এখানে জনসমাজে যাহা কিছু সৌভাগ্য, যাহা কিছু উন্নতি, যাহা কিছু সাধু সুন্দর, প্রশংসনীয়—স্ত্রীলোকদের সৌভাগ্যই তাহার মূল।…আমার ইচ্ছা তুমি আমাদের স্ত্রীলোকের দৃষ্টান্তস্বরূপ হইবে কিন্তু তোমার আপনার উপরই তাহার অনেক নির্ভর।
অবশ্য সত্যেন্দ্রর স্বপ্ন সফল হল না সেবারে। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিলেন। সব ইচ্ছে কি পূর্ণ হয়? বাড়ির বৌ রইলেন বাড়ির মধ্যেই। তাঁর পড়াশোনা নতুন করে শুরু হল সেজ দেওর হেমেন্দ্রনাথের কাছে। বাড়ির অন্য মেয়ে-সৌদের সঙ্গে লজ্জায় জড়সড় হয়ে ঘোমটা টেনে বসতেন জ্ঞানদানন্দিনী, হেমেন্দ্রর এক একটা ধমকে চমকে চমকে উঠতেন। এমনি করেই তার পড়া এগোল মাইকেলের মেঘনাদবধ কাব্য পর্যন্ত।
ইতিমধ্যে দেবেন্দ্রনাথ আর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করে ফেললেন। মেয়েদের শিক্ষা ঠিকমতো এগোচ্ছে না দেখে তিনি তাদের পড়াবার জন্যে ব্রাহ্মসমাজের নবীন আচার্য অযোধ্যানাথ পাকড়াশীকে গৃহশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করেন। সেই প্রথম একজন অনাত্মীয় পুরুষ ঠাকুরবাড়ির অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। তিনি বাড়ির ছোট ছোট মেয়ে এবং বৌয়েদের স্কুলপাঠ্য বইলি বেশ যত্ন করে পড়াতেন। এসময় কেশবচন্দ্র সেন কিছুদিন সপরিবারে ঠাকুরবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এভাবে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর পদ্ধতিটি তার খুব ভাল লেগেছিল।
জ্ঞানদানন্দিনীর সাধনার নেপথ্য ইতিহাসটি খুব পরিষ্কার নয়। সবাই জানি, তিনি স্বামীর স্বপ্নকে সফল করেছিলেন। কিন্তু কী সেই স্বপ্ন? মেয়েরা পুরুষের পাশে এসে দাঁড়াবেন শিক্ষায় যোগ্যতায় সমমর্যাদা নিয়ে, এই তো। আজকের দিনে এর গুরুত্ব অনুভব করাও শক্ত। কারণ জ্ঞানদানন্দিনী যা করেছেন তা এমনিতে হয়ত খুব কষ্টকর নয় কিন্তু প্রথম কাজ হিসাবে অসম্ভব রকমের কঠিন। আজ যখন শুনি, তিনি প্রথম বাঙালিনী, যিনি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন তখন সবটাই হাস্যকর বলে মনে হয়। কী এমন শক্ত কাজ? সাহসেরই বা দরকার। কী? এ নিয়ে এত হৈচৈ করারই বা কী আছে? তবু হৈচৈ হয়েছিল।
সত্যেন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফিরলেন। তাঁর কর্মস্থল ঠিক হল মহারাষ্ট্র। এখন, সে যুগের নিয়ম ছিল ছেলেরা চাকরি করতে বাইরে যেত, ছেলের বৌ থাকত শ্বশুরবাড়িতে। সত্যেন্দ্র স্ত্রীকে কর্মস্থলে নিয়ে যাবার জন্যে অনুমতি চাইলেন। তিনি থাকবেন প্রবাসে, আর চার দেয়ালের অন্ধকূপে বন্দিনী হয়ে থাকবেন জ্ঞানদানন্দিনী? তাও কি হয়? অনেক দুঃখ পেয়েছেন তিনি। প্রগতিবাদী ছেলের বদলে তাকেই সহ করতে হয়েছে সমস্ত পারিবারিক অবাঞ্ছিত পরিস্থিতিকে। জ্ঞানদানন্দিনীকে লেখা সত্যেরে দু-একটা চিঠি থেকে