এই সোনালি-সফল পর্বে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা আবছা পর্দার আড়ালে অস্পষ্ট আভাস হয়ে থাকেননি। নবযুগের ভিত গড়বার কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। কখনও প্রত্যক্ষভাবে আবার কখনও পরোক্ষে—পুরুষের প্রতিভার প্রদীপে তেলসলতে যোগানোর দায়িত্ব নিয়ে। অবশ্য যত সহজে লেখা গেল ঘটনাটা তত সহজে ঘটেনি। মনুর বিধান এবং মুসলমানী আবরু রক্ষার তাগিদ অনেকদিন থেকেই মেয়েদের একেবারে ঘরের আসবাবপত্রে পরিণত করেছিল। ঠাকুরবাড়িতেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। অন্দরমহলে নিঃসম্পর্কিত পুরুষ প্রবেশ করতেন না, বাইরে বেরোতে হলে মেয়েরা চাপতেন ঘেরাটোপ-ঢাকা পালকি। হাতে সোনার কাঁকন, কানে মোটা মাকড়ি, গায়ে লাল রঙের হাতকাঁটা মেরজাই-পরা বেহারার দল কাঁধে করে নিয়ে যেত। সঙ্গে সঙ্গে ছুটত দারোয়ান, হাতে লাঠি নিয়ে। ঘেরাটোপের রঙ দেখে শুধু বোঝা যেত কোন্ বাড়ির পালকি যাচ্ছে। জোড়াসাঁকো-ঠাকুরবাড়ির পালকির ঘেরাটোপ ছিল টকটকে লাল আর পাড়টা গাঢ় হলুদ। পাথুরেঘাটা-ঠাকুরবাড়িরটা ঘোর নীল আর ধবধবে সাদা পাড়। আর পাঁচটা বনেদি বাড়িরও এ রকম পালকি ছিল।
যাক সে কথা, মেয়েরা পালকি তো চাপতেন কিন্তু যেতেন কোথায়? কালেভদ্রে গঙ্গাস্নানে যাবার অনুমতি পেলে বেহারারা তো একেবারে পালকিশুদ্ধ, জলে চুবিয়ে অনত। এটাই ছিল সেকেলে দস্তুর। এছাড়া তারা মাঝে মাঝে যেতেন আত্মীয়-কুটুম্বের বাড়িতে বিয়ে-পৈতে-অন্নপ্রাশন-শ্রাদ্ধের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে। তখন পালকি একেবারে উঠোনে গিয়ে দাঁড়াত। জোভান্সাকোর পাঁচ নম্বর এবং ছ নম্বর বাড়ির মধ্যে দূরত্ব আর কতটুকু, তবু সেখানেও এবাড়ি-বাড়ি যেতে হলে মেয়েদের পালকি চাপতে হত। সুতরাং অসংখ্য বাধা-নিষেধের গণ্ডি পার হয়েই মেয়েদের এমনকি ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের আত্মপ্রকাশ করতে হয়েছিল। সহজে হয়নি। প্রথমদিকে এ বাড়ির মেয়ে এবং বৌয়েদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকজন সাহিত্য ও শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ শক্তির পরিচয় রেখে গিয়েছেন, কিন্তু যাদের নাম বিশেষ ছড়িয়ে পড়েনি, পড়বার কারণও নেই, তাদের ভূমিকাও নেহাত কম ছিল না। চলবার বাধা-পথ তারা পাননি, পথ তাদের তৈরি করে নিতে হয়েছিল। খুব সোজা পথও প্রথম পথিকের কাছে দুর্গম। পরেও সেই ধারাটিকে নিরন্তর রসপুষ্ট করে বাঁচিয়ে রাখা কম কৃতিত্বের কথা নয়। সমাজের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা যে জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে পুরুষের পাশে এসে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস অর্জন করেছিলেন, সেটাই পরম গৌরবের কথা। স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্তরালে লুকিয়ে থাকা হারিয়ে-যাওয়া সেই মেয়েদের নিয়েই তো এ প্রসঙ্গের অবতারণা।
