Site icon BnBoi.Com

দ্বন্দ্বমধুর – সৈয়দ মুজতবা আলী

দ্বন্দ্বমধুর – সৈয়দ মুজতবা আলী

চাচা-কাহিনী

বার্লিন শহরের উলান্ড স্ট্রীটের উপর ১৯২৯ খ্ৰীষ্টাব্দে হিন্দুস্থান হৌস নামে একটি রেস্তোরাঁ জন্ম নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে, বাঙালির যা স্বভাব, রেস্তোরাঁর এক কোণে একটি আড্ডা বসে যায়। আড়ার গোসাঁই ছিলেন চাচা, বরিশালের খাজা বাঙালি মুসলমান, আর চেলারা— গোসাঁই, মুখুজ্জে, সরকার, রায়, চ্যাংড়া গোলাম মৌলা ইত্যাদি।

রায় চুক চুক করে বিয়ার খাচ্ছিলেন আর গ্রাম-সম্পর্কে তাঁর ভাগনে গোলাম মৌলা ভয়ে ভয়ে তার দিকে মিট মিট করে তাকাচ্ছিল, পাছে তিনি বানচাল হয়ে যান। এ-মামলা চাচা রোজই দেখেন, কিছু বলেন না, আজ বললেন, ‘অত ডরাচ্ছিস কেন?’

মৌলা লাজুক ছেলে। মাথা নিচু করে বললে, ‘ওটা খাবার কী প্রয়োজন? আপনি তো কখনও খান নি, এতদিন বার্লিনে থেকেও। মামুরই বা কী দরকার?’

চাচা বললেন, ‘ওর বাপ খেত, ঠাকুরদা খেত, দাদামশাই খেত, মামারা খায় এ দেশে না এসেও। ও হল পাইকারি মাতাল, আর পাঁচটা হিন্দুস্থানীর মত পেচী মাতাল নয়। আর আমি কখনও খই নি তোকে কে বললে?’

আড্ডা একসঙ্গে বললে, ‘সে কী চাচা?’

এমন ভাবে কোরাস গাইলে, মনে হল, যেন বছরের পর বছর তারা ওই বাক্যগুলোই মোহোড়া দিয়ে আসছে।

ডান হাত গলাবন্ধ কোটের মধ্যিখোন দিয়ে ঢুকিয়ে, বাঁ হাতের তোলো চিত করে চাচা বললেন, ‘মদকে ইংরিজিতে বলে স্পিরিট, আর স্পিরিট মানে ভুত। অর্থাৎ মদে রয়েছে ভূত। সে-ভূত কখন কার ঘাড়ে চাপে তার কি কিছু ঠিক-ঠিকানা আছে? তবে ভাগ্যিস, ওভূত আমার ঘাড়ে মাত্র একদিনই চেপেছিল, একবারের তরে।’

গল্পের সন্ধান পেয়ে আড্ডা খুশ! আসন জমিয়ে সবাই বললে, ‘ছাডুন চাচা।’

রায় বললেন, ‘ভাগিনা, আরেকটা বিয়ার নিয়ে আয়।’

মৌলা অতি অনিচ্ছায় উঠে গেল! উঠবার সময় বললে, ‘এ নিয়ে আঠারটা।’

রায় শুধালেন, ‘বাড়তি না কমতি?’

ফিরে এলে চাচা বললেন, ফ্রিলাইন ফন ব্ৰাখেলকে চিনিস?’

লেডি-কিলার পুলিন সরকার বললে, ‘আহা, কৈসন সুন্দরী,
রূপসিনী ব্লন্দিনী
নরদিশি নন্দিনী।’

শ্ৰীধর মুখুজ্জে বললে, ‘চোপ-’

চাচা বললেন, ‘ওর সঙ্গে প্রেম করতে যাস নি। চুমো খেতে হলে তোকে উদুখল সঙ্গে নিয়ে পেছনে ঘুরতে হবে।’

বিয়ারের ভুড়ভুড়ির মত রায়ের গলা শোনা গেল, ‘কিংবা মই।’

গোসাঁই বললেন, ‘কিংবা দুই-ই। উদূখলের উপর। মই চাপিয়ে।’

শ্ৰীধর বললে, ‘কী জ্বালা! শাস্ত্র শ্রবণে এরা বাধা দিচ্ছে কেন? চাচা, আপনি চালান।’

চাচা বললেন, ‘সেই ফন ব্ৰাখেল আমায় বড় স্নেহ করত, তোরা জানিস। ভরাগ্রীষ্মকালে একদিন এসে বললে, ‘ক্লাইনার ইডিয়ট (হাবা-গঙ্গারাম), এবারে আমার জন্মদিনে তোমাকে আমাদের গায়ের বাড়িতে যেতে হবে। শহরে থেকে থেকে তুমি একদম পিলা মেরে গেছ, গায়ের রোদে রঙটিকে ফের একটু বাদামির আমেজ লাগিয়ে আসবে।’

আমি বললুম, ‘অর্থাৎ জুতোতে পালিশ লাগাতে বলছ? রোদুরে না বেরিয়ে বেরিয়ে কোনও গতিকে রঙটা একটু ভদ্রস্থ করে এনেছি, সেটাকে আবার নেটিভ-মার্কা করব? কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তুমি না হয় আমাকে সয়ে নিতে পোর; কিন্তু তোমার বাড়ির লোক? তোমার বাবা, কাক?’

ব্ৰাখেল বললে, ‘না হয় একটু বাঁদর-নাচই দেখালে।’।

চাচা বললেন, ‘যেতেই হল। ব্ৰাখেল আমার যা-সব উপকার করেছে তার বদলে আমি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেও যেতে পারি।’

মৌলা চট করে একবার ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে নিলে।

চাচা বললে, ‘অজ পাড়াগাঁ ইস্টিশন। প্যাসেঞ্জারে যেতে হল। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি, স্বয়ং স্টেশনমাস্টার সেলাম ঠুকে সামনে হাজির। তার পিছনে ছোটবাবু, মালবাবুঅবশ্য দাশের মত খালি গায়ে আলপাকার ওপর ব্রেসট্ৰিকেট পরা নয়, টিকিট-বাবু, দুচারজন তামাশা দেখনেওলা, পুরো পাক্কা প্রসেশনে বলেই হয়। ওই অজ স্টেশনে আমিই বোধ হয় প্রথম ভারতীয় নামলম, আর আমিই বোধ হয় শেষ।

স্টেশনমাস্টার বললে, ‘বাইরে গাড়ি তৈরি, এই দিকে আজ্ঞা হোক।’

বুঝলুম, ফন ব্ৰাখেলেরা শুধু বড়লোক নয়, বোধ হয় এ-অঞ্চলের জমিদার!

বাইরে এসে দেখি, প্রাচীন ফিটিং গাড়ি, কিন্তু বেশ শক্তসমখ। কোচম্যান তার চেয়েও বুড়ো, পরনে মনিং সুট, মাথায় চোঙার মত অপরা হ্যাট, আর ইয়া হিন্ডেনবুগি গোঁফ, এডওয়াড়ী দাড়ি, আর চোখ দুটো এবং নাকের ডগাটি সুজি রায়ের চোখের মত লাল, জবাকুসুমসঙ্কাশং।

কী একটা মন্ত্র পড়ে গেল; দাড়ি-গোঁপের ছাঁকনি দিয়ে যা বেরোল তার থেকে বুঝলুম, আমাকে ফিউডাল পদ্ধতিতে অভিনন্দন জানানো হচ্ছে। এ চাপানের কী ওতোর মন্ত্র গাইতে হয়। ব্ৰাখেল আমাকে শিখিয়ে দেয় নি। কী আর করি, ‘বিলক্ষণ, বিলক্ষণ’ বলে যেতে লাগলুম, আর মনে মনে ব্ৰাখেলকে প্ৰাণ ভরে অভিসম্পাত করলুম, এ-সব বিপাকের জন্য আমাকে কায়দা—কেতা শিখিয়ে দেয় নি বলে।

আমি গাড়িতে বসতেই কোচম্যান আমার হাঁটুর উপর একখানা ভারী কম্বল চাপিয়ে দু-দিকে গুঁজে দিয়ে মিলিটারি কায়দায় গটগট করে গিয়ে কোচাবাক্সে বসল। তারপর চাবুকটা

মধ্যিখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলে। ইতিমধ্যে স্টেশনমাস্টারের ফুটফুটে মেয়েটি আমার অটোগ্রাফ আর স্ন্যাপ দুইই তুলে নিয়েছে।

মাঠের পর ঈষৎ খাড়াই, তারপর ঘন পাইন বন; বন থেকে বেরুতেই সামনে উঁচু পাহাড় আর তার উপর যমদূতের মত দাঁড়িয়ে এক কাসল। মহাভারতের শাস্তিপর্বে শরশয্যায় শুয়ে শুয়ে ভীষ্মদেব মেলা দুর্গের বয়ান করেছেন, এ দুর্গ যেন সব কটা মিলিয়ে লাবড়ি-ভর্তা।

আমি ভয় পেয়ে শুধালুম, ‘ওই আকাশে চড়তে হবে?’

কোচম্যান ঘাড় ফিরিয়ে গর্বের হাসি হেসে বললে, ‘ইয়াঃ মাইন হের!’ দেমাকের ঠ্যালায় তার গোঁপের ডগা দুটো আরও আড়াই ইঞ্চি প্রমোশন পেয়ে গেল। তারপর ভরসা। দিলে, ‘এক মিনিটে পৌঁছে যাব স্যারা’ আমি মনে মনে মৌলা আলীকে স্মরণ করলুম।

এ কী বিদঘুটে ঘোড়া রে বাবা, এতক্ষণ সমান জমিতে চলছিল আমাদের দিশী টাটুর মত কদম আর দুলকি চাল মিশিয়ে, এখন চড়াই পেয়ে চলল লাষী চালে। রাস্তাটা অজগরের মত পাহাড়টাকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠে যেন কাস্লটায় ফণা মেলেছে; কিন্তু ফণার কথা থাক, উপস্থিত প্রতি বীকে গাড়ি যেন দুচাকার উপর ভর দিয়ে মোড় নিচ্ছে।

হঠাৎ সামনে দেখি বিরাট খোলা গেট। কঁকারের উপর দিয়ে গাড়ি এসে যেখানে দাঁড়ালো তার ওপর থেকে গলা শুনে তাকিয়ে দেখি, ভিলিকিনি থেকে-’

মৌলা শুধাল, ‘ভিলিকিনি মানে?’

চাচা বললেন, ‘ও ব্যালকনি, আমাদের দেশে বলে ভিলিকিনি-সেই ভিলিকিনি থেকে ফন ব্ৰাখেল চেঁচিয়ে বলছে, যোহানেস, ওঁকে ওঁর ঘর দেখিয়ে দাও; গুস্টাফ টেবিল সাজাচ্ছে।’

তারপর আমাকে বললে, ‘ডিনারের পয়লা ঘণ্টা এখুনি পড়বে, তুমি তৈরি হয়ে নাও।’

চাচা বললেন, ‘পরি তো কারখানার চোঙার মত পাতলুম আর গলাবন্ধ কোট, কিন্তু একটা নেভি-ব্ল সুট আমি প্রথম যৌবনে হিম্মৎ সিং-এর পাল্লায় পড়ে করিয়েছিলুম, তার রঙ, তখন বাদামীতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এর পর কোন রঙ নেবে যেন মনঃস্থির করতে না পেরে নি যযৌ ন তস্থে হয়ে আছে। হাতমুখ ধুয়ে সেইটি পরে বেডরুমটার ফেন্সি জিনিসপত্রগুলো তাকিয়ে দেখছি। এমন সময় ব্ৰাখেল আমাকে নক করে ঘরে ঢুকল। আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এ কী? ডিনার-জ্যাকেট পর নি?’

আমি বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘ওসব আমার নেই, তুমি বেশ জানি।’

ফন ব্ৰাখেল বললে, ‘উঁহু, সেটি হচ্ছে না। এ বাড়িতে এসব ব্যাপারে বাবা জ্যাঠা দুজনাই জোর রিচুয়াল মানেন, বড্ড পিটপিটে। তোমাদের পুজোপাজা নেমাজ-টেমাজের মত সসেজ থেকে মাস্টার্ড খসবার উপায় নেই।’ তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললে, ‘তা তুমি এক কাজ কর। দাদার কাবার্ড ভর্তি ডিনার-জ্যাকেট, শার্ট, বো—তারই এক প্রস্থ পরে নাও। এটা তারই বেডরুম; এই কাবার্ডে সাব-কিছু পাবে।’

আমি বললুম, ‘তওবা, তোমার দাদার জামা-কাপড় পরলে কোট মাটি পৌঁছে তোমার ডিনার গাউনের মত টেল করবে।’

বললে, ‘না, না, না। সবাই কি আমার মত দিক-ধেড়েঙ্গে! তুমি চটুপটু তৈরি হয়ে নাও, আমি চললুম।’

চাচা বললেন, ‘কী আর করি, খুললুম কাবার্ড। কাতারে কাতারে কোট পাতলুম বুলিছে-সদ্য প্রেসড, দেরাজ ভর্তি শার্ট, কলার, বো হীরে-বসানো শ্ৰীভ-লিনাক্স, আরও কত কী!

‘মানিকপীরের মেহেরবানি বলতে হবে, জুতোটি পর্যন্ত ফিট করে গেল দস্তানার মত।

মানিকপীরের মেহেরবানি বলতে হবে, জুতোটি পর্যন্ত ফিট করে গেল দস্তানার মত। মাথার মধ্যিখানে সিঁথি জুতসই হবে না, ব্যাকব্রাশ করলেই মানাবে ভাল। আর আশ্চর্য বিশ বছরের দুফাঁক করা চুল বিলকুল বেয়াড়ামি না করে এক লম্ফে তালুর উপর দিয়ে পিছনে ঘাড়ের উপর চেপে বসল, যেন আমি মায়ের গর্ভ থেকে ওই ঢঙের চুল নিয়েই জন্মেছি। আয়নাতে চেহারা দেখে মনে হল, ঠিক জংলীর মত তো দেখাচ্ছে না, তোরা অবিশ্যি বিশ্বাস করবি নে।’

চাচার ন্যাওটা ভক্ত গোসাঁই বললে, ‘চাচা, এ আপনার একটা মস্ত দোষ; শুধু আত্মনিন্দা করেন। ওই যে আপনি মহাভারতের শাস্তিপর্বের কথা বললেন, সেখানেই ভীষ্মদেব যুধিষ্ঠিরকে আত্মনিন্দার প্রচণ্ড নিন্দা করে গেছেন।’

চাচা খুশি হয়ে বললে, ‘হেঁ-হেঁ, তুই তো বললি, কিন্তু ওই পুলিনটা ভাবে সে-ই শুধু লেডি-কিলিং লিটবর। তা সে কথা যাক গে, ঈভনিং-ড্রেসে কালা কেষ্ট সেজে আমি তো শিস দিতে দিতে নোমলাম নীচের তলায়—’

পুলিন শুধালে, ‘স্যার, আপনাকে তো কখনও শিস দিতে শুনি নি, আপনি কি আদপেই শিস দিতে পারেন?’

চাচা বললেন, ‘ঠিক শুধিয়েছিস। আর সত্যি বলতে কী, আমি নিজেই জানি নে, আমি শিস দিতে পারি কি না। তবে কি জানিস, হাফপ্যান্ট পরলে লাফ দিতে ইচ্ছা করে, জোব্বা পরলে পদ্মাসনে বসে থাকবার ইচ্ছা হয়, ঠিক তেমনি ঈভনিং ড্রেস পরলে কেমন যেন সাঁঝের ফষ্টি-নিষ্টি করবার জন্য মন উতলা হয়ে ওঠে, না হলে আমি শিস দিতে যাব। কেন? শিস কি দিয়েছিলুম। আমি, শিস দিয়েছিল বিকাটে সুন্টটা। তা সে কথা যাক।’

ততক্ষণে ডিনারের শেষ ঘণ্টা পড়ে গিয়েছে। আন্দাজে আন্দাজে ড্রইংরুম পেরিয়ে ঢুকলুম গিয়ে ব্যানকুয়েট-হলে।

কাসলের ব্যানকুয়েট-হল আমাদের চণ্ডীমণ্ডপ-সাইজ হবে। তার আর বিচিত্র কী এবং সিনেমার কৃপায় আজকাল প্রায় সকলেরই তার বিদঘুটে ঢাপ-ঢং দেখা হয়ে গিয়েছে; কিন্তু বাস্তবে দেখলুম। ঠিক সিনেমার সঙ্গে মিলল না। আমাদের দিণী সিনেমাতে চণ্ডীদাস পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে টিনের ছাতওলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন, যদিও বোতাম আর টিন এসেছে ইংরিজি আমলে। আর হলিউড যদি ব্যানকুয়েট-হল দেখায় অষ্টাদশ শতাব্দীর, তবে আসবাবপত্র রাখে সপ্তদশ শতাব্দীর, জাস্ট টু বী অনাদি সেফ সাইড।

ফন ব্ৰাখেলদের কাসল কোন শতাব্দীর জানি না। কিন্তু হলে ঢুকেই লক্ষ্য করলুম, মান্ধাতার আমলের টেবিল-চেয়ারের সঙ্গে বিংশ শতাব্দীর সুখ-সুবিধার সরঞ্জামও মিশে রয়েছে। তবে খাপ খেয়ে গিয়েছে দিব্যি, এদের রুচি আছে কোনও সন্দেহ নেই। এসব অবশ্য পরে খেতে খেতে লক্ষ্য করেছিলুম।

টেবিলের এক প্রান্তে ক্লারা ফন ব্ৰাখেল, অন্য প্রান্তে যে ভদ্রলোক বসেছেন তাকে ঠিক ক্লারার বাপ বলে মনে হল না, অতখানি বয়স যেন ওঁর নয়।

প্রথম দর্শনেই দুজন কেমন যেন হ’কচাকিয়ে গেলেন। বাপের হাত থেকে তো ন্যাপকিনের আংটিটা ঠং করে টেবিলের উপর পড়ে গেল। আমি আশ্চর্য হলুম না, ভদ্রলোক হয়তো জীবনে এই প্রথম ইন্ডার (ভারতীয়) দেখেছেন, কালো ঈভনিং-ড্রেসের ওপর কালো চেহারা-গোসাঁইয়ের পদাবলীতে—

‘কালোর উপরে কালো।’

হকচাকিয়ে যাওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। কিন্তু ক্লারা কেমন যেন অদ্ভুতভাবে তাকালে ঠিক বুঝতেই পারলুম না। তবে কি বোটা ঠিক হেডিং মাফিক বীধা হয় নি! কই, আমি তো একদম রেডিমেডের মত করে বেঁধেছি, এমন কি হালফ্যাশান মাফিক তিন ডিগ্রি ট্যারীচাও করে দিয়েছি। তবে কি ঈভনিং ড্রেস আর ব্যাকব্রাস করা চুলে আমাকে ম্যাজিসিয়ানের মত দেখাচ্ছিল?

সামলে নিয়ে ক্লারা ভদ্রলোককে বললে, ‘পাপা, এই হচ্ছে আমার ইন্ডিয়ার আফে!’

অর্থাৎ, ভারতীয় বাঁদর।

বাপও ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন। মিষ্টি হেসে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে শেক-হ্যান্ড করলেন। ক্লারাকে বললেন, ‘পফূই-ছিঃ, ও-রকম বলতে নেই।’

আমি হঠাৎ কী করে বলে ফেললুম, ‘আমি যদি বাঁদর হই। তবে ও জিরাফ।’

বলেই মনে হল, তওবা, তওবা, প্রথম দিনেই ও-রকম জ্যাঠামো করা উচিত হয় নি।

পিতা কিন্তু দেখলুম, মন্তব্যটা শুনে ভারি খুশ। বললেন ‘ডাঙ্কে—ধন্যবাদ-ক্লারাকে ঠিক শুনিয়ে দিয়েছ। আমরা তো সাহস পাই নে।’

পালিশ-আয়নার মত টেবিল, স্বচ্ছন্দে মুখ দেখা যায়। তার উপর ওলন্দাজ লেসের গোল গোল হালকা চাকতির উপর প্লেট পিরিচ সাজানো। বড় প্লেটের দুদিকে সারি বাঁধা অন্তত আটখানা ছুরি, আটখানা কাঁটা, আধা ডজন নানা ঢঙের মদের গেলাস। সেরেছে। এর কোন ফর্ক দিয়ে মুরগী খেতে হয়, কোনটা দিয়ে রোস্ট আর কোনটা দিয়েই বা সাইডু ডিশ?

আসল খাবার পূর্বের চাট—’আর দা অভূরে’র নাম দিয়েছি আমি চাট, তখন দেওয়া হয়ে গিয়েছে। খুঞ্চার ছ। পদ থেকে আমি তুলেছি মাত্র দুপদ, কিঞ্চিৎ সসেজ আর দুটি জলপাই, এমন সময় বাটলার দুহাতে গোটা চারেক বোতল নিয়ে এসে শুধাল, শেরি? পোর্ট? ভোরমুট? কিংবা হুইস্কি সোডা?

আমি এসব দ্রব্য সসম্রামে এড়িয়ে চলি। হঠাৎ কী করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘নো বিয়ার!’

বলেই জিভ কাটলুম। আমি কী বলতে কী বললুম! একে তো আমি বিয়ার জীবনে কখনও খই নি, তার উপরে আমি ভাল করেই জানি, বিয়ার চাষাড়ে ড্রিঙ্ক, ভদ্রলোকে যদিবা খায়। তবে গরমের দিনে, তেষ্টা মেটাবার জন্যে। অষ্টপদী ব্যানকুয়েটে বিয়ার! এ যেন বিয়ের ভোজে কালিয়ার বদলে শুটকি তলব করা!