আভাস পাওয়া যায় যে তার মায়ের সঙ্গে জ্ঞানদানন্দিনীর সম্পর্ক মাঝে মাঝে তিক্ত হয়ে উঠত। মহর্ষি-পত্নী তার মেজ বৌমাটির সঙ্গে কথাও বন্ধ করে দিতেন। সত্যেন্দ্রনাথের মেয়ে ইন্দিরার অপ্রকাশিত আত্মকথার পাণ্ডুলিপি শ্রুতি ও স্মৃতিতে দেখা যাবে সত্যেন্দ্র বিলেত গিয়েছেন বলে তার মা মেজ বৌয়ের গয়না দিয়ে তাঁর নিজের দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। এই গয়না নেওয়ার প্রকৃত কারণ যাই হক না কেন, মনে হয় অর্থাভাব নয়, কারণ পরে মহর্ষি এ কথা শুনে খুন রাগ করেন ও জ্ঞানদানন্দিনীকে একটি হীরের কন্ঠি গড়িয়ে দেন। অবশ্য জ্ঞানদানন্দিনীর গয়নার ওপর কোন ঝোঁক ছিল না, তিনি শুধু ভালবাসতেন পলার গয়না পরতে। যাক সে কথা। এবার সত্যেন্দ্রর প্রার্থনা মঞ্জুর হল। মহর্ষি বাধা দিলেন না।
আপত্তি অবশ্য উঠেছিল। বাড়ির বৌ বাইরে যাবে কী? কোন বাড়ির বৌ কি গেছে? তা কি কখনো হতে পারে? বাড়ির পুরুষেরাও যে যখন তখন অন্দরমহলে যেতে পারে না। বিয়ের আগে পর্যন্ত বাইরেই থাকে, বিয়ের পর মশন একখানা আলাদা শোবার ঘর হয় তখন রাতে শুতে আসে। নাহলে বহির্জগতের ছোঁয়া-বঁচানো অন্তঃপুরের শুচিতা নষ্ট হবে যে। এই সাবেকী কালের নড়চড় হত না কোন বাড়িতে। ধিক্কারের ঘূর্ণীঝড় উঠল। মা গেকার মতো আরেকবার ধমক লাগালেন ছেলেকে, তুই মেয়েদের নিয়ে মেমেদের মতে গড়ের মাঠে ব্যাড়াতে যাবি নাকি? সত্যেরে মনে হয় কীই-বা এমন ক্ষতি হয় তাতে? এই পর্দা প্রথা আমাদের নিজস্ব নয়, মুসলমানী রীতির অনুকরণ। তাছাড়া ঠাকুরবাড়িতে কয়েদখানার মতো নবাবী বন্দোবস্তের দরকারই বা কী?
তাঁর এসব ভাল লাগে না। লাগে না বলেই তো কয়েক বছর আগে সেই হাস্যকর-হালকা অথচ দুঃসাহসিক কাজটি করতে পেরেছিলেন। এখন ভাবলেও হাসি পায়। বিয়ের কিছুদিন পরের কথা। সত্যেন্দ্রের তখন অল্প বয়স–ঘোর র্যাডিক্যাল। সব কাজের সঙ্গী প্রাণের বন্ধু মনোমোহন ঘোষ। হঠাৎ একদিন তার ইচ্ছে হল বন্ধুর স্ত্রীকে দেখবার। এমন কি অপরাধ?
সত্যেন্দ্র রাজী। কিন্তু দেখাবেন কি করে? জ্ঞানদানন্দিনীর বাইরে যাবার জো নেই, অন্য পুরুষও অন্দরে আসতে পারবে না। এমন কি পুরুষ ভৃত্যও না। তাহলে? দিনরাত অনেক শলা-পরামর্শ ফন্দি-ফিকির খাটিয়ে শেষে একটা ব্যবস্থা হল। সে যেমনি দুঃসাহসিক তেমনি রোমাঞ্চকর। জ্ঞানদানন্দিনীর মুখেই শোনা যাক:
ওঁরা দুজনে পরামর্শ করে একদিন বেশি রাতে সমান তালে পা ফেলে বাড়ির ভেতরে এলেন। তারপরে উনি মনোমোহনকে মশারির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে শুয়ে পড়লেন। আমরা দুজনেই মশারির মধ্যে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলুম; আমি ঘোমটা দিয়ে একপাশে আর তিনি ডোম্বলদাসের মতো আরেক পাশে। লজ্জায় কারো মুখে কথা নেই। আবার কিছুক্ষণ পরে তেমনি সমান তালে পা ফেলে উনি তাকে বাইরে পার করে দিয়ে এলেন।