সারদা এবং যোগমায়ার প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বলা চলে যে তারা কিছু লেখাপড়া শিখেছিলেন। মনে হয়, তখনও ধনী সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা নিয়মিত লেখাপড়া শিখতেন। মাইনে-করা বৈষ্ণবী এসে শিশুবোধক, চাণক্যশ্লোক, রামায়ণ, মহাভারত পড়াত। আর কলাপাতায় চিঠি লৈখা মকস করাত। এ নিয়ম যে শুধু ঠাকুরবাড়িতে ছিল তা নয়, অনেক বাড়িতে ছিল। সারদা এবং যোগমায়াও পড়তে পারতেন, শুধু তারা নন, বাড়ির অন্যান্য মেয়েরাও লেখাপড়া জানতেন। বই পড়লে বিধবা হবার ভয় কোনদিনই তাদের ছিল না। সম্ভবতঃ গ্রামাঞ্চলে এই জাতীয় বিধিনেষেধ চলত।
সারদা অবসর সময়ে প্রায়ই একটা না একটা বই খুলে বসতেন। সংস্কৃত রামায়ণ, মহাভারত পড়ে শোনাবার জন্যে মাঝে মাঝে ডাক পড়ত ছেলেদের। হাতের কাছে অন্য কোন বই না থাকলে অভিধানখানাইখুলে বসতেন। যোগমায়াও নানারকম বই পড়তেন। মালিনী আসত বটতলা থেকে ছাপা বইয়ের পসরা নিয়ে। সেখান থেকে বেছে বেছে বই কিনতেন মেয়েরা। নরনারী, লয়লা-মজনু, হাতিমতাই, আরব্য রজনী, লাম্বল টেল, পাল ও বর্জিনিয়া—সবই জোগাড় করেছিলেন যোগমায়। তার স্বামীর লেখা কাব্যোপন্যাস কামিনীকুমারও থাকত মালিনীর পসরায়। আর থাকত মানভঞ্জন, প্রভাস-মিলন, কোকিল দূত, অন্নদামঙ্গল, রতিবিলাপ, বস্ত্রহরণ, গীতগোবিন্দ, গোলেবকাওলী, বাসবদত্তার মতো কিছু বই। যোগমায়া বেশ ভালই বাংলা জানতেন। সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায় তিনি ছিলেন আমাদের একপ্রকার শিক্ষয়িত্ৰী।
সারদা এবং যোগমায়া দুজনের কথাই জানতে ইচ্ছে করে কিন্তু জানার খুব সুবিধে নেই। ধর্মশীলা বৌদুটির জীবন বয়েছিল দুটি খাতে। সরলপ্রাণ। কামদয়া সারদা মহর্ষি স্বামীর সহধর্মিণী হবারই চেষ্টা করেছিলেন যদিও এ পর্মের প্রতি তার কোন আকর্ষণ বা আসক্তি ছিল বলে মনে হয় না। আমরা
কে যে রূপে দেখি সেটি সতী-সাধ্বী পতিব্রতার সনাতন রূপ। দেবেন্দ্রনাথের জন্যে তার ভাবনার সীমা ছিল না। একবার শ্রাবণ মাসের ভরা বর্ষায় তিনি গঙ্গাভ্রমণে বেরোলে কঁদতে কাঁদতে সারদাও ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গী হয়েছিলেন, আমাকে ছাড়িয়া কোথায় যাইবে? যদি যাইতেই হয়, তবে আমাকে সঙ্গে করিয়া নাও। হিমালয়ে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে চিঠি লেখানোর ঘটনাটি তো সবাই জানে। স্বামীর মঙ্গলের জন্যে ব্রহ্মোপাসনা এবং হিন্দুমতে পূজার্চন কোনটিতেই তার কিছুমাত্র আপত্তি ছিল না।
জ্ঞানদানন্দিনীর পুরাতনী কথা পড়ে আরো জানা যায় সারদা বেশি নড়াচড়া করতে পারতেন না। সংসারের নিত্যকাজ দেখাশোনা করবার প্রয়োজনও হত না। একখানি তক্তপোষের ওপর তিনি বসে থাকতেন আর দাসীরা ছেলের বৌয়েদের রূপটান মাখাত তার সামনে বসে। শুধু দেবেন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরলে সারদা নিজে রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাকতেন। জ্ঞানদানন্দিনী বলেছেন, আমার। মনে পড়ে বাবামশায় যখন বাড়ি থাকতেন আমার শাশুড়িকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে। আর মা একখানি পোয়া সুতি শাড়ি পরতেন, তারপর একটু আতর মাখতেন। এই ছিল তার রাত্রের সাজ।
সত্যি কথা বলতে কি, ঠাকুরবাড়িতে সারদার ছবিটি খুব স্পষ্ট নয় কিন্তু বড় স্নিগ্ধ। ভাবতে ভাল লাগে, তিন তলায় পঙ্খের কাজ-কর একটি ঘরে, মেঝেতে কার্পেট পাতা, সেই ঘরে বসে আছেন সারদা বালুচর শাড়ি পরে। ঘরের কোণে জ্বলছে একটি প্রদীপ, সেই আলোয় জ্বলজ্বল করছে সাদা চুলের মাঝে টকটকে লাল সিঁদুর। কত লোক আসছে যাচ্ছে, প্রশংসা করছে তাঁর জ্ঞানী গুণী ছেলেমেয়েদের, মায়ের লজ্জারুণ মুখে গভীর সুখের আবেশ—কিন্তু পাছে কেউ দেখে, দেখে ভাবে গরবিণী, তাই ছেলেমেয়েদের প্রশংসা শুনলেই মাথাটি নীচু করে নিচ্ছেন কুণ্ঠাভরে।