ক্লারা জানত, আমি মদ খাই নে, হয়তো বোপকে তাই আগের থেকে বলে রেখে আমার জন্যে মাফ চেয়ে রেখেছিল, তাই সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকালে।

বাটলার কিন্তু কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে এক ঢাউস বিয়ারের মগ নিয়ে এল, তার ভিতর অনায়াসে দু বোতল বিয়ারের জায়গা হয়।

যখন নিতান্তই এসে গিয়েছে তখন খেতে হয়। ভাবলাম, একটুখানি ঠোঁটে ভেজাব মাত্র, কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করবে না, খেতে গিয়ে ঢক ঢক করে প্রায় আধ মগ সাফ করে দিলুম।

মৌলা এক বিঘাত হাঁ করে বললে, ‘এক ধাক্কায় এক বোতল? মামুও তো পারবে না।’

চাচা বললেন, ‘কোন শরম দিচ্ছিস, বাবা? ওরকম ঈভনিং-ড্রেস পরে ব্যানকুয়েট হলে বসলে তোর মামাও এক ঝটিকায় দু পিপি বিয়ার গিলে ফেলত। বিয়ার কি আমি খেয়েছিলুম? খেয়েছিল ওই শালার ড্রেস!’

গোসাঁই মর্মাহত হয়ে বললে, ‘চাচা।’

চাচা বললেন, ‘অপরাধ নিস নি গোসাঁই, ভাষা বাবদে আমি মাঝে মাঝে এটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে যাই। জানিস তো আমার জীবনের পয়লা গুরু ছিলেন এক ভশচয, তিনি শকার ব’–কার ছাড়া কথা কইতে পারতেন না। তা সে কথা থাক।’

তখনও খেয়েছি মাত্র আড়াই চাক্তি সসেজ আর আধখানা জলপাই, পেট পদ্মার বালুচর। সেই শুধু-পেটে বিয়ার দু মিনিট জিরিয়েই চচ্চড় করে চড়ে উঠল মাথার ব্ৰহ্মরন্ধে।

এমন সময় হের ফন ব্ৰাখেল জিজ্ঞেস করলেন, ‘বার্লিনে কী রকম পড়াশোনা হচ্ছে?’

বুঝলুম এ হচ্ছে ভদ্রতার প্রশ্ন, এর উত্তরে বিশেষ কিছু বলতে হয় না, হুঁ হুঁ করে গেলেই চলে। কিন্তু আমি বললুম, ‘পড়াশোনা? তার আমি কী জানি? সমস্ত দিন, সমস্ত রাত বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না, তো কাটে হৈ হৈ করে ইয়ার-বকশীদের সঙ্গে।’

বলেই অবাক হয়ে গেলুম। আমার তো দিনের দশ ঘণ্টা কাটে স্যাটস বিবলিওটেকে, স্টেট লাইব্রেরিতে, ক্লারারও সে খবর বেশ জানা আছে। ব্যাপার কী? সেই গল্পটা তোদের বলেছি?—পিপের ছাদা দিয়ে হুইস্কি বেরুচ্ছিল, ইঁদুর চুক চুক করে খেয়ে তার হয়ে গিয়েছে নেশা, লাফ দিয়ে পিপের উপরে উঠে আস্তিন গুটিয়ে বলছে, ‘ওই ড্যাম ক্যাটটা গেল কোথা? ব্যাটাকে ডেকে পাঠাও, তার সঙ্গে আমি লড়াব।’

কিন্তু এত সাত-তাড়াতাড়ি কি নেশা চড়ে?

ইতিমধ্যে আপন অজানাতে বিয়ারে আবার লম্বা চুমুক দিয়ে বসে আছি।

করে করে তিন-চার পদ খাওয়া হয়ে গিয়েছে। যখন রোস্ট টার্কীতে পৌঁছেছি, তখন দেখি অতি ধোপদূরস্ত ঈভনিং-ড্রেস-পরা আর এক ভদ্রলোক টেবিলের ওদিকে আমার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন। ক্লারা তাকে বললে, ‘জ্যাঠামশাই, এই আমাদের ইন্ডার।’ বড় নার্ভাস ধরনের লোক। হাত অল্প অল্প কাঁপছে। আর বার বার বলছেন, ‘তোমরা ব্যস্ত হয়ো না, সব ঠিক আছে, সব ঠিক আছে, আমি শুধু ইয়ে—’ তারপর আমার দিকে একটু তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমি শুধু রোস্ট আর পুডিং খাই বলে একটু দেরিতে আসি।’

তারপর আমি কী বকর-ব্যকর করেছিলুম আমার স্পষ্ট মনে নেই। সঙ্গে সঙ্গে চলছে বিয়ারের পর বিয়ার, কখনও বা বেশ উঁচু গলায় বলে উঠি, ‘গুস্টাফ, আরও বিয়ার নিয়ে এস।’

এ কী অভদ্রতা! কিন্তু কারও মুখে এতটুকু চিত্তবৈকল্যের লক্ষণ দেখতে পেলুম না, কিংবা হয়তো লক্ষ্য করি নি। আর ভাবছি, ডিনার শেষ হলে বাঁচি।

শেষ হলও। আমরা ড্রইংরুমে গিয়ে বসলুম। কফি লিকার সিগার এল। আমি অভদ্রতার চূড়ান্তে পৌঁছে বললুম, ‘নো লিকার, বিয়ার প্লীজ!’

বাবা হেসে বললেন, ‘আমাদের বিয়ার তোমার ভাল লাগাতে আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু একটু বিলিয়ার্ড খেললে হয় না? তুমি খেলো?’

বললুম, ‘আলবত!’ অথচ আমি জীবনে বিলিয়ার্ড খেলেছি মাত্র দুদিন, কলকাতার ওয়াই.এম.সি.এ-তে। এখানকার বিলিয়ার্ড টেবিলে আবার পকেট থাকে না, এতে খেলা অনেক বেশি শক্ত।

জ্যাঠামশাই দাঁড়িয়ে বললেন, ‘গুড বাই, তোমরা খেলোগে।’

ক্লারাও আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ‘গুড নাইট’ বললে।

খুব নিচু ছাতওয়ালা, প্রায় মাটির নীচে বিরাট জলসাঘর, তারই এক প্রান্তে বিলিয়ার্ডটেবিল। দেওয়ালের গায়ে গায়ে সারি সারি বিয়ারের পিপে। এত বিয়ার খায় কে? এরা তো কেউ বিয়ার খায় না দেখলুম।

ইতিমধ্যে লিকারের বদলে ফের শ্যাম্পেন উপস্থিত। আমি বললুম, ‘নো শ্যাম্পেন।’ আবার চলল বিয়ার।

মার্কার কিউ এনে দিলে। আমি সেটা হাতে নিয়ে একটু বিরক্তির সঙ্গে বললুম, ‘এ আবার কি কিউ দিলে?’

মার্কারের মুখ কোন অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠল না। বরঞ্চ যেন খুশি হয়েই আলমারি খুলে একটি পুরনো কিউ এনে দিলে! আমি পাকা খেলোয়াড়ির মত সেটা হাতে ব্যালানস করে বললুম, ‘এইটেই তো, বাবা, বেশী; তবে ওই পচা মাল পাচার করতে গিয়েছিলে কেন?’

আমার বেয়াদবি তখন চুড়া ছেড়ে আকাশে উঠে ঢলাচলি আরম্ভ করে দিয়েছে। অবশ্য তখনও ঠিক ঠিক ঠাহর হয় নি, মালুম হয়েছিল অনেক পরে।

গ্রামের একঘেয়ে জীবনের ঝানু খেলোয়ারকে আমি হারাব এ আশা অবিশ্যি আমি করি নি; কিন্তু খেলতে গিয়ে দেখলুম, খুব যে খারাপ খেলছি তা নয়, তবে আমার প্রত্যাশার চেয়ে ঢের ভাল। আর প্রতিবারেই আমি লীড পেয়ে যাচ্ছিলুম অতি খাসা, স্বপ্নের বিলিয়ার্ডেও মানুষ ও রকম লীড পায় না।

রাত কটা অবধি খেলা চলেছিল বলতে পারব না। আমি তখন তিনটি বলের বদলে কখনও ছটা কখনও নটা দেখছি, কিন্তু খেলে যাচ্ছি ঠিকই, খুব সম্ভব ভাল লীডের লাকে।

হের ফন ব্ৰাখেল শেষটায় না বলে থাকতে পারলেন না, ‘তোমার লাক বড় ভাল।’

অত্যন্ত বেকসুর মন্তব্য। আমি কিন্তু চটে গিয়ে বেশ চড়া গলায় বললুম, ‘লাক, না। কচুর ডিম! নাচতে না জানলে শহর বাঁকা। আই লাইক দ্যাট্‌!’

ব্ৰাখেল কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, আমিও অষ্টমে উঠে আরও কথা শুনিয়ে দিলুম। ওদিকে দেখি মার্কার ব্যাটা মিটমিটিয়ে হাসছে। আমি আরও চটে গিয়ে হুঙ্কার দিলুম, ‘তোমার মুলোর দোকান বন্ধ কর, এখন রাত সাড়ে তেরোটায় কেউ মূলো কিনতে আসবে না।’ অথচ বেচারি বুড়ো থুত্থুড়ো, সব কটা দাঁত জগন্নাথ দেবতাকে দিয়ে এসেছে।

চিৎকার-চেল্লাচেল্লির মধ্যিখানে হঠাৎ দেখি সামনে জ্যাঠামশাই, পরনে তখনও পরিপাটি ঈভনিং-ড্রেস।

আবার সেই নার্ভাস স্বরে বললেন, ‘সরি সরি, তোমরা কিছু মনে কোর না, আমি শব্দ শুনে এলুম।’ তারপর ক্লারার বাপের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই বড় ঝগড়াটে, ভালফগাঙ, নিত্য নিত্য এর সঙ্গে ঝগড়া করিস।’ তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘তার চেয়ে বরঞ্চ একটু তাস খেললে হয় না? আমার ঘুম হচ্ছে না।’

আমি বললুম, ‘হুঁ হুঁ হুঁ।’

তাসের টেবিল এল।

আমি স্কট খেলেছি বিলিয়ার্ডের চেয়েও কম।

জ্যাঠা বললেন, কী স্টেক?’

বাপ বললেন, ‘নিত্যিকার।’

‘নিত্যিকার’ বলতে কী বোঝাল জানি নে। ওদিকে আমার পকেটে তো ছুঁচো ডিগবাজি খেলছে। জ্যাঠা হিসাব করে বললেন, ‘হানস পনেরো মার্ক ভলফগাঙ দুই।’

আপনার থেকে আমার বাঁ হাত কোটের ভিতরকার পকেটের দিকে রওনা হল। তখনই মনে পড়ল, এ কোটি তো ক্লারার দাদার। আমার মানিব্যাগ তো পড়ে আছে আমার খাটে, উপরের তলায়। কিন্তু তারই সঙ্গে সঙ্গে হাত গিয়ে ঠেকাল এক তাড়া করকরে নোটে। ঈশ্বর পরম দয়ালু, তাহার কৃপায় টাকা গজায়, এই টাকা দিয়েই আজকের ফাড়া কাঁটাই, পরের কথা পরে হবে। ক্লারাকে বুঝিয়ে বললে সে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবে না। আর নিজের মনিব্যাগে রেস্ত আছেই বা কী? দশ মার্ক হয় কি না-হয়।

এদিকে রেস্ত নেই, ওদিকে খেলার নেশাও চেপেছে। পরের বাজিতে আবার হারলুম, এবার গেল আরও কুড়ি মার্ক, তারপর পঞ্চাশ, তারপর কত তার আর আমার হিসেব নেই। নোটের তাড়া প্রায় শেষ হতে চলল। আমি যুধিষ্ঠির নই, অর্থাৎ কোন রমণীর উপর টুয়েন্টি পার্সেন্ট অধিকারও আমার নেই, না হলে তখন সে রেস্তও ভাঙাতে হত, এমন সময় আস্তে আস্তে আমার ভাগ্য ফিরতে লাগল। দশ কুড়ি করে সব মার্ক তোলা হয়ে গেল, তারপর প্রায় আরও শ দুই মার্ক জিতে গেলুম।

ওদিকে মদ চলছে পাইকারি হিসেবে আর জ্যাঠামশাই দেখি হারার সঙ্গে সঙ্গে আরও বেশি নার্ভাস হয়ে যাচ্ছেন। আমি তো শেষটায় না থাকতে পেরে খলখল করে হোসে উঠলুম। কিছুতেই হাসি থামাতে পারি নে। গলা দিয়ে এক ঝলক বিয়ার বেরিয়ে এল, কোন গতিকে সেটা রুমাল দিয়ে সামলালুম। কিন্তু হাসি আর থামাতে পারি নে। বুঝলুম, এরেই কয় নেশা।

জ্যাঠামশাই নার্ভাস সুরে বলেন, ‘হেঁ-হেঁ, এটা যেন, কেমন যেন,–হেঁ-হেঁ, তোমার লাক—হেঁ-হেঁ-নইলে আমি খেলাতে—’

আবার লাক! এক মুহূর্তে আমার হাসি থেমে গিয়ে হল বেজায় রাগ। বিলিয়ার্ডের বেলায়ও আমাকে শুনতে হয়েছিল ওই গুডুড্যাম লাকের দোহাই।

টং হয়ে এক ঝটিকায় টেবিলের তাস ছিটকে ফেলে বললুম, ‘তার মানে? আপনারা আমাকে কী পেয়েছেন? ইউ অ্যান্ড ইয়োর ড্যাম লাক, ড্যাম, ড্যাম—’

বাপ-জ্যাঠা কী বলে আমায় ঠাণ্ডা করতে চেয়েছিলেন আমরা সেদিকে খেয়াল নেই। কতক্ষণ চলেছিল তাও বলতে পারব না, আমরা গলা পর্দার পর পর্দা চড়ে যাচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার যত কটুকটব্য।

এমন সময় দেখি, ক্লারা।

কোথায় না। আমি তখন ইশে ফিরব-আমি তখন সপ্তমে না, একেবারে সেঞ্চারির নেশায়। শেষটায় বোধ হয়, ‘ছোটলোক’, ‘মীন’, এইসব অশ্রাব্য শব্দও ব্যবহার করেছিলুম। ক্লারা আমার কাঁধে হাত দিয়ে নিয়ে চলল। দরজার দিকে। অনুনয় করে বললে, ‘অত চটছ কেন, ওঁদের সঙ্গে না খেললেই হয়, ওঁরা ওই রকমই করে থাকেন।’

বেরুবার সময় পর্যন্ত শুনি ওঁরা বলছেন, ‘সিরি, সরি, প্লীজ প্লীজ। আমাদের দোষ হয়েছে।’

তবু আমার রাগ পড়ে না।’

 

চাচা কফিতে চুমুক দিলেন। রায় বললেন, ‘ঢের ঢের মদ খেয়েছি, ঢের ঢের মাতলামো দেখেছি, কিন্তু এরকম বিদঘুটে নেশার কথা কখনও শুনি নি।’

চাচা বললেন, ‘যা বলেছ! তাই আমি রাগ ঝাড়তে ঝাড়তে গেলুম শোবার ঘরে! ঈভনিং-কোট, পাতলুন খোলার সঙ্গে সঙ্গে মাথা কিন্তু ঠাণ্ডা হতে আরম্ভ করেছে, বিয়ারের মগও হাতের কাছে নেই।

বালিশে মাথা দিতে না দিতেই স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, সমস্ত সন্ধ্যা আর রাতভোর কী ছুচোমিটাই না করেছি!’ ছি-ছি, ক্লারার বাপ-জ্যাঠামশায়ের সামনে কী ইতরোমেই না করে গেলুম ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে!

আর এদেশে সবাই ভাবে ইন্ডিয়ার লোক কতই না বিনয়ী, কতই না নম্ৰ!

যতই ভাবতে লাগলুম, মাথা ততই গরম হতে লাগল। শেষটায় মনে হল, কাল সকলে, আজ সকালেই বলা ভাল, কারণ ভোরের আলো তখন জানলা দিয়ে ঢুকতে আরম্ভ করেছে, এঁদের আমি মুখ দেখোব কী করে? জানি, মাতালকে মানুষ অনেকখানি মাফ করে দেয়, কিন্তু এ যে একেবারে চামারের মাতলামো!

তা হলে পালাই।

অতি ধীরে ধীরে কোন প্রকারের শব্দটি না করে সুটকেসটি ওখানেই ফেলে গাছের আড়ালে আড়ালে কাসল থেকে বেরিয়ে স্টেশন পানে দে ছুটি। মাইলখানেক এসে ফিরে তাকালুম; নাঃ, কেউ পিছু নেয় নি।

চোরের মত গাড়িতে ঢুকে সোজা বার্লিন।’

মৌলা বললে, ‘শুনলেন, মামা?’

চাচা বললেন, ‘আরো শোনই না শেষ অবধি।’

সেদিন সন্ধ্যেবেলায় তখন ঘরে বসে মাথায় হাত দিয়ে ভাবছি, এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা, আর সঙ্গে সঙ্গে ক্লারা। হায়, হায়, আমি ল্যান্ডলেডিকে একদম বলতে ভুলে গিয়েছিলুম, সবাইকে যেন বলে, আমি মরে গিয়েছি কিংবা পাগলা-গারদে বন্ধ হয়ে আছি কিংবা ওই ধরনের কিছু একটা!

শেষটায় মর-মর হয়ে ক্লারার কাছে মাতলামোর জন্য মাফ চাইলুম।

ক্লারা বললে, ‘অত লজ্জা পোচ্ছ কেন? ও তো মাতলামো না, পাগলামো। কিংবা অন্য কিছু, তুমি সব কিছু বুঝতে পার নি, আমরাও যে পেরেছি তা নয়।

‘তুমি যখন দাদার সুট পরে ডিনারে এলে তখনই তোমার সঙ্গে কোথায় যেন দাদার সাদৃশ্য দেখে বাবা আর আমি দুজনাই আশ্চর্য হয়ে গেলুম, বিশেষ করে ব্যাকব্রাশ করা চুল আর একটুখানি ট্যারীচা করে বাঁধা বো। দেখে। তার পর তুমি জোর গলায় চাইলে বিয়ার, দাদাও বিয়ার ভিন্ন অন্য কোন মদ খেত না; তুমি আরম্ভ করলে দাদারই মত বকতে, ‘লেখাপড়ার সময় কোথায়? আমি তো করি হৈ হৈ’–আমি জানতুম একদম বাজে কথা; কিন্তু দাদা হৈ হৈ করত। আর বলতেও কসুর করত না।’

‘শুধু তাই নয়। দাদাও ডিনারের পর বাবার সঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলত এবং শেষটায় দুজনাতে ঝগড়া হত। জ্যাঠামশাই তখন নেমে এসে ওদের সঙ্গে তাস খেলা আরম্ভ করতেন এবং আবার হত ঝগড়া। অথচ তিনজনাতে ভালবাসা ছিল অগাধ।’

‘তোমাকে আর সব বলার দরকার নেই; তুমি যে ঘরে উঠছিলে ওই ঘরেই একদিন দাদা আত্মহত্যা করে।’

‘কিন্তু আসলে যে কারণে তোমার কাছে এলুম, তুমি মনে কষ্ট পেয়ে না; বাবাজ্যাঠামশাই আমাকে বলতে পাঠিয়েছেন, তারা তোমার ব্যবহারে কিছু মাত্র আশ্চর্য কিংবা দুঃখিত হন নি।’

 

চাচা থামালেন।

রায় বললেন, ‘চাচা, আপনি ঠিকই বলেছিলেন, শিস দিয়েছিল সুন্টটাই, বিয়ারও ও-ই খেয়েছিল।’

চাচা বললেন, ‘হক কথা। মদ মানে স্পিরিট, স্পিরিট মানে ভুত, তাই স্পিরিট স্পিরিট খেয়েছিল।’

নোনাজল

সেই গোয়ালন্দ চাঁদপুরী জাহাজ। ত্রিশ বৎসর ধরে এর সঙ্গে আমার চেনাশোনা। চোখ বন্ধ করে দিলেও হাতড়ে হাতড়ে ঠিক বের করতে পারব, কোথায় জলের কল, কোথায় চাখিলির দোকান, মুর্গীর খাঁচাগুলো রাখা হয় কোন জায়গায়। অথচ আমি জাহাজের খালাসী নই-অবরের-সবরের যাত্রী মাত্র।

ত্রিশ বৎসর পরিচয়ের আমার আর সবই বদলে গিয়েছে, বদলায়নি। শুধু ডিসপ্যাচ স্টীমারের দল। এ-জাহাজের ও-জাহাজের ডেকে-কেবিনে কিছু কিছু ফেরফার সব সময়ই ছিল, এখনও আছে, কিন্তু সব কটা জাহাজের গন্ধটি হুবহু একই। কীরকম ভেজা-ভেজা, সোদা-সোদা যে গন্ধটা আর সব কিছু ছাপিয়ে ওঠে, সেটা মুর্গী-কারি রান্নার। আমার প্রায়ই মনে হয়েছে, সমস্ত জাহাজটাই যেন একটা আস্ত মুর্গী, তার পেটের ভেতর থেকে যেন তারই কারি রান্না আরম্ভ হয়েছে। এ-গন্ধ তাই চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, গোয়ালন্দ, যে কোন স্টেশনে পৌঁছানো মাত্রই পাওয়া যায়। পুরনো দিনের রূপরসগন্ধস্পর্শ সবই রয়েছে, শুধু লক্ষ্য করলুম ভিড় আগের চেয়ে কম।

দ্বিপ্রহরে পরিপাটি আহারাদি করে ডেকচেয়ারে শুয়ে দূর-দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিলুম। কবিত্ব আমরা আসে না, তাই প্রকৃতির সৌন্দর্য আমার চোখে ধরা পড়ে না, যতক্ষণ না রবি ঠাকুর সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। তাই আমি চাঁদের আলোর চেয়ে পছন্দ করি গ্রামোফোনের বাক্স। পোর্টেবলটা আনিব আনব করছি, এমন সময় চোখে পড়ল একখানা মন্দিতা ‘দেশ’—মালিক না আসা পর্যন্ত তিনি যদি পরিহস্তে কিঞ্চিৎ আভ্ৰষ্টা’ও হয়ে যান, তা তার স্বামী বিশেষ বিরক্ত হবেন না নিশ্চয়ই।

‘রূপদশী’ ছদ্মনাম নিয়ে এক নতুন লেখক খালাসীদের সম্বন্ধে একটি দরদ-ভরা লেখা ছেড়েছে। ছোকরার পেটে এলেম আছে, নইলে অতখানি কথা গুছিয়ে লিখল কী করে, আর এত সব কেচ্ছা-কাহিনীই বা যোগাড় করল কোথা থেকে? আমি তো একখানা ছুটির আর্জি লিখতে গেলেই হিমসিম খেয়ে যাই। কিন্তু লোকটা যা সব লিখেছে, এর কি সবই সত্যি? এতবড় অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে খালাসীরা লড়াই দেয় না কেন? হুঁ:! এ আবার একটা কথা হল! সিলেট নোয়াখালির আনাড়ীরা দেবে ঘুঘু, ইংরেজের সঙ্গে লড়াই-আমিও যেমন!

