়, দেবেন্দ্রজীবনের অনেক অন্তরঙ্গ ছবিই আমরা সৌদামিনীর প্রবন্ধ থেকে পেতে পারি। যেমন পিতৃঋণ শোধ করার পরে দেবেন্দ্রনাথ সামান্যতম ঋণকেও ভয় করতেন। সৌদামিনী তাঁর পিতৃস্মৃতিতে লিখেছেন :
তিনি সামান্য পরিমাণ দেনাকেও অত্যন্ত ভয় করিতেন। তাঁহার ছেলের কেহ ঋণ করিয়া তাহাকে সাহায্যের জন্য ধরিলে তিনি বলিতেন, আমি কি চিরদিন কেবল ঋণ শোধই করিব? মহর্ষির ব্যয় সংকোচের কথাও আছে, তিনি একবারে চারি আনা মূল্যের অধিক সামগ্রী আহার করিতেন না। যাহার পিতার ডিনার তিন শত টাকার কমে হইত না। তিনি চারি আনা মূল্যের ডিনার খাইয়া তৃপ্ত হইতেন।…সমস্ত গাড়িঘোড়া বিক্রয় করিয়া ফেলিলেন, কেবল বাটির মহিলাদিগের যাতায়াতের জন্ঠ একটিমাত্র পালকি রাখিলেন। সৌদামিনী না জানালে এর অনেক কথাই জানা যেত না কোনদিন।
সৌদামিনীর ছোট বোনেদের মধ্যে সুকুমারী অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও তার দিদির মতো একটি ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে নিজে কোন ভূমিকা না নিয়েও জড়িয়ে পড়েছেন। দেবেন্দ্রনাথ সুকুমারীর বিয়ে দিয়েছিলেন ব্রাহ্মধর্ম অনুসারে অর্থাৎ বিবাহ অনুষ্ঠানে শালগ্রাম শিলা বর্জন করে। তখনও ব্রাহ্মবিবাহ আইন প্রচলিত হয়নি। সুকুমারীর বিয়েই প্রথম ব্রাহ্মবিবাহ। এই বিয়ে হয় ১৮৬১ সালের ২৬শে জুলাই। তার আগে ব্রাহ্মদের গার্হস্থ্য জীবনের কোন কাজে স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান পদ্ধতি প্রস্তুত করা হত না। এই বিয়ে নিয়ে প্রচণ্ড আলোড়ন শুরু হয়। অনেকে এ বিয়েকে অসিদ্ধ বলে মনে করতেন। এভাবে মেয়ের বিয়ে দেওয়া এবং হিন্দুমতে পিতৃশ্রাদ্ধ না করায় দেবেন্দ্রনাথ তার আত্মীয়-পরিজনদের কাছ থেকে আরোই দূরে সরে গেলেন।