যোগময়ার ছবিটিও কম সুন্দর নয়। তাঁকে আমরা শুধু পুরনো কথার মধ্য দিয়ে পেয়েছি। তার গায়ের রঙ ছিল সোনার মতো আর পাশ দিয়ে। চলে গেলে গা দিয়ে যেন পদ্ম গন্ধ ছড়াত। দেবেন্দ্রনাথ ব্ৰাহ্মধর্ম গ্রহণ করার পরে বাড়িতে লক্ষ্মীজনার্দনের নিত্য পূজা বন্ধ করতে উদ্যত হলে যোগমায়া চাইলেন গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনকে। তাই হল। যোগমায়া দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে উঠে গেলেন দ্বারকানাথের বৈঠকখানাবাড়িতে। সেই থেকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দুটি বাড়িতে পরিণত হয়; তবে দুই বাড়ির পুরুষদের মধ্যে মতের অমিল বা মনের অমিল কখনো হয়নি। এই ঘটনার পর দুই পরিবারের মেয়েদের গতিবিধি অবশ্য স্বাভাবিক রইল না, শুধু পলাপার্বণে দেখাসাক্ষাৎ ঘটত।
০২. যোগমায়ার সঙ্গে
যোগমায়ার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ায় মহর্ষির ছেলেমেয়েরা খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। বড় মেয়ে সৌদামিনীর দুঃখই যেন বেশি। তিনি স্বামী পুত্র কন্যা নিয়ে জোড়া কোর বাড়িতেই জীবন কাটিয়েছেন। কাকীমা ছিলেন তার সুখ-দুঃখের সঙ্গিনী। এবার মহর্ষিপরিবারের সব ভার পড়ল একা সৌদামিনীর ওপর। বাংলা দেশে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের একেবারে গোড়ার দিকে সৌদামিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন যদিও এর জন্যে তাঁর নিজের কৃতিত্ব খুব বেশি ছিল না।
আগেই বলেছি, ঠাকুরবাড়ি এবং আরও পাঁচটা সম্ভ্রান্ত পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো হত। গ্রামাঞ্চলে সে সুযোগ ছিল না। দু-একজন দুঃসাহসিকা ছাড়া কেউ সাহস করে পুঁথিপত্র নিয়ে বসতে পারত নাকি? মনে তো হয় না। সুদূর পল্লী গ্রামের গৃহবধূ রাসসুন্দরী একটু-আধটু লেখাপড়া শিখেছিলেন। তিনি ঠাকুরবাড়ির কেউ নন, এমনকি এই পরিবারের সংস্পর্শেও আসেননি তবু বাঙালী মেয়েদের মধ্যে তিনিই লিখেছিলেন প্রথম আত্মজীবনী। এই প্রথম নিজের কথা লেখার মতো বিশেষ ঘটনাটি আমরা ঠাকুরবাড়িরই কোন মহিলার কাছে আশা করেছিলুম। যাইহোক, রাসসুন্দরীর পক্ষে লেখাপড়া শেখা সহজ ছিল না, ঘরের দরজা বন্ধ করে শিখতে হত। না হলে শোনা যেত বৃদ্ধদের খেদোক্তি, বুঝি কলিকাল উপস্থিত হইয়াছে দেখিতে পাই। এখন বুঝি মেয়েছেলেতে পুরুষের কাজ করিবেক। এতকাল ইহা ছিল না। একালে হইয়াছে। এখন মাগের নামডাক। মিনসে জড়ভরত। এই তিক্ত মন্তব্য শুনতে শুনতে রাসসুন্দরীর মনে হত, যেন বিদ্যার আর কোন গুণ নাই, বিদ্যায় কেবল টাকা উপার্জন হয়। রাসসুন্দরীর মতো লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হয়েছে সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর মাকেও। তিনি রাত্রিবেলা দরজা বন্ধ করে হিসেব কিতেব চিঠিপত্র লিখতেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর মা গোলকমণি দেবীও নানা উপায়ে লেখাপড়া শিখেছিলেন। পাবনার প্রমথ চৌধুরীর দিদি প্রসন্নময়ী তো ছোটবেলায় বালকবেশে কাছারি বাড়িতে সরকারের কাছে পড়তে যেতেন। তার পিসীদের মধ্যে তিনজন ভগবতী, কৃষ্ণসুন্দরী ও মৃন্ময়ী বেশ লিখতে পড়তে পারতেন কিন্তু ছোট পিসী বালবিধবা কাশীশ্বরী ছিলেন পণ্ডিত মহিলা। ছোট ছেলেমেয়েরা তার কাছে লেখাপড়া শিখতে যেত। প্রসন্নময়ী লিখেছেন, কাশীশ্বরী তীর্থ ভ্রমণ করিয়া হঠি তর্কালঙ্কার সাজিয়া মুণ্ডিত মস্তকে গ্রামে ফিরিয়া আসিয়া এক পাঠশালা খুলিয়া বসিলেন। এ প্রসঙ্গে হটি বিদ্যালঙ্কার, হটু বিদ্যালঙ্কার কিংবা চণ্ডীচরণ তর্কালঙ্কারের মেয়ে দেবময়ীর কথাও স্মরণীয়। কিন্তু এদের ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরা হত। বেশির ভাগ মেয়েই লেখাপড়ার সুযোগ পেতেন না।