জাহাজের মেজো সারেঙের আজ বোধ হয় ছুটি। সিল্কের লুঙ্গি, চিকনের কুর্তা আর মুগার কাজ-করা কিস্তি টুপি পরে ডেকের ওপর টহল দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আবার আমার দিকে আড়নয়নে তাকাচ্ছেও। ডিসপ্যাচের পুঁটি ও মানওয়ারির তিমি দুইই মাছএকেই জিজ্ঞাসা করা যাক না কেন, ‘রূপদৰ্শ’ দর্শন করেছে কতটুকু আর কল্পনায় বুনেছে কতখানি!

একটুখানি গলা খাকারি দিয়ে শুধালুম, ‘ও সারেঙ সাহেব, জাহাজ লেট যাচ্ছে না। তো?’

লোকটা উত্তর দিয়ে সবিনয়ে বলল, ‘আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না। সাহেব। আমি আপনাকে দু-একবারের বেশি দেখি নি, কিন্তু আপনার আব্বা সাহেব, বড় ভাই সাহেবেরা এ-গরিবকে মেহেরবানি করেন।’

খুশি হয়ে বললুম, ‘তোমার বাড়ি কোথা? বাস-না, তার ফুরসত নেই?’ ধাপ করে ডেকের উপর বসে পড়ল।

আমি বললুম, ‘সে কী? একটা টুল নিয়ে এসো। এসব আর আজকাল—’ কথাটি শেষ করলুম না, সারেঙও টুল আনল না। তারপর আলাপ পরিচয় হল। দ্যাশের লোক— সুখ-দুঃখের কথা অবশ্যই বাদ পড়ল না। শেষটায় মোক পেয়ে ‘রূপদশী-দর্শন’। তাকে আগাগোড়া পড়ে শোনালুম। সে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার জাতভাই চাষারা যেরকম পুঁথিপড়া শোনে সে রকম আগাগোড়া শুনল, তারপর খুব লম্বা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

আল্লাতালার উদ্দেশে এক হাত কপালে ঠেকিয়ে বললে, ইনসাফের (ন্যায়ধর্মের) কথা তুললেন, হুজুর, এ-দুনিয়ায় ইনসাফ কোথায়? আর বে-ইনসাফি তো তারাই করেছে। বেশি, যাদের খুদা ধনদৌলত দিয়েছেন বিস্তর। খুদাতালাই কার জন্যে কী ইনসাফ রাখেন, তাই বা বুঝিয়ে বলবে কে? আপনি সমীরুদীকে চিনতেন, বহু বছর আমেরিকায় কাটিয়েছিল, অনেক টাকা কমিয়েছিল?’

আমেরিকার কথায় মনে পড়ল। ‘চোঁতলি পরগণায় বাড়ি, না, যেন ওই দিকেই কোনখানে।’

সারেঙ বললে, ‘আমারই গা ধলাইছড়ার লোক। বিদেশে সে যা টাকা কমিয়েছে। ওরকম কামিয়েছে অল্প লোকই! আমরা খিদিরপুরে সাইন (Sign) করে জাহাজের কামে ঢুকেছিলাম-একই দিন একই সঙ্গে।’

আম শুধালুম, ‘কী হল তার? আমার ঠিক মনে পড়ছে না।’

সারেঙ বললে, ‘শুনুন।’

‘যে লেখাটি হুজুর পড়ে শোনালেন, তার সব কথাই অতিশয় হক। কিন্তু জাহাজের কাজে, বিশেষ করে গোড়ার দিকে যে কী জান মারা খাটুনি তার খবর কেউ কখনও দিতে পারবে না যে সে জাহান্নামের ভিতর দিয়ে কখনও যায় নি। বয়লারের পাশে দাঁড়িয়ে যে লোকটা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কয়লা ঢালে, তার সর্বাঙ্গ দিয়ে কী রকম ঘাম ঝরে দেখেছেন-এই জাহাজেই যার দুদিক খোলা, পদ্মার জোর বাতাসের বেশ খানিকটা যেখানে স্বচ্ছন্দে বেশ আনাগোনা করতে পারে। এ তো বেহেশৎ। আর দরিয়ার জাহাজের গর্ভের নীচে যেখানে এঞ্জিন-ঘর, তার সব দিক বন্ধ, তাতে কখনও হাওয়া-বাতাস ঢোকে না। সেই দশ বারো চোদ্দ হাজার টনী ডাঙর ডোঙর জাহাজের বয়লারের আকারটা কত বড় হয় এবং সেই কারণে গরমিটার বহর কতখানি, সে কি বাইরের থেকে কখনও অনুমান করা যায়? খাল বিল নদীর খোলা হাওয়ার বাচ্চা আমরা-হঠাৎ একদিন দেখি, সেই জাহান্নামের মাঝখানে কালো-কালো বিরাট-বিরাট শয়তানের মত কলকব্জা, লোহালক্কড়ের মুখোমুখি।

‘পয়লা পয়লা কামে নেমে সবাই ভিরমি যায়। তাদের তখন উপরে টেনে জলের কলের নীচে শুইয়ে দেওয়া হয়, হাঁশ ফিরলে পর মুঠো মুঠো নুন গেলান হয়, গায়ের ঘাম দিয়ে সব নুন বেরিয়ে যায় বলে মানুষ তখন আর বাঁচতে পারে না।

‘কিংবা দেখবেন কয়লা ঢেলে যাচ্ছে বয়লারে ঠিক ঠিক, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, বেলচা ফেলে ছুটে চলেছে সিঁড়ির পর সিঁড়ি বেয়ে, খোকা ডেক থেকে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। অসহ্য গরমে মাথা বিগড়ে গিয়েছে, জাহাজী বুলিতে একেই বলে ‘এখম’’—’

আমি শুধালুম ‘একেই কি ইংরাজিতে বলে এমাক (amuck)? কিন্তু তখন তো মানুষ খুন করে!’

সারেঙ বললে, ‘জী হাঁ। তখন বাধা দিতে গেলে হাতের কাছে যা পায়, তা দিয়ে খুন করতে আসে।’ তারপর একটু থেমে সারেঙ বললে, ‘আমাদের সকলেরই দু-একবার হয়েছে, আর সবাই জীবড়ে ধরে চুবিয়ে আমাদের ঠাণ্ডা করেছে—শুধু সমীরুদী ককখনো একবারের তরেও কাতর হয় নি। তাকে আপনি দেখেছেন, সায়েব? বাং মাছের মত ছিল তার শরীর, অথচ হাত দিয়ে টিপলে মনে হত কচ্ছপের খোল। জাহাজের চীনা বাবুর্চির ওজন ছিল তিন মণের কাছাকাছি—তাকে সে এক থাবড়া মেরে বসিয়ে দিতে পারত। লাঠি খেলে খেলে তার হাতে জন্মেছিল বাঘের থাবার তাগিদ। কিন্তু সে যে ভিরমি যায় নি, ‘এমখ’ হয় নি, তার কারণ তার শরীরের জোর নয়-দিলের হিম্মৎ-সে মন বেঁধেছিল, যে করেই হোক পয়সা সে কামাবেই, ভিরমি গেলে চলবে না, বিমারি পাকড়ানো সখৎ মানা।’

সারেঙ বললে, ‘কী বেহদ তকলীফে জানিপানি হয়ে যে কুলুম শহরে পৌঁছলাম-’

আমি শুধুলাম, ‘সে আবার কোথায়?’

বললে, ‘বাংলায় যারে লঙ্কা কয়।’

আমি বললুম, ‘ও, কলম্বো!’

‘জী। আমাদের উচ্চারণ তো আপনাদের মত ঠিক হয় না। আমরা বলি কুলুম শহর। সেখানে ডাঙায় বেড়াবার জন্য আমাদের নামতে দিল বটে, কিন্তু যারা পয়লা বার জাহাজে বেরিয়েছে, তাদের উপর কড়া নজর রাখা হয়, পাছে জাহাজের অসহ্য কষ্ট এড়াবার জন্যে পালিয়ে যায়। সমীরুদী বন্দরে নামলেই না। বললে, নামলেই তো বাজে খরচা। আর সেকথা ঠিকও বটে, হুজুর, খালাসীরা কাঁচা পয়সা বন্দরে যা ওড়ায়! যে জীবনে কখনও পাঁচ টাকার নোট দেখে নি, আধুলির বেশি কামায় নি, তার হাতে পনের টাকা। সে তখন ক্যাগের বাচচা কেনে।

‘আমরা পেট ভরে যা খুশি তাই খেলাম। বিশেষ করে শাক-সবজি। জাহাজে খালাসীদের কপালে ও জিনিস কম। নেই বললেও হয়-দেশে যার ছড়াছড়ি।

‘তারপর কুলুম থেকে আদন বন্দর।’

আমার আর ইংরিজি ‘এইডন’ বলার দরকার হল না।

‘তারপর লাল-দরিয়া পেরিয়ে সুসোর খাড়ি—দু দিকে ধু-ধু মরুভূমি, বালু আর বালু, মাঝখানে ছোট্ট খাল।’

বুঝলুম, সুসোর খাড়ি’ মানে সুয়েজ কানাল।

‘তারপর পুসঁই। সেখানে খালের শেষ। বাড়িয়া বন্দর। আমরা শাকসবজি খেতে নামলাম সেখানে। ঝানুরা গেল খারাপ জায়গায়।’

পোর্ট সাঈদের গণিকালয় যে বিশ্ববিখ্যাত, দেখলুম, সারেঙের পো সে খপরটি রাখে। পুর্সই থেকে মার্সই, মার্সই থেকে হামবুর–জার্মানির মুলুকে।’

ততক্ষণে সিলেটি উচ্চারণে বিদেশী শব্দ কী ধ্বনি নেয়, তার খানিকটা আন্দাজ হয়ে গিয়েছে, তাই বুঝলুম, মারসেইলজ, হামবুর্গের কথা হচ্ছে। আর এটাও লক্ষ্য করলুম যে, সারেঙ বন্দরগুলোর নাম সোজা ফরাসি-জার্মান থেকে শুনে শিখেছে, তারা যে-রকম উচ্চারণ করে, ইংরিজির বিকৃত উচ্চারণের মারফতে নয়।

সারেঙ বলল, হামবুরে সব মাল নেমে গেল। সেখান থেকে আবার মাল গাদাই করে আমরা দরিয়া পাড়ি দিয়ে গিয়ে পৌঁছলুম নুউক বন্দরে–মিরকিন মুলুকে।

নিয়া ঝুনা কোন খালাসীকে নুউক বন্দরে নামতে দেয় না। বড় কড়াকড়ি সেখানে। আর হবেই বা না কেন? মিরকিন মুলুক সোনার দেশ। আমাদের মত চাষাভুষাও সেখানে মাসে পাঁচ-সাত শো টাকা কামাতে পারে। আমাদের চেয়েও কালা, একদম মিশকালা আদমীও সেখানে তার চেয়েও বেশি কামায়। খালাসীদের নামতে দিলে সব কটা ভোগে গিয়ে তামাম মুলুকে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণভরে টাকা কামাবে। তাতে নাকি মিরকিন মজুরদের জবর লোকসান হয়। তাই আমরা হয়ে রইলাম জাহাজে বন্দী।’

‘নুউক পৌঁছবার তিন দিন আগে থেকে সমীরুদ্দীর করল শক্ত পেটের অসুখ। আমরা আর পাঁচজন ব্যামোর ভান করে হামেশাই কাজে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু সমীরুদী এক ঘণ্টার তরেও কোন প্রকারের গাফিলি করে নি বলে ডাক্তার তাকে শুয়ে থাকবার হুকুম দিলে।’

‘নুউক পৌঁছবার দিন সন্ধ্যেবেলা সমীরুদী আমাকে ডেকে পাঠিয়ে কসমকিরে খাইয়ে কানে কানে বললে, সে জাহাজ থেকে পালাবে। তারপর কী কৌশলে সে পারে পৌঁছাবে, তার ব্যবস্থা সে আমায় ভাল করে বুঝিয়ে বললে।

‘বিশ্বাস করবেন না। সায়েব, কী রকম নিখুঁত ব্যবস্থা সে কত ভেবে তৈরি করেছিল। কলকাতার চোরা-বাজার থেকে সে কিনে এনেছিল একটা খাসা নীল রঙের সুট, শার্ট, টাইকলার, জুতা, মোজা।

‘আমাকে সাহায্য করতে হল। শুধু একটা পেতলের ডেগচি যোগাড় করে দিয়ে। সন্ধ্যার অন্ধকারে সমীরুদী সাঁতারের জঙিয়া পড়ে নামল জাহাজের উলটো ধার দিয়ে, খোলা সমুদ্রের দিকে। ডেগচির ভিতরে তার সুট, জুতো, মোজা আর একখানা তোয়ালে। বুক দিয়ে সেই ডেগচি ঠেলেঠেলে বেশ খানিকটা চক্কর দিয়ে সে প্রায় আধা-মাইল দূরে গিয়ে উঠবে ভাঙায়। পাড়ে উঠে, তোয়ালে দিয়ে গা মুছে, জঙিয়া ডেগচি। জলে ডুবিয়ে দিয়ে শিস দিতে দিতে চলে যাবে শহরের ভিতর। সেখানে আমাদেরই এক সিলেটি ভাইকে সে খবর দিয়ে রেখেছিল হামবুর থেকে। পুলিশের খোঁজাখুঁজি শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে গা-ঢাকা দিয়ে থাকবে কয়েকদিন তারপর দাড়িগোঁফ কামিয়ে চলে যাবে নুউক থেকে বহুদূরে, যেখানে সিলেটিরা কাঁচা পয়সা কামায়। পালিয়ে ডাঙায় উঠতে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার যে কোন ভয় ছিল না তা নয়, কিন্তু একবার সুটটি পরে রাস্তায় নামতে পারলে পুলিশ দেখলেও ভাববে, সে নুউকবাসিন্দা, সমুদ্রপারে এসেছিল হাওয়া খেতে।

‘পেলেনটা ঠিক উতরে গেল, সায়েব। সমীরুদ্দীর জন্য খোজ-খোঁজ রব উঠল। পরের দিন দুপুরবেলা। ততক্ষণে চিড়িয়া যে শুধু উড় গিয়া তা নয়। সে বনের ভিতর বিলকুল উধাও। একদম না-পাত্তা। বরঞ্চ বনের ভিতর পাখিকে পেলেও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু নুউক শহরের ভিতর সমীরুদীকে খুঁজে পাবে কোন পুলিশের গোসাঁই?’

গল্প বলায় ক্ষান্ত দিয়ে সারেঙ গেল জোহরের নমাজ পড়তে। ফিরে এসে ভূমিকা না। দিয়েই সারেঙ বললে, ‘তারপর হুজুর আমি পুরো সাত বচ্ছর জাহাজে কটাই। দু-পাঁচবার খিদিরপুরে নেমেছি বটে, কিন্তু দেশে যাবার আর ফুরসৎ হয়ে ওঠে নি। আর কী-ই বা হত গিয়ে, বাপ-মা মরে গিয়েছে, বউ-বিবিও তখন ছিল না। যতদিন বেঁচে ছিল, বাপকে মাঝে মাঝে টাকা পাঠাতাম-বুড়া শেষের কি বছর সুখেই কাটিয়েছে-খুদাতালার শুকুর-বুড়ি নাকি আমার জন্য কাঁদত। তা হুজুর দরিয়ার অথৈ নোনা পানি যাকে কাতর করতে পারে না, বুড়ির দু ফোঁটা নোনা জল তার আর কী করতে পারে বলুন!’

বলল বটে হক কথা, তবু সারেঙের চোখেও এক ফোঁটা নোনা জল দেখা দিল।

সারেঙ বললে, যাক সে কথা। এ সাত বছর মাঝে মাঝে এর মুখ থেকে ওর মুখ থেকে খবর কিংবা গুজব, যাই বলুন, শুনেছি, সমীরুদী বহুত পয়সা কমিয়েছে, দেশেও নাকি টাকা পাঠায়, তবে সে আস্তানা গেড়ে বসেছে মিরকিন মুলুকে, দেশে ফেরার কোন মতলব নেই। তাই নিয়ে আমি আপসোস করি নি, কারণ খুদাতালা যে কার জন্য কোন মুলুকে দানাপানি রাখেন, তার হদিস বাতিলাবে কে?

‘তারপর কল-ঘরের তেলে-পিছল মেঝেতে আছাড় খেয়ে ভেঙে গেল আমার পায়ের হাডি। বড় জাহাজের কম ছেড়ে দিয়ে দেশে ফিরে এসে ঢুকলাম ডিসপ্যাঁচারের কামে। এজাহাজে আসার দুদিন পরে, একদিন খুব ভোরবেলা ফজরের নমাজের ওজু করতে যাচ্ছি, এমন সময় তাজ্জব মেনে দেখি, ডেকে বসে রয়েছে সমীরুদ্দী! বুকে জীবড়ে ধরে তাকে বললাম, ভাই সমীরুদ্দী! এক লহমায় আমার মনে পড়ে গেল, সমীরুদীকে এককালে আমি আপনার ভাইয়ের মতন কতই না প্যার করেছি।

‘কিন্তু তাকে হঠাৎ দেখতে পাওয়ার চেয়েও বেশি তাজ্জব লাগিল আমার, সে আমার প্যারে কোন সাড়া দিল না বলে। গাঙের দিকে মুখ করে পাথরের পুতুলের মত বসে রইল সে। শুধালাম, ‘তোর দেশে ফেরার খবর তো আমি পাই নি। আবার এ জাহাজে করে চলেছিস তুই কোথায়? কলকাতা? কেন? এদেশে মন টিকল না?’

‘কোন কথা কয় না। ফকির-দরবেশের মত বসে রইল ঠিায়, তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে, যেন আমাকে দেখতেই পায় নি।

‘বুঝলাম কিছু একটা হয়েছে। তখনকার মত তাকে আর কথা কওয়াবার চেষ্টা না করে, ঠেলোঁঠুলে কোন গতিকে তাকে নিয়ে গেলাম। আমার কেবিনে। নাশতার পেলেট সামনে ধরলাম, আণ্ডা ভাজা ও পরটা দিয়ে সাজিয়ে-ওই খেতে সে বড় ভালবাসতকিছু মুখে দিতে চায় না। তবু জোর করে গেলালাম, বাচ্চাহারা মাকে মানুষ যে রকম মুখে খাবার ঠেসে দেয়, কিন্তু হুজুর, পরের জন্য অনেক কিছু করা যায়, জানতক কুরবানি দিয়ে তাকে বাঁচানো যায়, কিন্তু পরের জন্য খাবার গিলি কী করে?

