সেযুগে ঠাকুরবাড়ির মতো ধনী এবং অভিজাত বাড়ি বা পরিবার আরো অনেক ছিল। খুব কম করেও আমরা আরো ত্রিশটি পরিবারের উল্লেখ করতে পারি যারা ধনে-মানে ঠাকুরবংশের চেয়ে কোন অংশে হীন তো ছিলেনই না বরং আরো খ্যাতি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীকালে এইসব পরিবারও নানাভাবে শিল্পরুচি কিংবা প্রতিপত্তির পরিচয় দিয়েছেন। তবু এতগুলি বাড়ির মধ্যে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বেছে নেবার প্রধান কারণ প্রথম পর্বে এই বাড়িই ছিল সবার পুনরাবর্তিনী। অবশ্য পাথুরেঘাটা-ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বৌরাও যে ছিলেন তা নয় কিন্তু তারা স্থায়ী প্রভাব রেখে যেতে পারেননি।
ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মধ্যে স্বর্ণকুমারী ও জ্ঞানদানন্দিনীর নাম সকলেই জানে। তবু ইতিহাসেরও ইতিহাস থাকে, তাই তাদের পিতামহী দিগম্বরীকেও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। সূর্যোদয়ের অনেক আগে যেমন উষার আলো ফুটে ওঠে, দিগম্বরীর ধর্মনিষ্ঠা এবং নির্ভীক তেজস্বিতার মধ্যেও তেমনি ঠাকুরবাড়ির নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার ছাপটুকু চোখে পড়ে। যে যুগে মেয়েদের স্বামী বই গতি ছিল না সেই সময়ে দিগম্বরী কুলধর্মত্যাগী স্বামীকে ত্যাগ করা উচিত কি উচিত নয় জানতে চেয়েছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সমাজের কাছে। সেই পুরুষশাসিত সমাজে তার একক প্রতিবাদ—তবু তিনি নিন্দায় জর্জরিত হননি। বরং হিন্দুসমাজ তাকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিল।
কিন্তু তিনিই বা হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞদের কাছে এমন একটা বিধান জানতে চেয়েছিলেন কেন? তিনি কি মুক্তি চেয়েছিলেন সাত-পাকে-বাঁধা বিবাহ বন্ধন থেকে, না, স্বামীর অবহেলা তার তীব্র অভিমানকে বড় বেশি আঘাত করেছিল? এই কেনর উত্তর খুঁজতে হলে বাস্তবে-অবাস্তবে মেশা দিগম্বরীর অলৌকিক জীবনের কথা জানতে হয়।
লোকে বলে, অপরূপ লাবণ্যময়ী দিগম্বরী এসেছিলেন ঠাকুরবাড়ির লক্ষ্মী হয়ে। যশোরের নরেন্দ্রপুরে তার জন্ম। মাত্র ছ বছর বয়সে দ্বারকানাথের ধর্মপত্নী হয়ে তিনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে পা দিলে ঠাকুরবাড়ির শ্রীবৃদ্ধি হতে শুরু করে। দিগম্বরীর রূপ এখন প্রবাদে পরিণত হয়েছে। বোধহয় তখন থেকেই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের রূপের খ্যাতি। শোনা যায়, দিগম্বরীর মুখের আদলেই ঠাকুরবাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমা গড়া হত। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে বলতেন, সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী। বলবে নাই বা কেন? দুধে-আলতা মেশা গায়ের উজ্জ্বল রঙ, পিঠে একটাল কোঁকড়া কালো চুল, চাপাকলির মতো হাতের আঙুল, দেবী প্রতিমার পায়ের মতো দুখানি পা—মৃত্যুর পরে তাকে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় অনেকে তার পা দুটি থেকে এক অপূর্ব জ্যোতি বেরোতে দেখেছিল। অতুলনীয় রূপের সঙ্গে দিগম্বরীর ছিল প্রচণ্ড তেজ। শাশুড়ী অলকাসুন্দরীও এই ব্যক্তিত্বময়ী বৌটিকে সমীহ করে চলতেন।
আর দ্বারকানাথ?
