তুলনামূলকভাবে কলকাতার অবস্থা বেশ ভাল। সেখানে পালা করে বৈষ্ণবী এসে লেখাপড়া শেখাত। কিছুদিন পরে বৈষ্ণবীর স্থান গ্রহণ করে ইংরেজ গৃহশিক্ষিকারা। রাজা নবকৃষ্ণ, রাধাকান্ত দেববাহাদুর, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা বৈদ্যনাথ রায় নিজেদের অন্তঃপুরে লেখাপড়া শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। তবে সে শিক্ষা নিভৃতে, অন্তরালে। প্রসন্নকুমারের মেয়ে হরসুন্দরী ও পুত্রবধূ বালাসুন্দরী নানা বিদ্যায় পারদর্শিনী হয়ে ওঠেন। অকালমৃত্যু না হলে হয়ত জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের স্ত্রী বালাসুন্দরীই বাংলা দেশে স্ত্রী-স্বাধীনতার সূচনা করে যেতেন। বৈদ্যনাথ রায়ের স্ত্রীকে পড়াতে সেন্ট্রাল ফিমেল স্কুলের মিসেস উইলসন। ঠাকুরবাড়িতেও বিদেশিনী শিক্ষয়িত্ৰী মিস গোমিস এসেছিলেন, কিন্তু বাড়ির মধ্যে এ ধরনের শিক্ষয়িত্ৰী রাখার মধ্যে বিশেষ সাহসের কিছু ছিল না।
এ সময় তোড়জোড় চলছিল মেয়েদের জন্যে একটা ভাল স্কুল খোলার। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছাড়াও এ ব্যাপারে উৎসাহ ছিল রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, মদনমোহন তর্কালংকার, ও আরো অনেকের। তাঁরা মেয়েদের জন্য স্কুল খোলার পক্ষপাতী ছিলেন। বাধা এসেছিল প্রচণ্ডভাবে। এই গেল গেল রবের মধ্যেই স্থাপিত হয়েছিল বেথুন স্কুল। অবশ্য প্রথমে স্কুলের নাম ছিল হিন্দু ফিমেল স্কুল। দেশীয় পণ্ডিতদের সাহায্যে স্কুলটি স্থাপন করেন ভারতহিতৈষী জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বীটন। স্কুলটি প্রথমে খোলা হয়েছিল রাজা দক্ষিণারঞ্জনের সুখিয়া টীটের বাড়ির বৈঠকখানায়। এই স্কুলেই পড়তে এসেছিলেন পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়ে সৌদামিনী। সেটা ১৮৫১ সাল। তার দু বছর আগে ১৮৪৯ সালের সাতই মে হিন্দু ফিমেল স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমরা আশা করতে পারি ঠাকুরবাড়ির কোন মেয়ে তার প্রথম ছাত্রী হবেন। তা কিন্তু হয়নি। এই স্কুলের প্রথম দুটি ছাত্রী মদনমোহন তর্কালংকারের দুই মেয়ে কুন্দমাল ও ভুবনমালা। মেয়েদের স্কুলে পাঠাবার জন্যে তাঁকে নিজের গ্রামে সমাজচ্যুত হতে হয়। ঐ দুজনের সঙ্গে আরো উনিশটি মেয়ে স্কুলে ভর্তি হন।
কিন্তু সামাজিক ঝড় উঠতে দেরি হল না। এসব ঝড় তোলে খবরের কাগজেরা। সমাচার চন্দ্রিকা নানারকম ওজর আপত্তি তুলেছিল। সরলমতি বালিকাদের স্কুলে পাঠানো উচিত নয়, তাতে ব্যভিচার সংঘটনের শংকা আছে। কামাতুর পুরুষেরা সুযোগ পেলেই তাহাদিগকে বলাৎকার করিবে, অল্পবয়স্ক বলিয়া ছাড়িয়া দিবে না, কারণ খাদ্যখাদক সম্বন্ধ। অথচ হিন্দু ফিমেল স্কুলের গেও মেয়েদের স্কুল ছিল। ১৮১৯ সালের মে-জুন নাগাদ খোলা