‘সেদিন দুপুরবেলা তাকে কিছুতেই গোয়ালন্দে নামতে দিলাম না। আমার, হুজুর, মনে পড়ে গেল বহু বৎসরের পুরনো কথা-নুউক বন্দরেও আমাদের নামতে দেয় নি, তখন সমীরুদী সেখানেই গায়েব হয়েছিল।

‘রাত্রের অন্ধকারে সমীরুদীর মুখ ফুটিল।

‘হঠাৎ নিজের থেকেই বলতে আরম্ভ করল, কী ঘটেছে।’

সারেঙ দম নেবার জন্য না অন্য কোন কারণে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল বুঝতে পারলুম না। আমিও কোন খোঁচা দিলুম না। বললে, ‘তা সে দুঃখের কাহিনী—ঠিক ঠিক বলি কী করে সাহেব? এখনও মনে আছে, কেবিনের ঘোরাঘুটি অন্ধকারে সে আমাকে সবকিছু বলেছিল। এক-একটা কথা যেন সে অন্ধকার ফুটো করে আমার কানে এসে বিন্ধেছিল, আর অতি অল্প কথায়ই সে সব কিছু সেরে দিয়েছিল।

‘সাত বছরে সে প্রায় বিশ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল দেশে তার ছোট ভাইকে। বিশ হাজার টাকা কতখানি হয়, তা আমি জানি নে, একসঙ্গে কখনও চোখে দেখি নি-’

আমি বললুম, ‘আমিও জানি নে, আমিও দেখি নি।’

‘তবেই বুঝুন হুজুর, সেটাকা কামাতে হলে কটা জানি কুরবানি দিতে হয়।

‘প্ৰথম পাঁচশো টাকা পাঠিয়ে ভাইকে লিখলে, মহাজনের টাকা শোধ দিয়ে বাড়ি ছাড়াতে। তার পরের হাজার দেড়েক বাড়ির পাশের পতিত জমি কেনার জন্য। তারপর আরও অনেক টাকা দিঘি খোদাবার জন্য, তারপর আরও বহুত টাকা শহুরী ঢঙে পাকা চুনকাম করা দেয়াল-ওলা টাইলের চারখানা বড় ঘরের জন্য, আরও টাকা ধানের জমি, বলদ, গাই, গোয়ালঘর, মরাই, বাড়ির পিছনে মেয়েদের পুকুর, এসব করার জন্য এবং সর্বশেষে হাজার পাঁচেক টাকা। টঙি ঘরের উল্টোদিকে দিঘির এপারে পাকা মসজিদ বানাবার জন্য।

‘সাত বছর ধরে সমীরুদী মিরকিন মুলুকে, অসুরের মত খেটে দু শিফটু আড়াই শিফ্‌টে গতর খাটিয়ে জান পানি করে পয়সা কামিয়েছে, তার প্রত্যেকটি কড়ি হালালের রোজাকার, আর আপন খাই-খরচার জন্য সে যা পয়সা খরচ করেছে, তা দিয়ে মিরকিন মুলুকের ভিখারিরও দিন গুজরান হয় না।

‘সব পয়সা সে ঢেলে দিয়েছে বাড়ি বানাবার জন্য, জমি কেনার জন্য। মিরকিন মুলুকের মানুষ যে-রকম চাষবাসের খামার করে, আর ভদ্রলোকের মত ফ্যাশানের বাড়িতে থাকে, সে দেশে ফিরে সেই রকম করবে বলে।

‘ওদিকে ভাই প্ৰতি চিঠিতে লিখেছে, এটা হচ্ছে, সেটা হচ্ছে-করে করে যেদিন সে খবর পেল মসজিদ তৈরি শেষ হয়েছে, সেদিন রওয়ানা দিল দেশের দিকে। নুউক বন্দরে জাহাজে কাজ পায় আনাড়ী কালা আদিমও বিনা তাকলিফে। তার ওপর সমীরুদী হরেক রকম কারখানার কাজ করে করে কলকব্জা এমনি ভাল শিখে গিয়েছিল যে, তারই সার্টিফিকেতের জোরে, জাহাজে আরামের চাকরি করে ফিরল খিদিরপুর। সন্ধ্যের সময় জাহাজ থেকে নেমে সোজা চলে গেল শেয়ালদা। সেখানে প্লাটফর্মে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে চাটগাঁ মেল ধরে শ্ৰীমঙ্গল স্টেশনে পৌঁছল রাত তিনটোয়। সেখান থেকে হেঁটে রওয়ানা দিল ধলাইছড়ার দিকে—আট মাইল রাস্তা, ভোর হতে না-হতেই বাড়ি পৌঁছে যাবে।

‘রাস্তা থেকে পোয়াটাক মাইল ধানক্ষেত, তারপর ধলাইছড়া গ্রাম। আলোর উপর দিয়ে গ্রামে পৌঁছতে হয়।

‘বিহানের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে সমীরুদী পৌঁছল ধানক্ষেতের মাঝখানে।

‘মসজিদের একটা উঁচু মিনার থাকার কথা ছিল—কারণ মসজিদের নকশাটা সমীরুদীকে করে দিয়েছিলেন এক মিশরী ইঞ্জিনিয়ার, আর হুজুরও মিশর মুলুকে বহুকাল কাটিয়েছেন, তাদের মসজিদে মিনারের বাহার হুজুর দেখেছেন, আমাদের চেয়ে ঢের বেশি।

‘কত দূর-দরাজ থেকে সে-মিনার দেখা যায়, সে আপনি জানেন, আমিও জানি সমীরুদ্দীও জানে।’

মিনার না দেখতে পেয়ে সমরুদী আশ্চর্য হয়ে গেল, তারপর ক্ৰমে ক্রমে এগিয়ে দেখে—কোথায় দিঘি, কোথায় টাইলের টঙি ঘর!’

আমি আশ্চর্য হয়ে শুধালাম, ‘সে কী কথা!’

সারেঙ যেন আমার প্রশ্ন শুনতে পায় নি। আচ্ছন্নের মত বলে যেতে লাগল, ‘কিছু না, কিছু না, সেই পুরনো ভাঙা খড়ের ঘর, আরও পুরনো হয়ে গিয়েছে। যেদিন সে বাড়ি ছেড়েছিল, সেদিন ঘরটা ছিল চারটা বাঁশের ঠেকনায় খাড়া, আজ দেখে ছটা ঠেকনা। তবে কি ছোট ভাই বাড়ি-ঘরদের গায়ের অন্য দিকে বানিয়েছে? কই, তা হলে তো নিশ্চয়ই সেকথা কোন-না-কোন চিঠিতে লিখত। এমন সময় দেখে গায়ের বাসিত মোল্লা। মোল্লাজী আমাদের সবাইকে বড় প্যার করে। সমীরুদীকে আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

‘প্রথমটায় তিনিও কিছু বলতে চান নি। পরে সমীরুদ্দীর চাপে পড়ে সেই ধানক্ষেতের মধ্যিখানে তাকে খবরটা দিলেন। তার ভাই সব টাকা ফুঁকে দিয়েছে। গোড়ার দিকে শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, মৌলবীবাজারে, শেষের দিকে কলকাতায়—ঘোড়া, মেয়েমানুষ আরও কত কী?’

আমি থাকতে না পেরে বললুম, ‘বল কী সারেঙ! এ-রকম ঘা মানুষ কি সইতে পারে? কিন্তু বল দিকিনী, গায়ের কেউ তাকে চিঠি লিখে খবরটা দিলে না কেন?’

সারেঙ বললে, ‘তারাই বা জানবে কি করে, সমীরুদী কেন টাকা পাঠাচ্ছে। সমীরুদীর ভাই ওদের বলেছে, বড় ভাই বিদেশে লাখ টাকা কামায়, আমাকে ফুর্তি-ফার্তির জন্য তারই কিছুটা পাঠায়। সমীরুদ্দীর চিঠিও সে কাউকে দিয়ে পড়ায় নি—সমীরুদ্দি নিজে আমারই মত লিখতে পড়তে জানে না, কিন্তু হারামজাদা ভাইটাকে পাঠশালায় পাঠিয়ে লেখাপড়া শিখিয়েছিল। তবু মোন্নাজী আর গায়ের পাঁচজন তার টাকা ওড়াবার বহর দেখে তাকে বাড়িঘরদের বাঁধতে, জমি-খামার কিনতে উপদেশ দিয়েছিলে। সে নাকি উত্তরে বলেছিল, বড় ভাই বিয়ে শান্দি করে মিরকিন মুলুকে গোরস্থালী পেতেছে, এ দেশে আর ফিরবে না, আর যদি ফেরেই বা, সঙ্গে নিয়ে আসবে লাখ টাকা। তিন দিনের ভিতর দশখানা বাড়ি হাঁকিয়ে দেবে।’

আমি বললুম, ‘উঃ! কী পাষণ্ড! তারপর?’

সারেঙ বললে, সমীরুদী আর গায়ের ভিতর ঢেকে নি। সেই ধানক্ষেত থেকে উঠে ফিরে গেল। আবার শ্ৰীমঙ্গল স্টেশনে। সমীরুদী আমাকে বলে নি কিন্তু মোল্লাজী নিশ্চয়ই তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিলেন, কিন্তু সে ফেরে নি। শুধু বলেছিল, যেখান থেকে এয়েছে, সেখানেই আবার ফিরে যাচ্ছে।

নিয়ে এলেন স্টেশনে—টাকা ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে সে গায়েই ছিল। সমীরুদ্দীর দু পা জড়িয়ে ধরে সে মাপ চেয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে। আরও পাঁচজন বললেন, বাড়ি চল, ফের মিরকিন যাবি তো যাবি, কিন্তু এতদিন পরে দেশে এসেছিস, দুদিন জিরিয়ে যা।’

আমি বললুম, ‘রাস্কেলটা কোন মুখ নিয়ে ভাইয়ের কাছে এল সারেঙ?’

সারেঙ বললে, ‘আমিও তাই পুছি। কিন্তু জানেন সায়েব, সমীরুদী কী করলে? ভাইকে লাথি মারলে না, কিছু না, শুধু বললে সে বাড়ি ফিরে যাবে না।

‘তার পরদিন ভোরবেলা এই জাহাজে তার সঙ্গে দেখা। আপনাকে তো বলেছি, শাবন্দরের বারুণীর পুতুলের মত চুপ করে বসে।’

দম নিয়ে সারেঙ বললে, ‘অতি অল্প কথায় সমীরুদী আমাকে সব কিছু বলেছিল। কিন্তু হুজুর, শেষটায় সে যা আপন মনে বিড়বিড় করে বলেছিল, তার মানে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি। তবে কথাগুলো আমার স্পষ্ট মনে আছে। সে বলেছিল, ‘ভিখিরি স্বপ্নে দেখে সে বড়লোক হয়ে গিয়েছে, তারপর ঘুম ভাঙতেই সে দেখে সে আবার দুনিয়ায়। আমি দেশে টাকা পাঠিয়ে বাড়ি ঘরদোর বানিয়ে হয়েছিলাম বড়লোক, সেই দুনিয়া যখন ভেঙে গেল তখন আমি গোলাম কোথায়?’

বাস্তব ঘটনা না হয়ে যদি শুধু গল্প হত, তবে এইখানেই শেষ করা যেত। কিন্তু আমি যখন যা শুনেছি তাই লিখছি তখন স্যারেঙের বাদবাকি কাহিনী না বললে অন্যায় হবে।

সারেঙ বললে, ‘চৌদ্দ বছর হয়ে গিয়েছে কিন্তু আমার সর্বক্ষণ মনে হয় যেন কাল সাঁঝে সমীরুদ্দী আমার কেবিনের অন্ধকার তার ছাতির খুন ঝরিয়েছিল।

‘কিন্তু ওই যে ইনসাফ বললেন না হুজুর তার পাত্তা দেবে কে?’

সমীরুদী মিরকিন মুলুকে ফিরে গিয়ে দশ বছরে আবার তিরিশ হাজার টাকা কামায়। এবারে আর ভাইকে টাকা পাঠায় নি। সেই ধন নিয়ে যখন দেশে ফিরছিল তখন জাহাজে মারা যায়। ত্রিসংসারে তার আর কেউ ছিল না বলে টাকাটা পৌঁছল সেই ভাইয়েরই কাছে। আবার সে টাকাটা ওড়াল।’

ইনসাফ কোথায়?

নোনামিঠা

ব্যারোমিটার দেখে, কাগজপত্র ঘেঁটে জানা যায়, লাল-দরিয়া এমন কিছু গরম জায়গা নয়। জেক্কাবাদ পেশওয়ার দূরে থাক, যাঁরা পাটনা-গয়ার গরমটা ভোগ করেছেন তারা আবহাওয়া-দপ্তরে তৈরি লাল-দরিয়ার জন্ম-কুণ্ডলী দেখে বিচলিত তো হবেনই না, বরঞ্চ ঈষৎ মৃদু হাস্যও করবেন। আর উন্নাসিক পর্যটক হলে হয়তো প্রশ্ন করেই বসবেন, হালকা আলসটারটার দরকার হবে না তো!’

অথচ প্রতিবারেই আমার মনে হয়েছে, লাল-দরিয়া আমাকে যেন পার্ক সার্কাসের হোটেলে খোলা আগুনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শিক-কাবাব ঝলসাচ্ছে। ভুল বললুম, মনে হয়েছে, যেন হাঁড়িতে ফেলে, ঢাকনা লেই দিয়ে সেঁটে আমাকে দম-পুখতের’ রান্না বা ‘পুটপঙ্ক’ করেছে। ফুটবলীদের যে রকম ‘বগি-টিম’ হয়, লাল-দরিয়া আমার ‘বগি-সী।’

সমস্ত দিনটা কাটাই জাহাজের বৈঠকখানায় হাঁপাতে হাঁপাতে আর বরফভর্তি গেলাসটা কপালে ঘাড়ে নাকে ঘষে ঘষে, আর রাতের তিনটে যামই কটাই রকে অর্থাৎ ডেকে তারা গুনে গুনে। আমার বিশ্বাস ভগবান লাল-দরিয়া গড়েছেন। চতুর্থ ভূতকে বাদ দিয়ে। ওর সমুদ্রে যদি কখনও হাওয়া বয় তবে নিশ্চয়ই কিম্ভুতই বলতে হবে।

তাই সে রাত্রে ব্যাপারটা আমার কিন্তুত বলেই মনে হল।

ডেকা-চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ঠিক ঘুম নয়, তন্দ্ৰা। এমন সময় কানে এল, সেই লাল-দরিয়ায়, দেশ থেকে বহু দূরের সেই সাত সমুদ্রের এক সমুদ্রে–সিলেটের বাঙাল ভাষা। স্বপ্নই হবে। জানতুম, সে-জাহাজে আমি ছাড়া আর কোন সিলেটি ছিল না। এ-রকম মরমিয়া সুরে মাঝ রাতে, কে কাকে ‘ভাই, হি কথা যদি তলচস’—বলতে যায়? খেয়ালীপোলাও চাখতে, আকাশ-কুসুম শুকতে, স্বপ্নের গান শুনতে কোনও খরচা নেই; তই ভাবলুম চোখ বন্ধ করে স্বপ্নটা আরও কিছুক্ষণ ধরে দেখি।

কিন্তু ওই তো স্বপ্নের একটিমাত্র দোষ। ঠিক যখন মনে হবে, বেশ জমে আসছে, ঠিক তখনই ঘুমটি যাবে ভেঙে। স্থলেও সে আইনের ব্যত্যয় হল না। চোখ খুলে দেখি, সামনেআমার দিকে পিছন ফিরে দুজন খালাসী চাপা গলায় কথা বলছে।

বেচারীরা। রাত বারোটার পর এদের অনুমতি আছে ডেকে আসবার। তাও দল বেঁধে নয়। বাকী দিনের অসহ্য গরম তাদের কাটাতে হয়। জাহাজের পেটের ভিতরে।

সিলেট-নোয়াখালির লোক যে পৃথিবীর সর্বত্রই জাহাজে খালাসীর কাজ করে সে-কথা আমার অজানা ছিল না। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, তারা কাজ করে মাল-জাহাজেই; এ ফরাসি যাত্রী-জাহাজে রাত্রি দ্বিপ্রহরে, তাও আমার নোয়াখলি চাটগাঁয়ের নয়, একদিম খাঁটি আমার আপনি দেশ সিলেটের লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে তার সম্ভাবনা স্বপ্নেই বেশি, বাস্তবে কম।

এরা কথা বলছিল খুবই কম। যেটুকু শুনতে পেলুম, তার থেকে কিন্তু এ-কথাটা স্পষ্ট বোঝা গেল, এদের একজন এই প্রথম জাহাজের কামে’ ঢুকেছে এবং দেশের ঘরবাড়ির জন্য তার মন বড্ড উতলা হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গী পুরনো লোক; নতুন বউকে যে-রকম বাপের বাড়ির দাসী সান্ত্বনা দেয় এর কথার ধরন অনেকটা সেই রকমের।

আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছিলুম। শেষটায় যখন দেখলুম ওরা উঠি-উঠি করছে তখন আমি কোনও প্রকারের ভূমিকা না দিয়েই হঠাৎ অতি খাঁটি সিলেটিতে জিজ্ঞেস করলুম, ‘তোমাদের বাড়ি সিলেটের কোন গ্রামে?’

সিলেটের খালাসীরা দুনিয়ায় তাবৎ দরিয়ার মাছের মত কিলবিল করে এ-সত্য সবাই জানে, কিন্তু তার চেয়ে ঢের সত্য-সিলেটের ভদ্রসন্তান পারতপক্ষে কখনও বিদেশ যায় না। তাই লাল-দরিয়ার মাঝখানে সিলেটি শুনে আমার মনে হয়েছিল, ওটা স্বপ্ন; সেইখানে সিলেটি ভদ্রসন্তান দেখে ওদের মনে হল, আজ মহাপ্ৰলয় (কিয়ামতের দিন) উপস্থিত। শাস্ত্রে আছে, ওই দিনই আমাদের সকলের দেখা হবে এক-ই জায়গায়; ভূত দেখলেও মানুষ অতখানি লাফ দেয় না। দুজন যেভাবে একই তালে-লিয়ে লাফ দিল তা দেখে মনে হল ওরা যেন এই কর্মটি বহুদিন ধরে মহড়া দিয়ে আসছে।

উভয় পক্ষ কথঞ্চিৎ শান্ত হওয়ার পর আমি সিগারেট-কেস খুলে ওদের সামনে ধরলুম। দুজনেই একসঙ্গে কানে হাত দিয়ে জিভ কাটল। আমাকে তারা চেনে না বটেআমি দেশ ছেড়েছি ছেলেবেলায়-তবে আমার কথা তারা শুনেছে এবং আমার বাপ-ঠাকুর্দার পায়ের ধুলো তার বিস্তর নিয়েছে, খুদাতালার বেহদ্‌ মেহেরবানি আজ তারা আমার দর্শন পেল, আমার সামনে ওসব —তওবা, তওবা ইত্যাদি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার দেশের চাষারা ইয়োরোপীয় চাষার চেয়ে ঢের ভদ্র।

খালাসী-জীবনের কষ্ট এবং আর পাঁচটা সুখ-দুঃখের কথাও হল। দুঃখের কথাই পনের আনা তিন পয়সা। বাকী এক পয়সা সুখ—অর্থাৎ মাইনেটা, সেই এক পয়সাই পাঁচাত্তর টাকা। ওই দিয়ে বাড়িঘর ছাড়াবে, জমি-জমা কিনবে।

শেষটায় শেষ প্রশ্ন শুধালুম, ‘আহারাদি?’ রাত তখন ঘনিয়ে এসেছে।

বললে, ‘ওই তো আসল দুঃখ হুজুর। আমি তো তবু পুরোন লোক। পাউরুটি আমার গলায় গিট বাঁধে। না। কিন্তু এই ছেলেটার জান পাস্তাভাতে পোতা। পাস্তাভাত! ভাতেরই নেই খোঁজ, ও চায় পাস্তাভাত। মূলে নেই ঘর, পূব দিয়া তিন দোর। হুঁঃ।’

আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘সে কী কথা! আমি তো শুনেছি, আর কিছু না হোক তোমাদের ডাল ভাত প্রচুর খেতে দেয়। জাহাজের কাম করে কেউ তো কখনও রোগ হয়ে দেশে ফেরে নি!’

বললে, ‘ঠিকই শুনেছেন সায়েব। কিন্তু ব্যাপার হয়েছে কী, কোনও কোনও বন্দরে চাল এখন মাগগি। সারেঙ আমাদের রুটি খাইয়ে চাল জমাচ্ছে ওই সব বন্দরে লুকিয়ে চাল বিক্রি করবে বলে। সারেঙ দেশের জাতভাই কি না, না হলে অমন মারার কৌশাল জানবে কী করে?’

আমি বললুম, ‘নালিশ ফরিয়াদ কর নি?’

বললে, ‘কে বোঝে কার বুলি? এদের ভাষা কি জানি ‘ফ্রিঞ্চি’ না কী, সারেঙই একটুখানি বলতে পারে। ইংরিজি হলেও না হয় আমাদের মুরুর্কীদের কেউ কেউ ওপরওয়ালদের জানাতে পারতেন। ওই তো সারেঙের কল! ধন্যি জাহাজ; ব্যাটারা শুনেছি কোলা ব্যাঙ ধরে ধরে খায়। সেলাম সায়েব, আজ উঠি! দেরি হয়ে গিয়েছে। আপনার কথা শুনে জানটা–’

আমি বললাম, ‘বাস, বাস।’

মাঝরাতের স্বপ্ন আর শেষরাতের ঘটনা মানুষ নাকি সহজেই ভুলে যায়। আমার আবার চমৎকার স্মৃতিশক্তি-সব কথাই ভুলে যাই। তাই ভাতের কেচ্ছা মনে পড়ল, দুপুরবেলা লাঞ্চের সময় রাইস-কারি দেখে।

জাহাজটা ফরাসিস, ফরাসিসে ভর্তি। আসলে এটা ইন্ডো-চীন থেকে ফরাসি সেপাই লস্কর লাদাই করে ফ্রান্স যাবার মুখে পণ্ডিচেরিতে একটা ঢু মেরে যায়। প্যাসেঞ্জার মাত্রই পল্টনের লোক, আমরা গুটিকয়েক ভারতীয়ই উটকো মাল। খানাটেবিলে আমার পাশে বসত একটি ছোকরা সূলিয়োৎনা—অর্থাৎ সাব অলটার্ন। আমার নিতান্ত নিজস্ব মৌলিক ফরাসিতে তাকে রাত্রের ঘটনাটি গল্পচ্ছলে নিবেদন করলুম।

শুনে সে তো মহা উত্তেজিত। আমি অবাক! ছুরি কাঁটা টেবিলে রেখে, মিলিটারি গলায় বাঁজ লাগিয়ে বলতে শুরু করলে, ‘এ ভারি অন্যায়, অত্যন্ত অবিচার, ইনুই-অনহার্ড-অব–ফাতাস্তিক-ফেনটাসটিক আরও কত কী!’