স্ত্রীকে তিনি সত্যিই ভালবাসতেন। কিন্তু এ তো গল্প। গল্পই তো। গল্পই তো জীবন। তারই টানাপোড়েনে বোনা হয়েছে অন্দরমহলের বালুচরী আঁচলার নকশা, গৌরবময় নারীজাগরণের ইতিহাস।
তখনকার দিনে এঁরা ছিলেন গোঁড়া বৈষ্ণব। পাথুরেঘাটার ঠাকুররা ব্যঙ্গ করে বলতেন মেছুয়াবাজারের গোঁড়া। পেঁয়াজ ঢুকত না বাড়িতে। মাছ-মাংসের তো কথাই নেই। পাছে কুটনো-কোটা বললে হিংস্র মনোভাব জেগে ওঠে তাই বলা হত তরকারি বানানো। গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনের নিত্যসেবা নিজের হাতে করতেন দ্বারকানাথ। পুজোর উপকরণ হয়ত যুগিয়ে দিতেন দিগম্বরী। নীলাম্বরী শাড়ির আঁচল-ঘেরা দুধে-আলতা মেশা সুন্দর মুখে ভক্তির আবেশ মাখা —যে দেখত শ্রদ্ধায় আপনিই নুয়ে পড়ত। না, সেদিন কোথাও বিরোধের কালো মেঘ বাষ্প হয়েও দেখা দেয়নি।
হঠাৎ ঝড় উঠল, কেঁপে উঠল যুগলের সংসার। ফাটল ধরল সনাতন হিন্দুয়ানীর ভিতে। মা লক্ষ্মীর পদ্মের অনেকগুলো পাপড়ি উড়ে এসে পড়ল দ্বারকানাথের ঘরে। আর ব্যবসায়িক সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে বিলাসিতা ও বাবুয়ানীর ছদ্মবেশ পরে নবযুগের ভাবনা বাসা বাঁধলে দ্বারকানাথের মনে। হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বিধর্মীর সংস্পর্শে এলে দেহ অপবিত্র হয়। সেই নিয়ম অনুযায়ী দ্বারকানাথ যখন সাহেববোর সঙ্গে মেলামেশা শুরু করলেন তখন থেকে তাঁকে নিজের হাতে পুজো-করা ছাড়তে হল। নিত্য পূজা ও অন্যান্য ক্রিয়াকর্মের জন্যে তিনি আঠারজন শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণকে মাইনে দিয়ে সেই কাজে নিযুক্ত করলেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজে এর পরে ব্যবসায়িক কাজকর্মের প্রয়োজনে মাংস এবং শেরি খাওয়া অভ্যাস করলেন। দিগম্বরী ও দ্বারকানাথ বয়ে চললেন ভিন্ন খাতে।
প্রথম প্রথম দ্বারকানাথ বেপরোয়া খুশির প্রমোদে গা ঢেলে দেননি। যদিও উ এটি ছিল সেযুগের বিলাসী বাবুদের মতোই দিলদরিয়া। সেই সঙ্গে ছিল শিল্পরুচি। তাঁর বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে ছিল নানারকম প্রমোদের আয়োজন। এক প্রহরের আমোদে কত যে ঐশ্বর্য নষ্ট হয়েছে তার সীমা নেই। নিজের মনের মতো জীবন-যাপন করবার জন্যে বাগানবাড়িটি তৈরি করেছিলেন দ্বারকানাথ। কী তার কারুকাজ। ফোয়ারা, সেতু, রঙিন টালি-ঘেরা বাগান, ঝাড়লণ্ঠন, বিলিতি আসবাবে নিজের রুচিমতো সাজালেন। তাঁর নতুন গৃহসঞ্চার-এর কথা ঘটাপটা করে ছাপাও হল সেদিনকার কাগজে। প্রকাণ্ড ভোজ, নাচ-গান, বিলিতি ব্যাণ্ডের সঙ্গে ভাঁড়ের সং-এরও আয়োজন হয়েছিল, আর মধ্যে একজন গোবেশ ধারণপূর্বক ঘাস চর্বণাদি করিল। সুতরাং দ্বারকানাথের বিলাসিতায় সেযুগের বাবুয়ানীর ছাপ পুরোমাত্রায় বজায় ছিল, তাতে সন্দেহ নেই।