হয় জুভেনাইল স্কুল। প্রথমে ছাত্রী ছিল আটটি, পরে দাঁড়ায় বত্রিশটিতে! পরে ভিজ সোসাইটি অনেক কাজ করে। ১৮২১-এ মেরী এ্যান কুক কলকাতায় এসে কতকগুলো অবৈতনিক স্কুল খোলেন। একবছরের মধ্যেই তিনশো মেয়ে লেখাপড়া শুরু করে। ১৮৭২-এ এই সংখ্যা দাঁড়ায় ছশোতে। শ্রীরামপুর, ঢাকা, বীরভূম, চট্টগ্রামেও মেয়েদের স্কুল খোলা হল। ১৮৪৭ সালে প্রথম হিন্দু ছাত্রীদের জন্যে খোলা হয় একটি স্কুল, কলকাতার কাছেই বারাসতে। তবু নতুন স্কুলটি নিয়ে যথেষ্ট হৈ চৈ হল। এমন কথাও লেখা হল যে, যারা ঐ স্কুলে মেয়েদের পড়তে পাঠাচ্ছেন তাঁরা মান্য ও পবিত্র হিন্দু কুলোদ্ভব নাও হতে পারেন। দেখতে দেখতে বেথুনের ছাত্রী সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়াল সাতটিতে। বিপক্ষদলও চুপ করে ছিলেন না এমনকি সংবাদ প্রভাকর পর্যন্ত এসব উক্তির প্রতিবাদ জানাল। কে মান্য আর কে মান্য নন সে নিয়েও তর্ক চলতে লাগল, তবু কাগজের তর্কাতর্কি এক জিনিষ আর বাস্তবে ঘটে আর এক জিনিষ। ধনীমানী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা ইতস্ততঃ করতে লাগলেন। দু-একটা উদাহরণের প্রয়োজন হলে ডাক পড়ল সৌদামিনীর। পাঁচ বছরের সুন্দর ফুটফুটে মেয়েটি পেশোয়াজ পরে খুড়তুত বোন কুমুদিনীর সঙ্গে স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি হল। দেবেন্দ্রনাথ সৌদামিনীকে স্কুলে পাঠালেন শুধু দৃষ্টান্ত দেখাবার জন্যে। তিনি জানতেন তার দেখাদেখি আরো অনেকে নিজের মেয়েদের স্কুলে পাঠাবেন। তার অনুমানে ভুল হয়নি। ১৮৫১ সালের জুলাই মাসে সৌদামিনী স্কুলে ভতি হলেন বাঙালী মেয়েদের পড়াশোনার পথ সহজ করে দেবার জন্য। বিপত্তি? হ্যাঁ, তাকে নিয়েও বিপদ হয়েছিল বৈকি। তার ধবধবে ফর্সা শ্বেত পাথরের মতো গায়ের রঙ দেখে একবার পুলিশ এসে ধরেছিল চুরি-করা ইংরেজ মেয়ে ভেবে।
সৌদামিনীর লেখাপড়া ঠিক কতটা এগিয়েছিল জানা যায়নি। মহর্ষি পরিবারে তিনি ছিলেন গৃহরক্ষিতা অর্থাৎ গৃহের রক্ষয়িত্ৰী। সমস্ত কিছু দেখাশোনা করে তার হাতে সময় থাকত কম। শুধু কি দেখাশোনা? বোনেরা কোথাও যাবে, তাদের নিখুত করে চুল বেঁধে দিতে হবে। বাড়িতে কোন উৎসব হবে, সুন্দর করে ফুল কেটে আলপনা দিতে হবে। সব দিকে মহর্ষির সতর্ক দৃষ্টি। তাই বিশাল পরিবারের আদর্শ গৃহিণী হয়ে সৌদামিনী অন্যদিকে নজর দিতে পারতেন না। তার নিজের লেখা বলতে দু-একটি ব্ৰহ্মসঙ্গীত আর একটি মাত্র স্মৃতিকথা পিতৃস্মৃতি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। তোমারে পূজিব অকিঞ্চন গানটি হয়ত অনেকেই শুনেছেন। পিতৃস্মৃতিও দুষ্প্রাপ্য নয়। পড়ে মনে হয়, ইচ্ছে করলে সৌদামিনী আরও অনেক কিছুই দিতে পারতেন কিন্তু দিয়েছেন শুধুমাত্র কয়েকটি সেকেলে ছবির টুকরো। বেথুনে পড়ার কথাই যারা যাক না। সৌদামিনী লিখেছেন :