আমি বললুম, ‘রোস রোস। এত গরম হচ্ছে কেন? এ অবিচার তো দুনিয়ায় সর্বত্রই হচ্ছে, আকছারই হচ্ছে। এই যে তুমি ইন্দোচীন থেকে ফিরছ, সেখানে কি কোন ড্যানিয়েলগিরি করতে গিয়েছিলে, যে গার্সে (বাছ)। ওসব কথা থাক, দুটি খাও।’

ছোকরাটির সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল বলেই কথাটা বলবার সাহস হয়েছিল। বরঞ্চ ইংরেজকে এ-সব কথা বলবেন, ফরাসিকে বললে হাতাহাতি বোতল-ফাটাফাটির সম্ভাবনাই বেশি।

চুপ মেরে একটু ভেবে বললে, ‘হঃ। কিন্তু এস্থলে তো দোষী তোমারই জাতভাই ইন্ডিয়ান সারেঙ!’

আমি বিষম খেয়ে বললুম, ‘ওই-যা-যা!’

 

পৃথিবীতে এমন কোন দেশ এখনও দেখলুম না যেখানে মানুষ সুযোগ পেলে দুপুরবেলা ঘুমোয় না। তবু কেন বাঙালির ধারণা যে, সে-ই এ ধনের একমাত্র অধিকারী, এখনও বুঝে উঠতে পারি নি। আপনি আপন ডেকচেয়ারে শুয়ে, চোখে ফেটা মেরে আর পাঁচটি ফরাসিসের সঙ্গে কোরাসে। ওই কর্মটি সবেমাত্র সমাধান করেছি, এমন সময় উর্দি-পরা এক নৌ-অফিসার আমার সামনে এসে অতিশয় সৌজন্য সহকারে অবনত মস্তকে যেন প্রকাশ্যে আত্মচিন্তা করলেন, ‘আমি কি মসিয়ো অমুকের সঙ্গে আলাপ করার আনন্দ করছি?’

আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে উঠে, আরও অবনত মস্তকে বললুম, ‘আদপেই না। এ শ্লাঘা সম্পূর্ণ আমার-ই।’

অফিসার বললেন, মসিয়ো ল্য কমাদ-জাহাজের কাপ্তান সাহেব—সিয়োকে–আমাকে–তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ আনন্দাভিবাদন জানিয়ে প্রার্থনা করছেন যে, তিনি যদি মসিয়োর উপস্থিতি পান তবে উল্লসিত হবেন।’

পাপাত্মা আমি। ভয়ে আঁতকে উঠলুম। আবার কী অপকর্ম করে ফেলেছি যে, মসিয়ো ল্য কমাদাঁ আমার জন্য হুলিয়া জারি করেছেন। শুকনো মুখে টোক গিলে বললুম, ‘সেই হবে আমার এ-জীবনের সব চেয়ে বড় সম্মান। আমি আপনার পথপ্রদর্শনের জন্য ব্যাকুল।’

মসিয়ো ল্য কমাদাঁ যদিও যাত্রী-জাহাজের কাপ্তান, তবু দেখলুম তার ঠোঁটের উপর ভাসছে আর-একখানি জাহাজ এবং সেটা সবপ্রকার বিনয় এবং স্তুতিস্তোকবাক্যে টৈটম্বর লাদাই। ভদ্রতার মানওয়ারী বললেও অত্যুক্তি হয় না। তবে মোদ্দা কথা যা বললেন, তার অর্থ আমার মত বহুভাষী পণ্ডিত ত্ৰিভুবনে আর হয় না, এমন কী প্যারিসেও হয় না।

এত বড় একটা মারাত্মক ভ্ৰমাত্মক তথ্য তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন এই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করব করব করছি, এমন সময় তার কথার তোড় থেকেই বেরিয়ে গেল, তিনি তিনশো তিরানব্বই বার পৃথিবী প্ৰদক্ষিণ করে এই প্রথম একটি মহাপণ্ডিত আবিষ্কার করেছেন, যিনি তার খালাসীদের কিচির-মিচিরের একটা অর্থ বের করতে পারেন। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তা হলে আমার মত আরও বহু লক্ষ পণ্ডিত সিলেট জেলায় আছেন। তারপর তিনি অনুরোধ করলেন, আমি যদি দয়া করে তার খালাসীদের অসন্তুষ্টির কারণটি খোলসা করে বর্ণনা করি, তবে তিনি বড় উপকৃত হন। আমি তা-ই করলুম। তখন সেই খালাসীদের আর সারেঙের ডাক পড়ল। তারা কুরবানির পাঠার মত কাঁপিতে কাঁপিতে উপস্থিত হল।

কাপ্তান আর জজ ভিন্ন শ্রেণীর প্রাণী। সাক্ষীর বয়স কত, সেই আলোচনায় জজেরা হেসে-খেলে সাতটি দিন কাটিয়ে দেন; কাপ্তানরা দেখলুম, তিন-মিনিটেই ফাঁসির হুকুম দিতে পারেন। মসিয়ো ল্য কমার্দো অতি শাস্তকণ্ঠে এবং প্রাঞ্জল ফরাসিতে সারেঙকে বুঝিয়ে দিলেন, ভবিষ্যতে তিনি যদি আর কখনও এরকম কেলেঙ্কারির খবর পান, তবে তিনি একটিমাত্র বাক্যব্যয় না করে সারেঙকে সমুদ্রের জলে ফেলে তার উপর জাহাজের প্রপেলারটি চালিয়ে দেবেন।

যাক। বাঁচা গেল। মরবে তো সারেঙটা!

পানির পীর বদর সায়েব। তাঁর কৃপায় রক্ষা পেয়ে ‘বদর বদর’ বলে কেবিনে ফিরলুম।

খানিকক্ষণ পর চীনা কেবিন-বয়, তার নিজস্ব ফরাসিতে বলে গেল, খালাসীরা আমাকে অনুরোধ জানিয়েছে আজ যেন আমি মেহেরবানি করে কেবিনে বসে তাদের পাঠানো ‘ডাল-ভাত’ খাই।

গোয়ালন্দী জাহাজের মামুলী রাইস-কারি খেয়েই আপনারা আ-হা-হা করেন, সেই জাহাজের বাবুর্চিরা যখন কোর্মা কালিয়া পাঠায়, তখন কী অবস্থা হয়? নাঃ, বলব না। দুএকবার ভোজনের বর্ণনা করার ফলে শহরে আমার বদনাম রটে গিয়েছে, আমি পেটুক এবং বিশ্বনিন্দুক। আমি শুধু অন্যের রন্ধনের নিন্দা করতেই জানি। আমার ভয়ঙ্কর রাগ হয়েছে। তামা-তুলসী স্পর্শ করে এই শপথ করলুম-না, থাক, আপনার আমার বাড়িতে মাবোনদের আমি একটি লাস্ট চান্স দিলুম।

কাপ্তান সাহেব আমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে আছেন। খালাসীরা তাই এখন নিৰ্ভয়ে খাবার নিয়ে আমার কেবিনে আসে।

এমনি করে জাহাজের শেষ রাত্ৰি উপস্থিত হল। সে রাত্রের খালাসীদের তৈরি গ্যালা ব্যানকুয়েট খেয়ে যখন বাঙ্কে এ-পাশ ও-পাশ করছি, এমন সময় খালাসীদের মুরুঝবীটি আমার পায়ের কাছটায় পাটাতনে বসে হাতজোড় করে বললে, ‘হুজুর, একটি নিবেদন আছে।’

মোগলাই খানা খেয়ে তখন তবিয়ত বেজায় খুশ। মোগলাই কণ্ঠেই ফরমান জারি করলুম, নিৰ্ভয়ে কও।’

বললে, ‘হুজুর ইটা পরগণার ঢেউপাশা গায়ের নাম শুনেছেন?’

আমি বললুম, আলবত! মনু গাঙ্গের পারে।’

বললে, ‘আহা, হুজুর সব জানেন।’

মনে মনে বললুম, হায়, শুধু কাপ্তান আর খালাসীরাই বুঝতে পারল আমি কত বড় বিদ্যোসাগর। যারা বুঝতে পারলে আজ আমার পাওনাদারদের ভয় ঘুচে যেত তারা বুঝল না।’

বললে, ‘সেই গ্রামের করীম মুহম্মদের কথাই আপনাকে বলতে এসেছি, হুজুর। করীম ব্যাটা মহাপাষণ্ড, চোদ্দ বছর ধরে মোর্সই (মার্সেলেস) বন্দরে পড়ে আছে। ওদিকে বুড়ি মা কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো কানা করে ফেলেছে, কত খবর পাঠিয়েছে। হা-কিছুতেই দেশে ফিরবে না। চিঠিপত্রে কিছু হল না দেখে আমরা বন্দরে নেমে তার বাড়ি গিয়েছিলাম, তাকে বোঝাবার জন্য। ব্যাটার বউ এক রেঙখোকী, এমন তাড়া লাগালে যে আমরা পাঁচজন মন্দা মানুষ প্রাণ বাঁচিয়ে পালাবার পথ পাই নে। তবে শুনেছি, মেয়ে-মানুষটা প্রথম প্রথম নাকি তার ভাতারের দেশের লোককে আদর-কদর করতে। যবে থেকে বুঝেছে আমরা তাকে ভাঙচি দিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার তালে আছি, সেই থেকে মারমুখে খাণ্ডার হয়ে আছে।’

আমি বললুম, ‘তোমরা পাঁচজন লেঠেল যে-কর্মটি করতে পারলে না, আমি সেইটে পারব? আমাকে কি গামা পাহলওয়ান ঠাউরেছ?’

বললে, ‘না, হুজুর, আপনাকে কিছু বলবে না। আপনি সুট টাই পরে গেলে ভাববে আপনি এসেছেন। অন্য কাজে। আমাদের লুঙ্গি আর চেহারা দেখেই তো বেটি টের পেয়ে যায়, আমরা তার ভাতারের জাত-ভাই। আপনি হুজুর, মেহেরবানি করে ‘না’ বলবেন না, আপনার যে কতখানি দয়ার শরীর সে-কথা বেবাক খালাসী জানে বলেই আমাকে তারা পাঠিয়েছে। আপনার জন্যই আজ আমরা ভাত-’

আমি বললুম, ‘বাস বাস, হয়েছে হয়েছে। কাপ্তান পাকড়ে নিয়ে শুধাল বলেই তো সব কথা বলতে হল। না হলে আমার দায় পড়েছিল।’

বললে, ‘তওবা, তওবা। শুনলেও গুনা হয়। তা হুজুর, আপনি দয়া করে আর ‘না।’ বলবেন না। আমি বুড়ির হয়ে আপনার পায়ে ধরছি।’

বলে সত্য-সত্যই আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরল। আমি হাঁ হাঁ, কর কী, কর কী’ বলে পা দুটো ছাড়ালুম।

ওরা আমাকে যা কোর্মা-পোলাও খাইয়েছে তার বদলে এ-কাজটুকু না করে দিলে অত্যস্ত নেমকহারামি হয়, ওদিকে আবার এক ফরাসিনী দজল। বঁটা কিংবা ভাঙা ছাতা নয়, পিস্তল হতে নিয়ে তাড়া লাগানোই ওদের স্বভাব।

কোন মুর্থ বেরয় দেশভ্রমণে! কত না বাহান্ন রকমের যত সব বিন্দকুট খুদার খামকা গেরো!

 

বন্দরে নেমে দেখি, পরদিন ভোরের আগে বার্লিন যাবার সোজা ট্রেন নেই। ফাঁকি দিয়ে গেরোটা কাটাব তারও উপায় আর রইল না। দুজন খালাসী নেমেছিল সঙ্গে–ঢেউপাশার নাগরের বাড়ি দেখিয়ে দেবে বলে। তাদের পরন লুঙ্গি, গায়ে রঙিন শার্ট, মাথায় খেজুর-পাতার টুপি, পায়ে বুট, আর গলায় লাল কৰ্ম্মফর্টার। ওই কৰ্ম্মফর্টারটি না থাকলে ওদের পোশাকী সজ্জাটি সম্পূর্ণ হয় না–বাঙালির যে-রকমী রেশমী উড়নি।

দুই হুজুরে আমাকে ‘হুজুর’ ‘হুজুর’ করতে করতে নিয়ে গেল বন্দরের এক সাবার্বে। সেখানে দূরের থেকে সন্তৰ্পণে ছোট্ট একটি ফুটফুটে বাড়ি দেখিয়ে দিয়েই তারা হাওয়া হয়ে গেল। আমি প্রমাদ গুনতে গুনতে এগলুম। পানির পীর বদর সায়েবকে এখন আর স্মরণ করে কোনও লাভ নেই। তাই সৌন্দরবনের ডাঙার বাঘের পীর গাজী সাহেবের নাম মনে মনে জপতে লািগলুম-যাচ্ছি বাঘিনীরই সঙ্গে মেলাকাত করতে।

বেশ জোরেই বোতাম টিপলুম—চোরের মায়ের বড় গলা।

কে বলে খাণ্ডার? দরাজ খুলে একটি ত্রিশ-বত্ৰিশ বছরের অতিশয় নিরীহ চেহারার গো-বেচারী যুবতী এসে আমার সামনে দাঁড়াল। ‘গো’-বেচারী বললুম তার কারণ আমাদের দেশটা গরুর। আসলে কিন্তু ওদের দেশের তুলনা দিয়ে বলতে হয়, ‘মেরি হ্যাড এ লিট্‌ল ল্যাম’–এর ভেড়াটি যেন মেরির রূপ নিয়ে এসে দাঁড়াল। ওদিকে আমি তৈরি ছিলুম পিস্তল, মেশিনগান, হ্যান্ড গ্রেনেডের জন্য। সামলে নিয়ে জাহাজে যে চোস্ত ফরাসিস আদব-কায়দার তালিম পেয়েছিলেন, তারই অনুকরণে মাথা নিচু করে বললুম, ‘আমি কি মাদম মা-ও মের (মুহম্মদের ফরাসি উচ্চারণ) সঙ্গে আলাপ করে আনন্দ লাভ করেছি?’ ইচ্ছে করেই কোন দিশী লোক সেটা উল্লেখ করলুম না। ফরাসিরা চীনা ভারতীয় এবং আরবীদের মধ্যে তফাত করতে পারেন না। আমরা যে রকম চীনা, জাপানী এবং বর্মী সবাইকে একই রূপে দেখি। চেহারা দেখে বুঝলুম মাদাম গুবলেট করে ফেলেছেন। বললেন, ‘আঁদ্রে (প্রবেশ করুন), মসিয়ো।’

ভরসা পেয়ে বললুম, মসিয়ো মাওমের সঙ্গে দেখা হতে পারে কি?’

‘অবশ্য!’

ড্রইংরুমে ঢুকে দেখি, শেখ করীম মহম্মদ উত্তম ফরাসি সুট পরে টেবিলের উপর রকমারি নকশার কাপড়ের ছোট ছোট টুকরোর দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে আছে।

আমি ফরাসিতে বললুম, ‘আমি মাদ্রাজ থেকে এসেছি, কাল বার্লিন চলে যাব। ভাবলুম, আপনাদের সঙ্গে দেখা করে যাই।’ সে যে ভারতীয় এবং তার ঠিকানা জানলুম কী করে সে-কথা ইচ্ছে করেই তুললুম না।

ভাঙা-ভাঙা ফরাসিতে অভ্যর্থনা জানাল।

আমি ইচ্ছে করেই মাদামের সঙ্গে কথাবার্তা জুড়ে দিলুম। মার্সেলেস যে কী সুন্দর বন্দর, কত রকম-বেরকমের রেস্তোরাঁ-হোটেল, কত জাত-বেজাতের লোক কতশত রকমের বেশভূষা পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আরও কত কী!

ইতিমধ্যে একটি ছেলে আর মেয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে ঘরে ঢুকেই আমাকে দেখে থমকে দাঁড়াল।

কী সুন্দর চেহারা! আমাদের করীম মুহম্মদ কিছু নটবরটি নন, তার বউও ফরাসি দেশের আর পাঁচটা মেয়ের মতো, কিন্তু বাচ্চা দুটির চেহারায় কী অপূর্ব লাবণ্য! কে বলবে এরা খাঁটি স্প্যানিশ নয়? সে দেশের চিত্রকরদের অয়েলপেন্টিঙে আমি যে রকম দেবশিশুর ছবি দেখেছি। ইচ্ছে করে, কোলে নিয়ে চুমো খাই। কিন্তু আশ্চর্য লাগল, পূর্বেই বলেছি, বাপের চেহারা তো বাংলা দেশের আর পাঁচজন হাল-চাষের শেখের যা হয় তা-ই, মায়ের চেহারাও সাধারণ ফরাসিনীর মত। তিন আর তিনে তা হলে সব সময় ছয় হয় না। দশও হতে পারে—ইনিফিনিটি অর্থাৎ পরিপূর্ণতাও হতে পারে। প্রেমের ফল তা হলে অঙ্কশাস্ত্রের আইন মানে না!

মাদাম ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইনি তোদের বাবার দেশের লোক। ছেলেটি তৎক্ষণাৎ আমার কাছে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়াল। আমি আদর করতেই বলে উঠল, ল্যাদ, সে ত্য প্যাই ঈ ফাতাস্তিক নেসপা?–অর্থাৎ ভারতবর্ষ ফেনটাসটিক দেশ, সে দেশের অনেক ছবি সে দেখেছে, ভারি ইচ্ছে সেখানে যায়, কিন্তু বাবা রাজী হয় না–অঁকল (কাকা), আমাকে নিয়ে চল,’ ওই ধরনের আরও কত কী!

আমি আবার প্রমাদ গুনলুম। কথাটা যে-দিকে মোড় নিচ্ছে তাতে না মাদাম পিস্তল বের করে।

অনুমান করতে কষ্ট হল না, আলোচনাটা মাদামের পক্ষেও অপ্রিয়। তিনি শুধালেন, ‘মসিয়োর রুচি কিসে-চা, কফি, শোকালো (কোকো), কিংবা—

আমি বললুম, অনেক ধন্যবাদ।’

তবু শেষটায় কফি বানাতে উঠে গেলেন।

সঙ্গে সঙ্গে করীম মুহম্মদ উঠে দাঁড়িয়ে সিলেটি কায়দায় পা ছুঁয়ে সেলাম করতে গেল। বুঝলুম, ওর চোখ ঠিক ধরতে পেরেছে। আমি সিলেটিতেই বললুম, ‘থাক থাক।’

যে ভাবে তাকাল তার থেকে বুঝতে পারলুম, সে পায়ের ধুলো নিতে যাচ্ছে না, সে পায়ের ধুলো নিচ্ছে তার দেশের মুরুর্কীদের যার ভিতর রয়েছেন আমার পিতৃ-পিতামহও, সে তার মাথায় ঠেকাচ্ছে দেশের মাটির ধুলো, তার মায়ের পায়ের ধুলো। আমি তখন বারণ করবার কে? আমার কী দম্ভ! সে কি আমার পায়ের ধুলো নিচ্ছে?

শুধু একটি কথা জিজ্ঞেস করলে, ‘হুজুর কোন হোটেলে উঠেছেন?? আমি নাম বললুম। স্টেশনের কাছেই।

আমি বললুম, ‘বস।’ সে আপত্তি জানাল না। তারপর দুজনই আড়ষ্ট হয়ে বসে রইলুম। কারও মুখে কোনও কথা নেই।

এমন সময়ে মেয়েটি কাছে এসে দাঁড়াল। আমি তার গালে চুমো খেয়ে বললুম, মধু।’

বাপ হেসে বললে, ‘এবারে জন্মদিনে ওকে যখন জিজ্ঞেস করলাম ও কী সওগাত চায় তখন চাইলে ইন্ডিয়ান বর। আমাদের দেশের মেয়েরা বিয়ের কথা পাড়লেই ঘেমে ওঠে।’

তার গলায় ঈষৎ অনুযোগের আভাস পেয়ে আমি বললুম, মনে মনে নিশ্চয়ই পুলকিত হয়। আর আসলে তো এসব বাড়ির দেশের দশের আবহাওয়ার কথা। এরা পেটের অসুখের কথা বলতে লজ্জা পায়, আমরা তো পাই নে।’

ইতিমধ্যে কফি এল। মাদাম বললেন, ‘মেয়ের নাম সারা (Sara ইংরিজিতে Sarah), ছেলেটির নাম রোমা।’ বাপ বললে, ‘আসলে রহমান।’ বুঝলুম লোকটার বুদ্ধি আছে। সারা’ নাম মুসলমান মেয়েদেরও হয়। আর রহমানের উচ্চারণ ফরাসিতে মোটামুটি রোমাই।

বেচারী মাদাম। কফির সঙ্গে দিলে দুনিয়ার যত রকমের কেক, পেসট্রি, গাতো, ব্রিয়োশ, ক্রোয়াসাঁ, বুঝলুম, পাড়ার দোকানের যাবতীয় চায়ের আনুষঙ্গিক ঝেঁটিয়ে কিনে আনিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য, প্যাঁজের ফুলুরিও। মাদাম বললে, ‘ম মারি–ইল লেজ এম।’ আমার স্বামী এগুলো ভালবাসেন।

ছেলেটি চেঁচিয়ে বললে, ‘মোয়া ওসি, মামি’—আমিও মা।

মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘মোয়া ওসি, মনোকলি’–আমিও চাচা।

আমি আর সইতে পারলুম না। কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি সে-সম্বন্ধে আমি সমস্তক্ষণ সচেতন ছিলুম। রোমার ভারত যাওয়ার ইচ্ছে, সারার ভারতীয় বরের কামনা এসব আমায় যথেষ্ট কাবু করে এনেছিল, কিন্তু ফ্রান্সের সেরা সেরা মিষ্টির কাছে ফুলুরির প্রশংসা—এ কোন দেশের রক্ত চেঁচিয়ে উঠে আমাকে একেবারে অভিভূত করে দিলে?