অবশ্য নবজাগরণের অনুকূল হওয়ায় পাল তুলে এগিয়েছিলেন অনেকেই। প্রীশিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার ও আরো অনেকে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ও তার পুত্রদের উৎসাহও কম ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথ বিলেতে বসে বাড়ির সমস্ত কাঠের ঝরকা ভেঙে মেয়েদের স্বাধীনতা দেবার স্বপ্ন দেখতেন। হেমেন্দ্রনাথ বাড়ির মেয়ে-বৌদের নিয়ম করে লেখাপড়া শেখাতেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শোনাতেন দেশবিদেশের ভাল ভাল গল্প। শেখবার। তাগিদ ছিল মেয়েদেরও, নতুন কিছু করার সাহস এবং শক্তিও তাঁদের কম ছিল না।
তবু কেন এই একটি পরিবারের মেয়েরাই এতখানি স্বাধীনতা পেয়েছিলেন? পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচার করে মনে হয়, হিন্দুসমাজের বাধানিষেধ ও তার কড়াকড়ি ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের খুব বেশি অসুবিধেয় ফেলতে পারেনি। কারণ। তৎকালীন হিন্দু ব্রাহ্মণদের চোখে ঠাকুরবাড়ি ছিল পিরালী—খানিকটা একঘরের মতো স্বতন্ত্র। তার ওপর দেবেন্দ্রনাথ ব্ৰাহ্মধর্ম গ্রহণ করলে শাসনের গিট আপনিই শিথিল হয়ে এসেছিল। আমাদের অনুমানের কারণ, প্রায়ই দেখা গেছে পিরালী ব্রাহ্মণের মেয়েকে বিয়ে করার পরে কোন ছেলে আর স্বগৃহে সসম্মানে ফিরে যেতে পারেননি। সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীর বাবা অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায় রাগ করে বাড়ি থেকে চলে এসে ঘটনাচক্রে যশোরের পিরালী রায় বংশের মেয়েকে বিয়ে করেন। তার বাবা বিবাগী সন্তানের খোঁজ করতে করতে এসে যেই শুনলেন তার ছেলের সঙ্গে পিরালী বামুনের মেয়ের বিয়ে হয়েছে অমনি রাগে-দুঃখে ভেঙে পড়ে পৈতে ছিঁড়ে অভিশাপ দিয়ে গেলেন অভয়চরণ নির্বংশ হোক বলে। এমন উদাহরণ আরো আছে। মহর্ষির পঁচি জামাইয়ের মধ্যে চার জন ছিলেন ঘরজামাই। সবাই কুলীনের ছেলে। কিন্তু পিরালী ঘরে বিয়ে করে আর নিজেদের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারেননি। জ্ঞানদানন্দিনী শুনেছিলেন, একজনের বাপ গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ছেলেকে শাপ দিয়েছিলেন। আর যিনি ঘরজামাই হননি অর্থাৎ স্বর্ণকুমারীর স্বামী জানকীনাথ। ঘোষাল, তিনিও পিরালী দেবেন্দ্রনাথের কন্যাকে বিবাহ করে পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার হারিয়েছিলেন সাময়িকভাবে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ের সময়ও দেখা যাবে মহর্ষি লিখছেন, জ্যোতির বিবাহের জন্য একটি কন্যা পাওয়া গিয়াছে এইই ভাগ্য। কেন? না একে ত পিরালী বলিয়া ভিন্ন শ্রেণীর লোকেরা আমাদের সঙ্গে বিবাহেতে যোগ দেয় না তাহাতে আবার ব্রাহ্মধর্ম-অনুষ্ঠান জন্য পিরালীরা আমাদিগকে ভয় করে। অথচ জ্যোতিরিন্দ্রর বিয়ের সময় ধনে মানে শিক্ষায় যোগ্যতায় ঠাকুরবাড়ির সমতুল্য বাড়ি কলকাতায় কটাই-বা ছিল? তাই বলছিলুম, সমাজের অন্যান্য বাধা এ বাড়িতে শেকলের বাঁধন হয়ে ওঠেনি বরং তারই মধ্যে একটু ফাঁক রেখে গেছে। শৈথিল্যের অবকাশে গড়ে উঠেছিল ঠাকুরবাড়ির একেবারে নিজস্ব সংস্কৃতি, সকলের দেখে নকল করা নয়, নিজেরা নতুন কিছু করা।