সাহিত্য, সঙ্গীত বা শিল্পের দিক থেকে নতুন কিছু পাবার আগে প্রকৃতপক্ষে বাঙালী মেয়েরা ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের কাছে পেল আত্মবিশ্বাসের শক্তি আর এগিয়ে যাবার একটি প্রশস্ত পথ। তাই তাদের ময়দানে ঘোড়া ছোটানো, কালাপানি পেরিয়ে বিলেত যাওয়া, লাট ভবনের নিমন্ত্রণ রাখা, আমেরিকায় বক্তৃতা দেওয়া, স্কুলে পড়া, ছবি আঁকা, গান গাওয়া, অভিনয় করা, বই লেখা, স্বদেশসেবা, সমিতি-প্রতিষ্ঠা সবই অর্থবহ হয়ে উঠেছে। সমাজের ধীর-স্থির বুকে নানা আকারের আন্দোলন তুলে বাঙালী মেয়েদের লজ্জাভীরু মনে সাহস জোগাবার জন্যেও এর দরকার ছিল। শুধু তাই নয়, কিশোর রবীন্দ্রনাথের জন্যে বাড়ির মধ্যে একটা সাহিত্যিক আবহাওয়া গড়ে তুলতেও তার দিদি-বৌদিদিরা দাদাদের চেয়ে কোন অংশে কম সাহায্য করেননি। আবার পরিণত বয়সে নৃত্য-গীত-অভিনয়সংক্রান্ত নিজস্ব ভাবনাকে রূপায়িত করবার সময়েও তিনি বারবার ডাক দিয়েছেন বাড়ির মেয়েদের। শুধু এই জন্যেও ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের, কখনো কখনো সামান্য ভূমিকা থাকলেও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এ প্রসঙ্গে একটা আশ্চর্য ঘটনা চোখে পড়ে, প্রায় কাকতালীয়ের মতোই ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের পূর্ণ আত্মবিকাশের ক্ষেত্রটা যেন সমস্ত রবীন্দ্রজীবনের সঙ্গে গাঁথা হয়ে গেছে। অথচ রবীন্দ্রনাথ সর্বত্র প্রাধান্য বিস্তার করেছেন তা নয়। স্বর্ণকুমারী-জ্ঞানদানন্দিনীর অভ্যুত্থান পর্বে রবীন্দ্রনাথ কিশোর আর এখনও যারা জাকম্পিত হাতে নিবুনিবু ঐতিহ্য প্রদীপের শিখাটিকে জ্বেলে রেখেছেন তারা পেয়েছেন অস্ত-রবির শেষ আশীর্বাদ!
একটু আগেই বলেছি যে, ঠাকুরবাড়িতে সমাজের প্রত্যক্ষ বাধা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু কী সেই বাধা, যা এবাড়ির মেয়েদের অচল করে তোলেনি? সেকালে মেয়েদের জীবন কেমন করেই-বা কাটত? তখনকার দিনে মেয়েদের জীবন বিশেষ সুখে কাটত না। কয়েকশো বছরের পুথিপ্রমাণ আর দলিল দস্তাবেজের বস্তাপচা পুরনো সাক্ষীসাবুদ জড়ো না করেও এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, আমাদের সমাজে নারীসম্পর্কিত মূল্যবোধের প্রচণ্ড অবনতি হয়েছিল। পুরুষের কাছে সেদিন নারী ছিল জীবন্ত সম্পত্তি, শুধু ভাত-কাপড় দিয়ে পোষা বিনা মাইনের দাসীমাত্র। ইচ্ছের হাড়িকাঠে তাদের যতবার খুশি বলি দেওয়া চলত। সমাজের সমস্ত নিয়ম-শৃংখলা নারীর অঙ্গে পাকে পাকে জড়ানো শৃংখল হয়ে উঠেছিল খুব সহজে, কারণ সকল অনর্থের মূল অর্থ এবং অর্থোপার্জনের যাবতীয় উপায় ছিল পুরুষের হাতে। পিতার ধনে বা পতির ধনেও নারীর অধিকার স্বীকৃত হয়নি। মেয়েদের এই নিরুপায়তায় সুযোগ নিয়েই পুরুষেরা অধিকারের নামে অবাধে স্বেচ্ছাচার করে গেছেন। তাই দেখা যাবে উনিশ শতকে সমাজ সংস্কারের প্রধান কথাই ছিল নারীমুক্তি—আধুনিক অর্থে নয়, তখন নারীশিক্ষা, নারীর অধিকার এবং নারী প্রগতির দিকেই মনীষীদের দৃষ্টি পড়েছিল!