আমি দাঁড়িয়ে উঠে বললুম, ‘আজ তবে আসি। বার্লিনের টিকিট আমার এখনও কাটা হয় নি। সেটা শেষ না করে মনে শাস্তি পাচ্ছি নে।’

সবাই চোঁচামেচি করতে লাগল। ছেলেটা বললে, ‘কিন্তু আপনি তো এখনও আমাদের অ্যালবাম দেখেন নি।’ বলেই কারও তোয়াক্কা না করে অ্যালবাম। এনে পাতার পর পাতা উল্টে যেতে লাগল। ‘এই তো বাজান (বাবা + জান, সিলেটিতে বাজান), কী অদ্ভুত বেশে এদেশে নেমেছিলেন, এটার নাম লুঙ্গি না বাজান? কিন্তু ভারি সুন্দর, আমায় একটা দেবে, অকল-চাচা? বাবারটা আমার হয় না, (মাদাম বলেন, ‘চুপা’, ছেলেটা বললে, ‘পার্দো’ অর্থাৎ অর্থাৎ বে-আদবি মাফ কর) এটা মা, বিয়ের আগে, ক্যাল এ জনি, কী সুন্দর-’

ওঃ!

গুষ্টিসূদ্ধ আমাকে ট্রাম-টার্মিনাসে পৌঁছে দিতে এল। পৃথিবীর সর্বত্রই সর্বমহল্লা থেকে অন্তত একটা ট্রাম যায়-বিনা চেঞ্জে-স্টেশন অবধি। বিদেশীকে সেই ট্রামে বসিয়ে দিলেই হল। মাদাম কিন্তু তবু পইপই করে কন্ডাকটরকে বোঝালেন, আমাকে যেন ঠিক স্টেশনে নাবিয়ে দেওয়া হয়। মসিয়ো এ (ত্) এাত্রাজের, স্ট্রেঞ্জার, বিদেশী, (তারপর ফিশ ফিস করে)

ফরাসি বলতে পারেন না।–’

মনে মনে বড় আরাম বোধ করলুম। যাক, তবু একটি বুদ্ধিমতী পাওয়া গেল, যে

আমার ফরাসি বিদ্যের চৌহদি ধরতে পেরেছে।

মাদাম, কাচ্চাব্বাচ্চারা চোঁচালে, ‘ও রভোয়ার।’ করীম মুহম্মদ বললে, ‘সেলাম সায়েব।’

 

আহারাদির পর হোটেলের লাউঞ্জে বসে ওপরে ঘুমুতে যাব-যাচ্ছি, যাক-যাচ্ছি করছি, এমন সময় করীম মুহম্মদ এসে উপস্থিত। পরনে লুঙ্গি কম্ফর্টার।

ইয়োরোপের কোনও হোটেলে ঢুকে আপনি যদি লাউঞ্জে জুতো খুলতে আরম্ভ করেন, তবে ম্যানেজার পুলিশ কিংবা অ্যামবুলেনস ডাকবে। ভাববে আপনি খেপে গেছেন। এতত্ত্বটি নিশ্চয়ই করীমের জানা; তাই তার সাহস দেখে অবাক মানলুম। বরঞ্চ আমিই ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি তাকে বারণ করলুম। কিন্তু তারপর বিপদ, সে চেয়ারে বসতে চায় না। বুঝতে পারলুম, পরিবারের বাইরে এসে সে ঢেউপাশায় ‘কেরীম্যা’ হয়ে গিয়েছে। জুতো পরবে না; চেয়ারে বসবে না, কথায় কথায় কদমবোস-পদচুম্বন-করতে চায়।

বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘এ কী আপদ!’

লজ্জা পেয়ে বললে, ‘হুজুরের বোধ হয় অস্বস্তি বোধ হচ্ছে সকলের সামনে আমার সঙ্গে কথা বলতে! তা হলে, দয়া করে আপনার কামরায়-’

আমি উম্মা প্রকাশ করে বললুম, ‘আদপেই না।’ এবং এ অবস্থায় শ্ৰীহট্টের প্রত্যেক সুসন্তান যা বলে থাকে, সেটাও জুড়ে দিলুম, ‘আমি কি এ ঘরে মাগনা’ বসেছি, না। এদের জমিদারির প্রজা। কিন্তু তুমি এ-রকম করছি কেন? তুমি কি আমার কেনা গোলাম নাকি? চল উপরে।’

সেখানে মেঝেতে বসে একগাল হেসে বললে, ‘কেনা গোলাম না তো কী? আমার চাচাতো ভাই আছমত ছিল আপনাদের বাসার চাকর। এখন আমি মাকে যখন টাকা পাঠাই সেটা যায় আপনার সাহেবের (পিতার) নামে। আমি আপনাদের বাসায় গিয়েছি, আপনার আম্মা আমাকে চীনের বাসনে খেতে দিতেন। আমি আপনাকে চিনি হুজুর।’

আমি শুধালুম, ‘বউকে ফাঁকি দিয়ে এসেছ?’

বলল, ‘না। হুজুর। খেতে বসে রোমার মা আমাকে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বললে। আপনাকে সে রাত্রে খেতে বলতে পারেনি তার জন্য দুঃখ করলে। ও সত্যি বললে যে, আপনাতে আমাতে বাড়িতে নিরিবিলি কথাবার্তা হবে না, তাই আপনাকে খাওয়ার জন্য অনুরোধ করে নি। আসবার সময় বললে, ‘উনি যা বলেন তাই হবে’।’

আমি শুধালুম, ‘তবু না বললে তুমি আসতে না?’

কিছুমাত্র না ভেবে বললে, ‘নিশ্চয়ই আসতাম। তবে ওকে খামক কষ্ট দিতে চাই নে বলে না-বলে আসতুম।’ বলে। লাজুক বাচ্চাটির মত ঘাড় ফেরালে। আমার বড় ভাল লাগল।

আমি শুধালুম, ‘আমি তোমাদের বাড়িতে বলতে গিয়েছিলুম তোমরা জানলে কী করে? আমি শুনেছি, তোমার বউ দেশের লোককে তাড়া লাগায়। আমাকে লাগাল না। কেন?’

যেন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, তা একটু-আধটু লাগায় বটে, হুজুর, ওরা যে বলে বেড়ায় আমাকে রোমার মা ভ্যাড়া বানিয়ে রেখেছে সে-খবরটা ওর কানে পৌঁছেছে। তাই গেছে সে ভীষণ চটে। আসলে ও বড় শাস্তপ্রকৃতির মেয়ে, ঝগড়া-কাজিয়া করে কয় আদপেই জানে না।’

আর মানুষকে কি কখনও ভ্যাড়া বানানো যায়? কামরূপে না, কোনখানেই না।’

‘আপনি তা হলে সব কিছু শুনে বিবেচনা করুন, হুজুর।

‘সতেরো বছর বয়সে আমি আর-পাঁচজন খালাসীর সঙ্গে নামি এই বন্দরে। কেন জানি নে, হুজুর, হঠাৎ পুলিশ লাগালে তাড়া। যে যার জান নিয়ে যেদিকে পারে দিলে ছুটি। আমি ছিটকে পড়লাম শহরের এক অজানা কোণে। জাহাজ আর খুঁজে পাই নে। শীতের রাতে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে শেষটায় এক পোলের নীচে শুয়ে পড়লাম জিরাব বলে। যখন ইশ হল তখন দেখি, আমি এক হাসপাতালে শুয়ে। জুরে সর্বাঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে-দেশে আমার ম্যালেরিয়া হত। তারপর ক-দিন কাটল হাঁশে আর বেষ্ট্ৰশে তার হিসেব আমি রাখতে পারি। নি। মাঝে মাঝে আবছা আবছা দেখতে পেতাম ডাক্তাররা কী সব বলাবলি করছে। সেরে উঠে পরে শুনতে পাই ওদের কেউ কখনও ম্যালেরিয়ায় রোগীর কড়া জ্বর দেখে নি বলে সবাই ভড়কে গিয়েছিল। আর জুরের ঘোরে মাঝে মাঝে দেখতে পেতাম। একটি নাসকে। সে আমায় জল খাইয়ে রুমাল দিয়ে ঠোঁটের দু-দিক মুছে দিত। একদিন শেষরাতে কম্প দিয়ে এল আমার ভীষণ জুর। নার্স সব কখানা কম্বল চাপা দিয়ে যখন কম্প থামাতে পারল না। তখন নিজে আমাকে জড়িয়ে ধরে পড়ে রইল। দেশে মা যেরকম জড়িয়ে ধরত ঠিক সেই রকম। তারপর আমি ফের বেহুঁশি।

কিন্তু এর পর যখন জুর ছাড়ল তখন আমি ভাল হতে লাগলাম। শুয়ে শুয়ে দেশের কথা, মায়ের কথা ভাবি আর ওই নার্সটিকে দেখলেই আমার জানটা খুশিতে ভরে উঠত। সে মাঝে মাঝে আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিত। আর ওদের ভাষায় প্রতিবারে একই কথা বলত। আমি না বুঝেও বুঝতাম, বলছে, ভয় নেই, সেরে উঠবে।

‘তারপর একদিন ছাড়া পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ছুটলাম বন্দরের দিকে। সেখানে জাতভাইয়ের সঙ্গে দেখা। অন্য এক জাহাজের—আমাদের জাহাজ তো কবে ছেড়ে দিয়েছে। সে সব কথা শুনে বললে-’ভাগো ভাগো, এখুনি ভাগো। তোমার নামে হুলিয়া জারি হয়েছে, তুমি জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছ। ধরতে পারলেই তোমাকে পুলিশ জেলে দেবে।’

‘ক বছর? কে জানে? এক হতে পারে, চোদ্দও হতে পারে। আইন-কানুন হুজুর আমি তো কিছুই জানি নে।

‘কিন্তু যাই ই বা কোথায়? যে দিকে তাকাই সে-দিকেই দেখি পুলিশ। খানা-পিনার কথা তুলব না হুজুর, সে তখন মাথায় উঠে গিয়েছে। কিন্তু রাতটা কাঁটাই কোথায়?

‘শেষটায় শেষ অগতির গতির কথা মনে পড়ল। হাসপাতাল ছাড়ার সময় সেই নার্সটি আমার সঙ্গে শেকহ্যান্ড করে দিয়েছিল একখানা চিরকুট। তখনও জানতাম না, তাতে কী লেখা। যাকে দেখাই সে-ই হাত দিয়ে বোঝায়-আরও উত্তর দিকে যাও। শেষটায় একজন লোক আমাকে একটা বড় বাড়ির দেউড়ি দেখিয়ে চলে গেল।

সেখানে ঘণ্টাতিনেক দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রোঁদের পুলিশ আমাকে সওয়াল করতে লাগল। হাসপাতালে দু’মাস ওদের বুলি শুনে শুনে যেটুকু শিখেছিলাম তার থেকে আমেজ করতে পারলাম, ওর মনে সন্দ হয়েছে, আমি কী মতলবে ওখানে দাঁড়িয়ে আছি—আর হবেই না কেন? বুঝলাম রাশিয়তে জেল আছেই। মনে মনে বললাম, কী আর করি, একটা আশ্রয় তো চাই। জেলই কবুল। চাচা মামু অনেকেই তো লাঠালাঠি করে গেছেন, আমি না হয় না করেই গেলাম।

‘এমন সময় সেই নার্সটি এসে হাজির। পুলিশকে কী একটা সামান্য কথা বলে আমাকে হাতে ধরে নিয়ে গেল তার ছোট্ট ফ্ল্যাটে-পুলিশ যেভাবে তাকে সেলাম করে রাটি না কেড়ে চলে গেল তার থেকে আন্দেশ করলাম, পাড়ার লোক ওকে মানে।

‘আমাকে খেতে দিল গরম দুধের সঙ্গে। কাঁচা আণ্ডা ফেটে নিয়ে। বেহুঁশির ওত্তেজ্ঞ কী খেয়েছি জানি নে, হুজুর, কিন্তু হাঁশের পর দাওয়াই হিসেবেও আমি শরাব খাই নি। তাই ‘বরান্দি’ টা বাদ দিল।

রাতে খেতে দিল রুটি আর মাংসের হালকা ঝোল। চারটি ভাতের জন্য আমার জন্য তখন কী আকুলি-বিকুলি করেছিল। আপনাকে কখনও সমঝাতে পারব না, হুজুর।’

জাহাজের খালাসীদের স্মরণে আমি মনে মনে বললুম, সমঝাতে হবে না।’ বাইরে বললুম, ‘তারপর?’

একটুখানি ভেবে নিয়ে বললে, ‘সব কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে সায়েব। আর কী-ই বা হবে বলে? ও আমাকে খাওয়ালে পর্যালে, আশ্রয় দিলে-বিদেশেবিভুইয়ে সেখানে আমার জেলে গিয়ে পাথর ভাঙার কথা-এ সব খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে না বললে কি তার দাম কমে যাবে!

‘দাম কমবে না বলেই বলছি হুজুর, সুজন নার্সের কাম করে-’

আমি শুধালুম, কী নাম বললে?’

একটু লজ্জা পেয়ে বললে, ‘আমি ওকে সুজন বলে ডাকি-ওদের ভাষায় সুজান।’

বুঝলুম ওটা ফরাসি Suzzanne, এবং আরও বুঝলুম, যো-জাতের লোক আমাদের দেশে মরমিয়া ভাটিয়ালি রচেছে তাদেরই একজনের পক্ষে নামের এটুকু পরিবর্তন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা কিছু কঠিন কর্ম নয়। অতখানি স্পর্শকাতরতা এবং কল্পনাশক্তি ওদের আছে।

আমি শুধালুম, ‘তার পর কী বলছিলে?’

বললে, ‘সুজন নার্সের কাম করে আমাকে যে এক বছর পুষেছিল তখন আমি তার বাড়ির কাজ করেছি। বেচারীকে নিজের রান্না নিজেই করতে হত—হাসপাতাল থেকে গতর খাটিয়ে ফিরে আসার পর। আমি পাক-রসুই করে রাখতাম। শেষ দিন পর্যন্ত সে আপত্তি করেছে, কিন্তু আমি কান দিই নি।’

আমি শুধালুম, কিন্তু তোমার পাড়ার পুলিশ কিছু গোলমাল করলে না?’

একটুখানি মাথা নিচু করে বললে, ‘অন্য দেশের কথা জানি না হুজুর, কিন্তু এখানে মহব্বতের ব্যাপারে। এরা কোন রকম বাগড়া দিতে চায় না। আর এরা জানত যে ওর বাড়িতে ওঠার এক মাস পরে ওকে আমি বিয়ে করি।

‘কিন্তু হুজুর, আমার বড় শরাম বোধ হত; এ যে ঘর-জামাই হয়ে থাকার চেয়েও খারাপ। কিন্তু করিই বা কী?

‘আল্লাই পথ দেখিয়ে দিলেন।

‘সুজন আমাকে ছুটি-ছাঁটার দিনে সিনেমায়-টিনেমায় নিয়ে যেত। একদিন নিয়ে গেল এক মস্ত বড় মেলাতে। সেখানে একটা ঘরে দেখি নানা দেশের নানা রকম তাত জড় করে লোকজনকে দেখানো হচ্ছে তাতগুলো কী করে চালানো হয়, সেগুলো থেকে কী কী নকশার কাপড় বেরয়। তারই ভিতর একটা দেখতে গেলাম, অনেকটা আমাদের দেশেরই তাঁতের মত।

‘আমার বাপ-ঠাকুরদা জেলার কাজ করেছে, ফসল ফলিয়েছে, দরকার হলে লাঠিও চালিয়েছে।

অনেক ইতি উতি কিন্তু-কিন্তু করে সুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “তাঁতের দাম কত?” বুঝতে পারল, ওতে আমার শখ হয়েছে। ভারি খুশি হল, কারণ আমি কখনও কোন জিনিস তার কাছ থেকে চাইনি। বললে, ‘ওটা বিক্রির নয়, কিন্তু মিস্ত্রী দিয়ে আমাকে একটা গড়িয়ে দেবে।

‘ও দেশে ধূতি, শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা কিনবে কে? আমি বানালাম স্কার্য, কৰ্ম্মফর্টার। দিশী নকশায়। প্রথম নকশায় আধখানা ফুটতে না ফুটতেই সুজনের কী আনন্দ! স্কার্ফ র্তত থেকে নামাবার পূর্বেই সে পাড়ার লোক জড় করে বসেছে, আজগুবী এক নূতন জিনিস দেখাবে বলে। সবাই পাই-পই করে দেখলে, অনেক তারিফ করলে। সুজনের ডবল আনন্দ, তার স্বামী নিষ্কৰ্মা ভবঘুরে নয়। একটা হুনুরী, গুণী লোক।

‘গোড়ার দিকে পাড়াতে, পরে এখানে—সেখানে বিস্তর স্কার্ফ বিক্রি হল। বেশ দু পয়সা আসতে লাগল। তারপর এখানকার এক তাঁতীর কাছে দেখে এলাম কী করে রেশমের আর পশমের কাজ করতে হয়। শেষটায় সুজন নিয়ে এল আমার জন্য বহুত কেতাব, সেগুলাতে শুধু কাশ্মীরী নকশায় নয়, আরও বহুত দেশের বহুত রকম-বেরকমের নকশাও আছে। তখন যা পয়সা আসতে লাগল তারপর আর সুজনের চাকরি না করলেও চলে। সেই কথা বলতে সে খুশির সঙ্গে রাজী হল। শুধু বলল, যদি কখনও দরকার হয় তবে আবার হাসপাতালে ফিরে যেতে পারবে। রোমা তখন পেটে। সুজন সংসার সাজাবার জন্য তৈরি।

‘আপনি হয়তো ভাবছেন আমি কেন বুড়ির কথা পাড়ছি নে। বলছি, হুজুর, রাতও অনেক ঘনিয়ে এসেছে, আপনি আরাম করবেন।

‘আপনি বিশ্বাস করবেন না, দু পয়সা হতে সুজন বললে, ‘তোমার মাকে কিছু পাঠাবে না?’ আমি আগের থেকেই বন্দরের ইমানদার লোক খুঁজছিলাম। রোমার মাই বললে, ব্যাঙ্ক দিয়েও নাকি দেশে টাকা পাঠানো যায়।

‘মাসে মাসে বুড়িকে টাকা পাঠাই। কখনও পঞ্চাশ কখনও একশো। ঢেউপাশাতে পঞ্চাশ টাকা অনেক টাকা। শুনি বুড়ি টাকা দিয়ে গায়ের জন্য জুম্মা-ঘর বানিয়ে দিয়েছে। খেতে-পরতে তো পারছেই।

টাকা দিয়ে অনেক কিছুই হয়, দেশে বলে, টাকার নাম জয়রাম, টাকা হইলে সকল কাম—কিন্তু হুজুর, টাকা দিয়ে চোখের পানি বন্ধ করা যায় না। একথা আমি খুব ভাল করেই জানি। বুড়িও বলে পাঠিয়েছে, টাকার তার দরকার নেই, আমি যেন দেশে ফিরে যাই।

‘আমার মাথায় বাজ পড়ল, সায়েব; যেদিন খবর নিয়ে শুনলাম, দেশে ফিরে যাওয়া মোটেই কঠিন নয়, কিন্তু ফিরে আসা অসম্ভব। আমি এখন আমার মহল্লার মুরুর্কীদের একজন। থানার পুলিশের সঙ্গেও আমার বহুত ভাব-সাব হয়েছে। আমার বাড়িতে প্রায়ই তারা দাওয়াত-ফাওয়াত খায়। তারা প্যারিস থেকে পাকা খবর আনিয়েছে, ফিরে আসা অসম্ভব। মুসাফির হয়ে কিংবা খালাসী সেজে পালিয়ে এলেও প্যারিসের পুলিশ এসে ধরে নিয়ে দেশে চালান দেবে। এমন কি তারা আমাকে বারণ করেছে। আমি যেন ওই নিয়ে বেশি। নাড়াচাড়া না করি। প্যারিসের পুলিশ যদি জেনে যায় আমি বিনা পাসপোর্টে এ দেশে আছি তা হলে তারা আমাকে মহল্লার পুলিশের কদর দেখাবে না। এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবে। আপনি কী বলেন, হুজুর?’

ডাহা মিথ্যে বলি কী প্রকারে? আমার বিলক্ষণ জানা ছিল, ফ্রান্স চায় টুরিসটুি সে দেশে এসে আপন গাঁটের পয়সা খরচ করুক, কিন্তু তার বেকারীর বাজারে কেউ এসে পয়সা কামাক এ-অবস্থাটা সে যে করেই হোক রুখবে।

আমি চুপ করে রইলুম দেখে করীম মুহম্মদ মাথা নীচু করে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

অনেকক্ষণ পর মাথা তুলে বললে, ‘রোমার মা আমার মনের সব কথা জানে। দেশের লোক ভাঙচি দেয়, আমি ভেড়া বনে গিয়েছি। এ-কথা বলে-এ-সব শুনে সে তাদের পছন্দ করে না, কিন্তু মাঝে মাঝে ভোরের ঘুম ভেঙে গেলে দেখি সেও জেগে আছে। তখন আমার কপালে হাত দিয়ে বলে, ‘তোমার দেশে যদি যেতে ইচ্ছে করে, তবে যাও। আমি একই বাচ্চা দুটোকে সামলাতে পারব।’ এ-সব আরম্ভ হল, নিজে মা হওয়ার পরের থেকে।

‘আজ আপনার কথা তুলে বললে, ‘এ ভদ্রলোকের শরীরে দয়ামায়া আছে। আমার ছেলেমেয়েকে কত আদর করলেন। আমি বললাম, ‘সুজন, তুই জানিস নে, আমাদের দেশের ভদ্রলোক আমাদের কত আপনজন। এই যে ভদ্রলোক এলেন, এর সায়েব (পিতা) আমার বাবাকে ‘পাতী।’ (ছেলে) বলে ডাকতেন। এ দেশের ভদ্রলোক তো গরিবের সঙ্গে কথা কয় না।’ আপনি-ই বলুন, হুজুর’

তার ‘আপনজন’। ওইটুকুই বাকী ছিল।

সুজনই আজ বললে, ‘ওঁর কাছে গিয়ে তুমি হুকুম নাও। উনি যা বলেন তাই হবে।’ এইবার আপনি হুকুম দিন, হুজুর’

আমি হাত জোড় করে বললুম, ‘তুমি আমায় মাপ কর।’

সে আমার পায়ে ধরে বললে, ‘আপনার বাপ-দাদা আমার বাপ-দাদাকে বিপদেআপদে সলা দিয়ে হুকুম করে বাঁচিয়েছেন, আজ আপনি আমায় হুকুম দিন।’

আমি নির্লজের মত পূৰ্ব ঐতিহ্য অস্বীকার করে বললুম, ‘তুমি আমায় মাপ কর।’

অনেক কান্নাকাটি করল। আমি নীরব।

শেষ রাত্রে আমার পায়ে চুমো খেল, আমি বাধা দিলুম না। বিদায় নিয়ে বেরবার সময় দোরের গোড়ায় তার বুক থেকে বেরল, ইয়া আল্লা!’

 বাঁশী

তার মানে এ নয়, গুরুদেব নেই, দিনুবাবু নেই, ক্ষিতিমোহনবাবু ক্লাস নেন না। সে তো জানা কথা। কোম্পানির রাজত্ব, মহারানীর সরকারই যখন চলে গেল। তখন এরাও যে শালবীথি থেকে একদিন বিদায় নেবেন, সে তো আমাদের জানাই ছিল; কিন্তু এটা জানা ছিল না যে, আশ্রমের চেহারাটিও গুরুদেব সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।

খুলে কই।

তখন আশ্রমের গাছপালা ঘর-বাড়ি ছিল অতি কম। গাছের মধ্যে শালবীথি, বকুলতলা, আম্রকুঞ্জ আর আমলকি-সারি। বাস। হেথা-হোথা খানসাতেক ডরমিটরি, অতিথিশালা আর মন্দির। ফিরিস্তি কমপ্লিট। তাই তখনকার দিনে আশ্রমের যেখানেই বসো না কেন, দেখতে পেতে দূরদূরান্তব্যাপী, চোখের সীমানা-চৌহদি ছাড়িয়ে-খোয়াইয়ের পর খোয়াই, ডাঙার পর ডাঙা-চতুর্দিকে তেপান্তরী মাঠ। ভোরবেলা সুজ্জিঠাকুরের টিকিট বেরুনোমাত্র সিটিও আমাদের চোখ এড়াতে পারত না। রাত তেরটিার সময় চাদের ডিঙির গলুইখানা ওঠামাত্রই আমরা গেয়ে উঠতুম-চাঁদ উঠেছিল গগনে।’ যাবে কোথায়, চতুর্দিকে বেবাক ফাঁক। আর আজ? গাছে গাছে ছয়লাপ। আম জাম কাঁঠাল খানদানী ঘরানারা তো আছেনই, তার সঙ্গে জুটেছেন যত সব দেশ-বিদেশের নাম-না-জানা কলো নীল হলদে ইয়াইয়া ফুলের গাছ। এখন আশ্রমের অবস্থা কলকাতারই মত। সেখানে পাচতলা এমারত সুজি-চন্দর ঢেকে রাখে, হেথায় গাছপালায়।

ওই দূরদূরান্তে, চোখের সীমানার ওপারে তাকিয়ে থাকা ছিল আমাদের বাই। অবশ্য যারা লেখাপড়ায় ভাল ছেলে তারা তাকাত বইয়ের দিকে, আর আমার মত গবেটরা এক হাত দূরের বইয়ের পাতাতে চোখের চৌহদ্দি বন্ধ না রেখে তাকিয়ে থাকত সেই সুদূর বাটের পানে—তাকিয়ে আছে কে তা জানে। গুরুরা, অর্থাৎ শাস্ত্রীমশাই মিশ্রজী কিছু বলতেন না। তারা জানতেন, বরঞ্চ একদিন শালতলার শালগাছগুলো নর-নরৌ-নিরাঃ, গজ-গজৌ-গজাঃ উচ্চারণ করে উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের দ্বারা আর যা হোক, লেখাপড়া হবে না। অন্য ইস্কুল হলে অবশ্য আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হত, কিন্তু তারা দরদ দিয়ে বুঝতেন, আমি বাপমা-খেদানো ছেলে, এসেছি। এখানে, এখান থেকে খেদিয়ে দিলে, হয় যাব ফাঁসি নয় যাব জেলে।

এই দুরের দিকে তাকিয়ে থাকার নেশা আপনাদের বোঝাই কী প্রকারে? আমি নিজেই যখন সেটা বুঝে উঠতে পারি নি, তখন সে চেষ্টা না করাই শ্রেয়। তবে এইটুকু বলতে পারি, এ-নেশাটা সাঁওতাল ছোঁড়াদের বিলক্ষণ আছে। আকাশের সুদূর সীমানা খুঁজতে গিয়ে তারা বেরিয়েছিল সাজে, তারপর অন্ধকার রাতে, পথ হারিয়ে একই জায়গায় সাত শো বার চক্কর খেয়ে পেয়েছে অক্কা। বুড়ো মাঝিরা বলে, পেয়েছিল ভুতে। সে-কথা। পরে হবে।

আমি শান্তিনিকেতনে আসি ১৯২১ সনে। গাঁইয়া লোক। এখানে এসে কেউ বা নাচে ভরতনৃত্যম, কেউ বা গায় জয়জয়ন্তী, কেউ বা লেখে মধুমালতী ছন্দে কবিতা, কেউ বা গড়ে নব নটরাজ, কেউ বা করে বাতিক, লেদার-ওয়ার্ক, ফ্রেস্কো, সন্টুককো, উড-ওয়ার্ক, এচিং, ড্রাই-পয়েন্ট, মেদজোঁ-টিনটু আরও কত কী। এক কথায় সবাই শিল্পী, সবাই কলাবৎ।

আমারও বাসনা গেল—শিল্পী হব। আর্টিস্ট হব। ওদিকে তো লেখাপড়ায় ডডনং, কাজেই যদি শিল্পীদের গোয়ালে কোন গতিকে ভিড়ে যেতে পারি। তবে সমাজে আমাকে বেকার-বাউণ্ডুলে না বলে বলবে শিল্পী, কলাবৎ, আরতিসৎ।

অথচ আমার বাপ-পিতামোর চোদ্দপুরুষ, কেউ কখনও গাওনা-বাজনার ছায়া মাড়ানো দূরে থাক, দূর থেকে ঝঙ্কার শুনলেই রামদা নিয়ে গাওয়াইয়ার দিকে হানা দিয়েছেন। আমরা কট্টর মুসলমান। কুরানে না হোক আমাদের স্মৃতিশাস্ত্ৰে গাওনা-বাজনা বারণ, বাঁদর-ওলার ডুগডুগি শুনলে আমাদের প্রচিত্তির করতে হয়। আমার ঠাকুদ্দদার বাবা নাকি সেতারের তার দিয়ে সেতারীকে ফাঁসি দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন।

কাজেই প্রথম দিন ব্যালাতে ছড় টানা মাত্ৰই আশ্রমময় উঠল পরিত্ৰাহি অট্টারব। কেউ শুধালে, গরু জবাই করছে কে; কেউ ছুটলে গুরুদেবের কাছে হিন্দু ব্ৰহ্মচর্যাশ্রমে মামদো ভূতের উপদ্ৰব থামাবার জন্য অনুরোধ করতে। গুরুদেব পড়লেন বিপদে। তাঁর মনে পড়ল আপন ছেলেবেলাকার কাহিনী-তাঁর পিতৃদেব তাঁর প্রথম কবিতা শুনে কী রকম বাঁকা হাসি চেপে ধরেছিলেন। তাই তিনি সে রাত্রে কবিতা লিখলেন,

‘আমার রাত পোহালো শারদ প্রাতে
বাঁশী তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে?’

কার হাতে আর দেবেন? দিলেন আমারই হাতে। সবাই বুঝিয়ে বললে, ‘ভাই ব্যালাটা ক্ষান্ত দাও। বাঁশী বাজাও; কিন্তু দোহাই আশ্রম-দেবতার আশ্রমের বাইরেই রেওয়াজটা কোর।’

সেদিনই সন্ধ্যাবেল বাঁশী হাতে নিয়ে গেলুম সাঁওতাল-গাঁয়ের দিকে। পশ্চিমাস্য হয়ে, অস্তমান সূর্যের দিকে তাকিয়ে ধরলুম তোড়ি।

সাঁওতাল-গায়ের কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে মেলা ‘এনকোর’, ‘সাধু সাধু’ রব কাড়লে।

সুদূর দিকপ্রান্তের দিকে, অস্তমান সূর্যের পানে তাকিয়ে আমার মাথায় তখন চাপল সেই বাই, যেটা পূর্বেই আপনাদের কাছে নিবেদন করেছি-হোথায় যেথায় সূর্য অস্ত যাচ্ছে, আমাকে সেখানে যেতে হবে।

নেমে পড়লুম খোয়াইয়ে।

গোধূলির আলো স্নান হয়ে আসছে। তারই লালিমা খোয়াইয়ের গেরুয়াকে কী রকম যেন মেরুন রঙ মাখিয়ে দিচ্ছে। চতুর্দিকে কী রকম যেন একটা ক্লান্তি আর অবসাদ। আমি সুদূরের নেশায় এগিয়ে চললুম।

হঠাৎ দুম করে অন্ধকার হয়ে গেল।

প্রথমটায় বিপদ বুঝতে পারলুম না। বুঝলুম মিনিট পাঁচেক পরে। অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে, উঁচু টিপি থেকে গড়গড়িয়ে সর্বাঙ্গ ছড়ে গিয়ে নীচে পড়ে, হঠাৎ উঁচু টিপির সঙ্গে আচমকা নাকের ধাক্কা লেগে, কখনও বা কারও অদৃশ্য পায়ে বেমক্কা ল্যাং খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে।

উঠি আর পড়ি, পড়ি আর উঠি।

দশ মিনিটে সাঁওতাল-গাঁয়ে ফেরার কথা। পনের, পাঁচিশ মিনিট, আধঘণ্টাটাক হয়ে গেল, গায়ের কোনও পাত্তাই নেই।

ততক্ষণে রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছি। জাহান্নামে যাক গে আকাশের সীমানা-ফিমানা, এখন আশ্রমের ছেলে আশ্রমে ফিরতে পারলে বাঁচি। কিন্তু কোথায় আশ্রম, কোথায় সাঁওতাল-গ্ৰাম! একই জায়গায় চক্কর খাচ্ছি না, কোন একদিকে এগিয়ে যাচ্ছি তাই আল্লার মালুম।

এমন সময় কনের কাছে শুনি—

অদ্ভুত তীক্ষ্ণ কেমন যেন এক আর্তরব! একটানা নয়, থেমে থেমে। কেমন যেন ফিঁৎ, ফিঁৎ, ফিঁৎ, ফী-ঈ-ঈ-ঈ-ঈ-ঈৎ!

ভয়ে ছুট লাগাবার চেষ্টা করলুম। সেই ফিঁৎ ফিঁৎ যেন কলরব করে উঠে আরও জোরে চেঁচাতে লাগল—ফীঁৎ ফীঁৎ।

ইয়া আল্লা, ইয়া পয়গম্বর, ইয়া মৌলা আলীর মুরশীদ। বাঁচাও বাবারা, এ কী ভূত, না, প্ৰেত, না ডাইনী!

হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলুম গড়গড়িয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সেই ভূতুড়ে শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাপার কী!

আস্তে আস্তে ফের রওয়ানা দিলুম। সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই শব্দ-প্রথমে ক্ষীণ, আমি যত জোরে চলতে থাকি শব্দটাও সঙ্গে সঙ্গে জোরালো হতে থাকে। প্রথমটায় আস্তে আস্তে—ফিঁৎ, ফিঁৎ, ফিঁৎ। আমি যত জোরে চলতে আরম্ভ করি শব্দটাও দ্রুততর হতে থাকে-ফিঁৎ ফিঁৎ ফিঁৎ।

আর সে কী প্রাণঘাতী, জিগরের খুন-জমানেওলা শব্দ!

যেন কোন কঙ্কালের নাকের ভিতর দিয়ে আসছে দীর্ঘনিশ্বাস-কখনও ধীরে ধীরে আর কখনও বা দ্রুতগতিতে। একদম, আমার সঙ্গে কদম কদম বাঢ়হায়ে যাচ্ছে, আমার কানের কাছে যেন সেঁটে গিয়ে, লম্বা লম্বা হাতের আঙুল দিয়ে কানের পর্দটা ছিড়ে দিচ্ছে।

সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল গুরুদেবের ‘কঙ্কাল’ গল্পটা। কিন্তু গুরুদেব মহর্ষির সন্তান; তিনি ভয় পান নি। বেশ জমজমাট করে খোশগল্প করেছিলেন কঙ্কাল আর ভূতের সঙ্গে। আমি পাপী-নেমাজ-রোজা নিত্য নিত্য কামাই দিই।

সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার যেন আমার গলার টুঁটি চেপে ধরল।

আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লুম। দেখি, যেন আমার চতুর্দিকে লক্ষ লক্ষ তারা ফুটে উঠছে। কিন্তু হলদে রঙের। ‘প্যোর কেলিমানস মাস্টার্ড।’

কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম, বলতে পারব না।

যখন হুঁশ হল তখন গায়ে লাগল পুবের বাতাস। তাই উলটো দিকে চলতে আরম্ভ করলুম। ওই রকম যদি চলতে থাকি, তবে একদিন না একদিন আশ্রম, ভুবনডাঙা, কিংবা রেল লাইনে পৌঁছবই পৌঁছব।

সঙ্গে সঙ্গে দ্বিগুণ জোরে সেই-ফিঁৎ ফিঁৎ ফিঁৎ।

কিন্তু এবারে সঙ্গে সঙ্গে একটা টিপিতে উঠতেই দেখি-উত্তরায়ণ। তারই বারান্দায় গুরুদেবের সৌম্য মূর্তি। টেবিল-ল্যাম্পের পাশে বসে মিশ্রজীর সঙ্গে গল্প করছেন!

আমি চিৎকার করে উঠলুম–

ওয়া গুরুজীকি ফতে।

গুরুর জয়, গুরুদেবের জয়।

তিনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন। তারই কৃপায় রক্ষা পেয়েছি।

কিন্তু ‘ওয়া গুরুজীকী ফতে’ বেরিয়েছিল-’ওবা গরজীবী ফত’ হয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে, চাপা সুরে।

ততক্ষণে ধড়ে জান ফিরে এসেছে।

শব্দটা তবে কিসের ছিল?

বাঁশীর। আমার চলার সঙ্গে সঙ্গে বাঁশীতে হাওয়া ঢুকে ফিঁৎ ফিঁৎ করছিল। জোরে চললে হাত ঘন ঘন দোলা খেয়েছে, ফিঁৎ ফিঁৎও জোরে বেজেছে। আস্তে চললে আস্তে।

বাঁশীটা ছুঁড়ে ফেলে দিলুম। শেষবারের মত ফিঁৎ করে কাতর আর্তনাদ ছেড়ে সে নীরব হল।

আমি কলাবৎ হবার চেষ্টা করি নি।

গুরুদেব যখন গেয়েছেন–

‘বাঁশী তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে?’
তখন আমার কথা ভাবেন নি।

মণি

‘কাব্যের উপেক্ষিতা’য় ভারতের কবিগুরু রবীন্দ্ৰনাথ বিশ্বের কবিগুরু বাল্মীকির বিরুদ্ধে অনুযোগ করেছেন, তিনি তার কাব্যে ঊৰ্মিলার প্রতি অবিচার করেছেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলেছেন, রসসৃষ্টিতে তাবৎ-নায়িকাকে সমান সম্মান, সমান অধিকার দেওয়া সম্ভবপর নয়।

তবু তো ঊৰ্মিলার উল্লেখ রামায়ণে আছে। কিন্তু রামচন্দ্ৰ আর সীতাদেবীর কি আরও বহু অনুচর সখা বান্ধবী পরিচারিকা ছিলেন না, যাদের উল্লেখ আদিকবি আদপেই করেন নি? তাঁদের জীবনে সুখ-দুঃখ উৎসব-ব্যাসন বিরহ-বেদনা মিলনানন্দ সবা-কিছুই ছিল। এতৎসত্ত্বেও আদিকবি তাদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন নি। তিনি তো কিছু নিছক কাল্পনিক চরিত্রসৃষ্টি করেন নি, নির্ভেজাল রূপকথাতে যে-রকম হয়। তিনি তো লিখেছিলেন ইতিহাস, অবশ্য রসের গামলায় চুবিয়ে নিয়ে, বাটিক প্রক্রিয়ায় হলেই বা। তাই বলে কি শেষমেশ ওইসব অভাগাদের জ্যান্ত পোতা হল না?

জানি নে, আদিকবিকে এ-ফরিয়াদ জানালে তিনি কী উত্তর দিতেন। যে চন্দ্ৰবৈদ্য শ্ৰীীরামচন্দ্রের নখ-চুল কেটে দিত, যে শুক্লবৈদ্য মা-জননী জনকতনয়ার দুকুল-কঁচুলি কেচে দিত তারা যদি কবিসমীপে নিবেদন করত, তাদেরই বা তিনি ভুলে গেলেন কেন? ঊৰ্মিলার মত নিদেন তাদের নামোল্লেখ করলেই তো তারা অজরামর হয়ে যেত, তবে তিনি কী উত্তর দিতেন?

অত দূরে যাই কেন? কবিগুরু শ্ৰী রবীন্দ্রনাথকে যদি জিজ্ঞেস করা হত, বিনয় এবং ললিতার মত দুটি অত্যুত্তর চরিত্রসৃষ্টি করার পর—হায়, বাংলার সচ্চরিত্র কী দুর্লভ-তিনি সে-দুজনকে পথমধ্যে গুম করলেন কেন, তা হলে তিনি কী উত্তর দিতেন?

আমি বাল্মীকি নই, রবীন্দ্রনাথও নই। এমন কি আমার আপনি গ্রামের প্রধান লেখক নই। আমার গ্রামের শুকুরুন্ন এবং পাগলা মাধ্যাই যে-সব ভাটিয়ালি রচে গিয়েছে, আমার রচনা তাদের সামনে লজ্জায় ঘোমটা টানে। মধাইয়ের একটি ভাটিয়ালির ভুলে-যাওয়া অন্তরা আমি তিরিশ বছর ধরে চেষ্টা করেও পূরণ করতে পারি নি। মাধ্যই আমি একই পাঠশালাতে একই শ্রেণীতে পড়েছি। মাধ্যই ফি বাচ্ছর ফেল মারত, আমি ফাস্ট হাতুম।

তাই, বিশেষ করে তাই, আমি মোক্ষম মনঃস্থির করেছি, আমি আমার সৃজনে যাদের প্রতি অনিচ্ছায় অবজ্ঞা প্রকাশ করেছি, তাদের প্রত্যেককে জ্যান্তগোর থেকে খুঁড়ে তুলে প্রাণবন্ত করব। অর্থাৎ অর্ধমৃত করব। কারণ, আমি শক্তিমান লেখক নই। অদ্যাবধি বৰ্ণিত আমার তাবৎ চরিত্রই জীবন্মত। অতএব এঁরাও অমৃত না হয়ে আমৃত হবেন। কিন্তু আমি তো নিষ্কৃতি পাব আমার জন্মপাপ থেকে।

আমি কাবুলে ছিলাম, তখন সেখানকার ব্রিটিশ লিগেশনের সঙ্গে আমার কণামাত্র হৃদ্যতা হয় নি। ‘দেশে-বিদেশে’ যারা পড়েছেন তারা সে-কথা হয়তো স্মরণ করতে পারবেন। তবে লিগেশনের একজন প্রধান কর্মচারির সঙ্গে আমার অত্যন্ত হাদিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ইনি পেশাওয়ারের খানদানী বাসিন্দা। অতিশয় খাস পাঠান। এঁর চতুর্দশ পুরুষের কেউ কখনও আপন গোষ্ঠীর বাইরে বিয়ে-শাদি করেন নি। পেশাওয়ারের পুলিশ ইনসপেক্টর আহম্মদ আলীর অগ্ৰজ। নাম শেখ মহবুব আলী। ব্রিটিশ লিগেশনে তিনি ছিলেন ওরিয়েন্টাল সেক্রেটারি।

এর মত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ কূটনৈতিক আমি অষ্টকুলাচল সপ্তসমূদ্র পরিক্রম করেও দেখতে পাই নি। আমার বিশ্বাস পাঠান-প্রকৃতি ধরে। কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু এইসব সরল পাঠানদের যাঁরা সর্দার হন, যেমন মনে করুন ইস্পাইয়ের ফকীর, ইংরেজিতে বলে ফকির অব ইপি (Ipi), তাঁদের মত ধুরন্ধর ইহসংসারে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শেখ মহবুব আলীই বলতেন, ‘পাঠানরা হয়। গাড়ল, নয় ঘড়েল। মাঝখানে কিছু নেই। পিগমিজ অ্যান্ড জাইন্টস, নো নির্মেলস’ অধ্যাপক বাগদানফ এবং বেনওয়ার সঙ্গে তাঁর প্রচুর হৃদ্যতা ছিল। বাগদানফ গত হয়েছেন। বেনওয়া আছেন, সৃষ্টিকর্তা তাঁকে শতায় দিন, তাকে জিজ্ঞেস করলেই মহবুব আলীর বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধে সত্যাসত্য জানতে পারবেন।