আসলে বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অসমবিবাহ, সতীদাহ প্রভৃতি গোটা কতক বড় বড় সামাজিক অত্যাচার ছাড়াও ছোটখাট অগুণতি বাধা মেয়েদের পায়ে বেড়ির মতো চেপে বসে ছিল। তার মধ্যে লেখাপড়া শেখা, জাম জুতো পরা, বাইরে বেরোনো, গান গাওয়া, গাড়ি চড়া, অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে কথা বলা সবই পড়ে। আজ মনে হয় মেয়েরা তাহলে সারাদিন কী করত? ঘর-সংসার? সে তো এখনও করে। তবে? রাধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাধা নিয়েই কি জীবন কেটে যেত? বইয়ের পাতায় উদাহরণ খুঁজলে দেখা যাবে নিখাদ-নিনাদে একটা কথাই বাজছে, না-না-না। দীনবন্ধুর নীলদর্পণ নাটকের সরলতা বলেছিল, রমণীর মন কাতর হইলে বিনোদনের কিছুমাত্র উপায় নাই কেননা পাঁচজন সঙ্গিনী নিয়ে বাগানে যাওয়া, শহরে বেড়াতে যাওয়া মেয়েদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের জন্যে কলেজ নেই, কাছারি নেই, সভাসমিতি নেই, ব্রাহ্মসমাজ নেই—বলতে গেলে কিছুই নেই। একেবারে নেই-রাজ্যের বাসিন্দাদের দিনগুলো কাটত কেমন করে? খুব যে কষ্ট হত তা নয়, সয়ে গিয়েছিল সবই। হঠাৎ ঠাকুরবাড়ি থেকে বয়ে আসা এক বালক সঞ্জীবনী হাওয়া এসে তাদের দুলিয়ে না দিলে হয়ত আরো অনেকদিন এমনি করেই কাটত, শুধু অবকাশ পেলে মাঝে মাঝে গুমরে উঠত ফাঁকা মন।
তবু খুব নিশ্চিত হতে না পারলেও মনে হয়, মেয়েরা সর্বত্র সমানভাবে নিশ্চেষ্ট জীবন যাপন করছিল না; তা কারুর পক্ষেই সম্ভব নয়, হলে একটিমাত্র বাড়ির মেয়েদের প্রভাবে সার্বিক জাগরণ কিছুতেই সম্ভব হত না। সলতে পাকাবার আয়োজন চলছিল, ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এনে দিলেন নবজাগরণের প্রদীপশিখাটিকে। একটু আগে যে অগুণতি বাধার কথা বললুম তার অনেক গুলোই ঠাকুরবাড়িতে মেনে চলা হত, তবে লেখাপড়া শেখার ব্যাপারে এ বাড়ির কর্তাব্যক্তিরা প্রথম থেকেই উদার ছিলেন। মেয়েদের লেখাপড়া শেখায় কোন বাধা তো দেনইনি বরং উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন। দ্বারকানাথের পিতার আমল থেকেই এ বাড়ির মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে শুরু করে বৈষ্ণবীর কাছে। এর সুফল পাওয়া গেল অচিরেই। এ বাড়ির পুরুষদের মতো মেয়েরাও বাংলাদেশের সমস্ত মেয়ের কাছে আদর্শ হয়ে রইলেন। চিরকালের জন্যে।
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের পূর্বকথা আজ আর কারুর অজানা নেই। রূপকথার মায়াপুরীর মত রহস্যঘেরা বাড়িটি তো বহুদিন ধরেই সমস্ত বাঙালীর কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। পাজি-পুঁথি খুলে হয়ত আজ অনেকেই বলে দিতে পারবেন, সেই কবে পুরুষোত্তমের বংশধর পঞ্চানন এসেছিলেন কলকাতায় ভাগ্য ফেরাতে কিংবা তার নাতি নীলমণি কোন্ শুভক্ষণে কলকাতার এক প্রান্তে বসবাস শুরু করলেন। আমাদের প্রধান লক্ষ্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি। গৃহবিবাদ আর মন-কষাকষির ফলে মৃল কুশারী বা ঠাকুর পরিবার ক্রমেই নানা শরিকে ভাগ হয়ে যেতে শুরু করেছিল বেশ কিছুদিন ধরে। পাকাপোক্তভাব পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে ১৭৮৪ সালের জুন মাস নাগাদ নীলমণি সপরিবারে চলে আসেন জোড়াসাঁকোতে। তখন এ অঞ্চল মেছুয়াবাজার নামে পরিচিত। নীলমণির ভাই দর্পনারায়ণ থেকে গেলেন পাথুরেঘাটায় সাবেকী বাড়িতেই। অবশ্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করে আরো কয়েক বছর পরে, প্রিন্স দ্বারকানাথের আমলে। ঠাকুরবাড়ির ঐশ্বর্য-প্রতিপত্তি-আড়ম্বর-শিল্পরুচি সব কিছুর মূলেই তিনি। অপরিমিত ধনসঞ্চয়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন পুব-পশ্চিমের মিলন ঘটাতে; সফল হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই, না হলে অন্য ধনীদের সম্বন্ধে যেমন বলবীর কিছু। থাকে না, তার সম্বন্ধেও সেইরকম কিছু বলার থাকত না। কিন্তু তার কথা থাক, আমরা অন্দরমহলের কথায় ফিরে আসি।