মহবুব আলী বিলক্ষণ জানতেন, লিগেশনের ইংরেজ কর্তাদের সঙ্গে আমার অহিনকুল সম্পর্ক। ওদিকে তিনি যদিও ইংরেজের সেবা করতেন, তবু ভিতরে ভিতরে ওদের তিনি দিল-জান দিয়ে করতেন ঘেন্না, ঘৃণা’ নয়-ঘেন্না। এটা অবশ্য আমার নিছক অনুমান। মহবুব আলীর মত ঝাণ্ডু চাণক্য বাক্য বা আচরণে সেটা প্রকাশ করবেন, সে-চিন্তাও বরাহভক্ষণসম মহাপাপ! বোধ হয় প্রধানত এই কারণেই তিনি আমাকে অত্যন্ত মেহ করতেন। তদুপরি আমি আহমদ আলীর বন্ধু। এবং সর্বশেষ সত্য, আমি বহু-দূরদেশাগত রোগা-পাটকা, নির্বান্ধব, দুনিয়াদারি-বাবদে-বেকুব বাঙালি। এমত অবস্থায় আপনি ভগৱানের শরণ না নিয়ে পাঠানের শরণ নিয়েই বিবেচকের কর্মকরবেন। তবে এ-কথাও বলব, আমি তাঁর শরণ নিই নি। তিনিই আমাকে অনুজরাপে তার হৃদয়ে গ্ৰহণ করেছিলেন।

সে-কথা থাক। আমি আজ তাঁর জীবনী লিখতে বসি নি। আমি লিখতে বসেছি তার স্ত্রীর পরিচারিকা সম্বন্ধে। উল্লসিত পাঠক বিরক্ত হয়ে আমার বাকী লেখাটুকু পড়বেন না, সে-কথা আমি জানি; কিন্তু তার চেয়েও মোক্ষম জানি, আমি যে গুণীজনের মজলিসে দৈবে সৈবে মুখ খোলার অনুমতি পাই, তাদের পৌনে ষোল আনা সহৃদয় সদাশয় জন। তাদের অকৃপণ হৃদয় জন্মদাসী রাজরানী সবাইকে আসন দিতে জানে।

আমার সঙ্গে মহবুব আলীর হৃদ্যতা হওয়ার কয়েকদিন পর আমার ভৃত্য এবং সখা আবদুর রহমান আমাকে যা জানালে তার সারাংশ এই :

মহবুব আলীর পরিবার এবং অন্য এক পরিবারের দুশমনী-লড়াই ক্ষান্ত দেবার জন্য একদা স্থিরীকৃত হয়, দুই পরিবার যেন বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মহবুব আলী এ পরিবারের বড় ছেলে। তাই তাঁকেই বিয়ে করতে হল অন্য পরিবারের বড় মেয়েকে। নবদম্পতি গোড়ার দিকে সুখেই ছিলেন। ইতিমধ্যে বলা নেই-কওয়া নেই, হঠাৎ মহবুব আলীর এক অতি দূর চাচাতো ভাই তাঁর শ্বশুর-পরিবারের ততোধিক দূর এক মামাতো ভাইকে খুন করে। ফলে মহবুব আলীর স্ত্রী পিতৃগণের আদেশানুযায়ী স্বামীগৃহ বৰ্জন করে পিত্ৰালয়ে চলে যান।

আবদুর রহমানের কাহিনী অনুযায়ী এ-ঘটনা ঘটেছিল বছর দশেক পূর্বে। বলতে গেলে এই অবধি মহবুব আলী অকৃতদার। অধুনা অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তিনি শীঘ্রই হিন্দুস্থান থেকে বিয়ে করে অন্য বিবি নিয়ে আসছেন।

সুহৃদ সম্বন্ধে তার অপরোক্ষ আলোচনা করা অসঙ্গত, তা সে ভূত্যের সঙ্গেই হক আর পিতৃব্যের সঙ্গেই হক—এই আমার বিশ্বাস। কিন্তু আবদুর রহমান যখন একবার কথা বলতে আরম্ভ করে তখন তাকে ঠেকানো অসাধ্য ব্যাপার।

শেষটায় আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলুম, ‘তোমারই বা এসব বলার কী দরকার? আমারই বা জেনে কী হবে? তিনি তো আমাকে এসব কিছু বলেন নি?’

আবদুর রহমান বললে, ‘তিনি কেন বলেন নি সে-কথা আমি কী করে জানব? (পরে মহবুব আলীর কাছে শুনেছিলাম, দুঃখের কথা নাকি বন্ধু বন্ধুকে বলে না।) তবে আপনার তো জানা উচিত।’ আলোচনা এখানেই সমাপ্ত হয়।

‘শেখ মহবুব আলী খান বড় ভালো লোক।’

আবদুর রহমান সার্টিফিকেট দেবার সময় রবীন্দ্রনাথের পদাঙ্ক অনুসরণ করে না। একথা বলে রাখা ভাল।

***

শেখ মহবুব আলীর বাসাতে আমি সময় পেলেই যৌতুম। তাঁর বাসাটি লিগেশনের প্রত্যস্ত-প্রদেশে অবস্থিত ছিল বলে ইংরেজের ছায়া না মাড়িয়ে সেখানে পৌঁছানো যেত। তিনি দফতরে থাকলে তার ছেলেবেলাকার বন্ধু এবং চাকর গফুর খান তাঁকে খবর দিতে যেত। আমি ততক্ষণে ড্রইং-রুমে বসে আগুন পোয়াতুম। আর বাবুর্চিকে সবিস্তর বয়ান দিতুম কোন কোন বস্তু খাওয়া আমার বাসনা।

শেখ গফুর ফিরে এসেই আমার পায়ের কাছে বসে ভাঙা ভাঙা উর্দু ফার্সী। পাঞ্জাবী পশতুতে মিশিয়ে গল্প জুড়ে দিত। পাঠানদের ভিতর জাতিভেদ নেই। শেখ গফুর আর মহবুব আলী খান প্রভু-ভৃত্য হলেও তাদের সম্পর্ক ছিল সখ্যোর। তাই গফুর আমার সঙ্গে গল্প করাটা তার কর্তব্য বলে মনে করত; আমি ‘ভদ্রসন্তান’, তার সঙ্গে গল্প করে যে তাকে ‘আপ্যায়িতা করছি, সে-কথা তাকে বললে সে নিশ্চয়ই আশ্চর্য হত। আবদুর রহমান এবং গফুরে যে সৌহার্দ্য ছিল, সে-কথা বলা বাহুল্য।

সচরাচর মহবুব আলীর ড্রয়িং-রুম খোলাই থাকত।

আবদুর রহমান রচিত মহবুব আলীর ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ শোনার কয়েকদিন পর তাঁর বাড়িতে গিয়ে ড্রইংরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখি, সেটা ভিতর থেকে বন্ধ। দরজার হ্যান্ডেলের কাছে তখন দেখি বিজলির বোতাম, কলিং বেল। একটুখানি আশ্চর্য হয়ে ভাবানু, মহবুব আলী আবার কবে থেকে পর্দানশিন হলেন, তার গৃহে মাতা নেই, অপ্রিয়বাদীনী ভাৰ্যা পর্যন্ত নেই, তাঁর গৃহ তো অরণ্যসম। অরণ্যকে ছিটিকিনি দিয়ে বন্ধ করার কা কস্য প্রয়োজন? দিলুম বোতাম টিপে, সঙ্গে সঙ্গে ডাকলুম, ‘ভাই গফুর!’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল। ভেবেছিলুম দেখব গাৰ্টাগোট্টা গালকম্বল গাড়ি সম্বলিত বেঁটে কেলে গফুর মহম্মদ খান। দেখি,—হকচাকিয়ে গেলুম,-দেখি, দীর্ঘ এবং তম্বঙ্গী একটি মেয়ে। পরনে লম্বা শিলওয়ার আর হাঁটু পর্যন্ত নেবে-আসা কুর্তা। ওড়না দিয়ে মাথার অর্ধেক অবধি ঘোমটা।

শ্যামা। এবং সে অতি মধুর শ্যামবর্ণ। পেশওয়ার কাবুলে মানুষের রঙ হয় ফরসা, কিংবা রোদো-পোড়া বাদামী। এ মেয়ের রঙ সেই শ্যাম, যেটি পর্দানশিন বাঙালি মেয়ের হয়। তার কী তুলনা আছে?

বলতে সময় লাগল। কিন্তু প্ৰথম দিন তাকে দেখেছিলুম এক লহমার তরে। আমি তাকে ভাল করে দেখবার পূর্বেই সে দিয়েছিল ভিতরপানে ছুট। তখন লক্ষ্য করছিলুম, সেও আধ লহমার তরে, গুরুগামিনী রমণীর যে যে স্থলে বিধাতা সৌন্দর্য পুঞ্জীভূত করে দেন, তম্বঙ্গীর ক্ষীণ দেহে তার কিছুমাত্র কার্পণ্য করেন নি; বরঞ্চ বলব, তিনি অজন্তার চিত্রকারের মত একটু যেন বাড়াবাড়ি করেছেন। অথচ বয়স পনের-ষোল হয় কি না-হয়। তবে কি বিধাতা মানুষের আঁকা ছবি দেখে তাঁর সৃষ্টির সৌন্দর্য বাড়ান?

তা সে যাক গে। তখন কি আর অত করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিলুম, না, ওই বিষয়ে চিন্তাই করেছিলুম!

আমি আগুনের কাছে গিয়ে বসলুম। খানিকক্ষণ পরে মহবুব আলী এলেন। পাশে বসে ডাক দিলেন, ‘ম-অ-অ-ণি-’

মণি দোরের আড়ালে দাঁড়ালে দুজনাতে পশতু ভাষায় কথাবার্তা হল। আমি তার এক বৰ্ণও বুঝতে পারলুম না। মহবুব আলী আমাকে বললেন, ‘মোটা রান্না এখনও বাবুর্চিই করে কিন্তু মণির হাতে তৈরি নাশতা না হলে আমার বিবির চলে না। মণি বললে, আপনি কী খেতে ভালবাসেন সে ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছে এবং তৈরি করছে! ভালই হল। ও বড় তেজী মেয়ে। যাকে অপছন্দ করে তার রুটিতে হয়তো সেঁকো বিষ দেবে।’

দাবা খেলতে বসলুম এবং যথারীতি হারলুম। খেলার মাঝখানে মণি এসে অন্য টেবিলে নাশতা সাজালে। ‘

সময় নিয়েছে বটে কিন্তু রোধেছে ভাল। মমলেটের রঙটি সর্বাঙ্গে সোনালী হলদে। এখানে বাদামী, সেখানে হলদে, ওখানে সাদা নয়। তে-কোণা পরোটাও তৈরি করেছে যেন টিস্কয়ার সেটাস্কয়ার দিয়ে। ভিতরে ভাঁজে ভোজে কোন জায়গায় কাঁচাও নয়।

খাওয়া শেষ হলে আমি বললুম, ‘আধা ঘণ্টাটাক বসে যাই। সেঁকো বিষ দিয়েছে কি না তার ফলাফল দেখে যাই।’ মণি দাঁড়িয়ে ছিল। সে মহবুব আলীর মুখের দিকে তাকাল। তিনি পশতুতে অনুবাদ করলেন। মণি যাঃ’ কিংবা ওই ধরনের কিছু একটা বলে চলে গেল।

ভবিষ্যৎ দেখতে পেলে তখন ওই কাঁচা রসিকতটুকুও করতাম না।

ইতিমধ্যে মহবুব আলী আমার বাড়িতে একবার এসেছিলেন বলে আমি তার বাড়ি গেলুম দিন পনের পরে। এবারে বাইরের বোতামে চাপ দেওয়া মাত্রেই হুট করে দরজা খুলে গেল।

মণি আমাকে দেখে নিঃসঙ্কোচে পশতু ভাষায় কিচির-মিচির করে উঠল। কিছুতেই থামতে চায় না। আমি একবার সামান্য সুযোগ পেয়ে বললুম, পশতু, তারপর বাঁ হাত উপরের দিকে তুলে ভরতনাট্যম কায়দায় পদ্মফুল ফোঁটাবার মুদ্রা দেখিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলুম, ‘ড্ডনং’। অর্থাৎ আমি পশতু বুঝিনে। কিন্তু কে বা শোনে কার কথা! ভরতনাট্যমে আমি যদি হই খুচরো কারবারী, মণির বেসাতি দেখলুম পাইকিরি লাটের। ডান হাত দিয়ে এক অদৃশ্য বঁটা নিয়ে আকাশের বেশ খানিকটা বঁট দেবার মুদ্রা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলে, ‘কুছ পরওয়া নহী।’ কিন্তু শুধু মুদ্রা দিয়ে তো আর বেশিক্ষণ কথাবার্তা চালানো যায় না। তা হলে মানুষ ভাষার সৃষ্টি না করে শুধু নোচে কুদে ও মুদ্রা দেখিয়েই শঙ্করদর্শনের আলোচনা চালাত, একে অন্যকে এটম বাম বানাবার কৌশল শেখাত।

ইতিমধ্যে গফুর এসে আমার পায়ের কাছে কার্পেটের উপর বসে জানালে মহবুব আলী শহরে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে। তবে পইপই করে বলে গিয়েছেন, আমাকে যেন আটকে রাখা হয়। মণি ততক্ষণে রান্নাঘরে চলে গিয়েছে।

গফুর তার মনিবের সঙ্গে যে-রকম খোলা-দিলে গল্প জমায় আমার সামনে সেই ভাবেই উজির-নাজির কতল করতে আরম্ভ করল। আশকথা-পাশকথা বলে সে শুধালে, ‘মণিকে আপনার কী রকম লাগে?’

আল্লা জানেন, মৌলা আলীর দোহাই, আমি সব নই। দাসী পরিচারিকা সম্বন্ধে আন্তরিকতার সঙ্গে আলোচনা করতে আমার কণামাত্র আপত্তি নেই। আমার সেবক আবদুর রহমানের সঙ্গে আমার বে-ভাবের আদান-প্ৰদান রস-রসিকতা চলত, সে-রকম ধারা আমি বহু ‘শিক্ষিত’। ‘খানদান’ লোকের সঙ্গে করতে রাজী নই। কিন্তু এখানে তো ব্যাপারটা অতখানি সরল নয়। তাই একটু বিরক্তির সুরে বললুম, ‘আমার লাগা না-লাগার কী আছে?’

গফুর আমরা উত্তর শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে সামলে নিয়ে বললে, ‘এ আপনি কী বলছেন! আপনি শেখ মহবুব আলীর দোস্ত। তাঁর ইষ্টকুটুম, গোষ্ঠীপরিবারের পাঠান-পখাতুনের চেয়ে আপনাকে উনি ঢের ঢের বেশি ভালবাসেন। আর আপনি যেভাবে কথা বললেন, তাতে মনে হল ওঁর পরিবারের জন্য আপনার যেন কোন দরদ নেই। আজ যদি মণির বিয়ের সম্বন্ধ আসে। তবে কি মহবুব আলী আপনার সঙ্গে ওই বাবদে সলা পরামর্শ না নিয়ে থাকতে পারবেন?’

আমি শুধালুম, ‘এসেছে নাকি?’ সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে বললুম, থুড়ি, ভুল করলুম, এতখানি ঔৎসুক্য দেখানো উচিত হয় নি। শান্দির পয়লা রাতে বেড়াল মারবে, এ যে দুসারা রাত খতম হবার উপক্রম!’

আমার ভাবান্তর লক্ষ্য না করেই গফুর সোৎসাহে বললে, ‘গণ্ডায় গণ্ডায়। সুবে পেশওয়ার-কোহট, বনু দেরা ইসমাইল খান, ইস্তেক জম্মু জলন্ধর অবধি। লিগেশনের সব কটা পাঠান চাপরাসী-দফতরি, কেরানী খাজাঞ্চী মণিকে শান্দি করতে চায়।’

আমি জানতুম, পাঠানদের আপনি গোষ্ঠীর ভিতর জাতবিচার নেই। কিন্তু সেটা ছিল থিয়োরেটিকল জানা, এখন দেখলুম। সেটা কীরকম মারাত্মক প্র্যাকটিকাল। লিগেশনের খাজাঞ্চী মেলের লোকও পরিচারিকা মণিকে বিয়ে করতে চায়!

ইতিমধ্যে মণি দু-তিনবার ঘরে এসে অগ্নিবাণ হেনে গফুরের দিকে তাকিয়েছে। ভাষা না জেনেই বুঝতে পেরেছে, ওর সম্বন্ধেই কথাবার্তা হয়েছে। আমি গতিক সুবিধের নয় দেখে বললুম ‘থাক্‌ থাক।’

মণি আমার জন্য এক অজানা পেশাওয়ারি কাবাব বানিয়েছে। ভারি মোলায়েম। দেখে মনে হয়। কাঁচা, কিন্তু হাত দিয়ে মুখের কাছে তুলতে না তুলতেই ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে। আমি আগের থেকেই হাঁ করে ছিলুম; মুখে কিছু পৌঁছল না দেখে মণি খিলখিল করে হেসে উঠল। ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ভিতরের দরজা দিয়ে অন্তর্ধান করল।

মহবুব আলী এলেন। দাবার ফাঁকে বললেন, মণিকে নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি।’

আমি বললুম, ‘কিস্তি সামলান। ঘোড়া উঠে, নৌকা ঘোড়ার ডবল কিস্তি।’

মহবুব আলী বললেন, ‘মণিকে নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি।’

আমি বললুম, হঁয়া, আমিও বিপদে পড়েছি। আবদুর রহমান বলছিল, এখন থেকে সবাইকে রাস্তায় দেরেশী পরে বেরুতে হবে। দর্জির দোকানে ভিড় লেগেছে। কী করি, বলুন তো?’

ততক্ষণে খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। আমি যথারীতি হেরে গিয়েছি।

পূর্বেই বলেছি, মহবুব আলী চাণক্যস্য চাণক্য। তাই এটাও জানেন, কখন সাফসাফ খোলাখুলি কথা কইতে হয়। বললেন, মণিকে বিয়ে করার জন্য সব কটা পাঠান আমার দোরে। ধন্না দিচ্ছে। ওদিকে মণি বলে, সে কাউকে বিয়ে করতে চায় না। কেন? আমার বিবি বললেন, সে নাকি—’

আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললুম, ‘বাস, বাস।’

মহবুব আলী আমার উম্মার জন্য তৈরি ছিলেন। আমার দুখানা হাত ধরে বললেন, ‘দোস্ত, আমি জানি, এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আপনি সৈয়দ বংশের ছেলে। আপনারা পাঠানমোগলে বিয়ে শান্দি করেন না। যদিও কুরান হাদিসের রায়, যে-কোনও মুসলমান যে-কোনও মুসলমানীকে বিয়ে করতে পারে। হক কথা। কিন্তু লোকাচার দেশাচারও আছে। সেগুলো মানতে হয়। আজ যদি আপনি আমার বোন কিংবা শালীকে বিয়ে করে দেশে ফেরেন তবে আমি কোনও রকম দুশ্চিন্তা করব না। কিন্তু মণিকে বোঝাই কী করে, আপনার সঙ্গে তার বিয়ে সম্পূর্ণ অসম্ভব। সে ছেলেবেলা থেকে দেখেছে যে-কোনও মেয়ের সঙ্গে যে-কোনও ছেলের বিয়ে হয়। তা যে শুধু পাঠানদের ভিতরেই, সে কী করে জানবে বলুন? বাইরের সংসারে যে অন্য ব্যবস্থা, কী করে বুঝবে বলুন?’

আমি আরও বিরক্ত হয়ে বললুম, আঃ! কী এক স্টর্ম ইন এ টি-পট! তিলকে তাল! আপনার বাড়ির মেয়ে কাকে বিয়ে করতে চায়, না-করতে চায়, তাতে আমার কী?’

মহবুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘হা, আপনার তাতে কী?’

আবদুর রহমানের উপদেশ স্মরণে এল। বললুম, না, না, আপনি আমাকে এতখানি হৃদয়হীন মনে করবেন না। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমাকে যেখানে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং যেস্থলে আমার হাতে কোনও সমাধা নেই, সেখানে আমি উপদেশই বা দিই। কী প্রকারে?’

***

কাবুলে এপিডেমিক সর্দিকাসি দেখা দিল। ঝাড়া দশ দিন ঘরে বন্ধ থাকতে হল। সেরে উঠে শুনি, মহবুব আলী আমার চেয়েও বে-এক্তেয়ার। ভেবেছিলুম। কিছুদিন ও-পাড়া মাড়াব না। তবু যেতে হল।

এবারে মণি দরজা খুলেই যা পশতুর তুবড়ি বাজি, বিডন বিশপ ফলস চালালে, তার সামনে আমি একদম হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। কুমারী পার্বতী কাম্য পতিনিন্দা শুনে ন যযৌ ন তস্থেী হয়েছিলেন, আমি উলটো অবস্থায়। ফল কিন্তু একই।

লক্ষ্য করলুম, মণিকে ভয়ঙ্কর রোগা দেখাচ্ছে। ফার্সীতে শুধালুম, সির্দি হয়েছে নাকি?’ মণি এক বর্ণ ফাঁসী বোঝে না। খলখল করে হেসে বাড়ির ভিতর চলে গেল।

মহবুব এলেন লাঠিতে ভর করে। ঠাণ্ডা দেশের সর্দি, যাবার বেলা মানুষকে অর্ধমৃত করে দিয়ে যায়। বিশেষ করে যাদের চর্বি নিয়ে কারবার।

আমি জানতুম ওই কথাই উঠবে, যদিও আশা করেছিলুম, নাও উঠতে পারে। মণির বেশ উত্তেজনা থেকে অবশ্য আমেজ করেছিলুম, আরও কিছু একটা হয়েছে।

বললেন, ‘ওই যে আমাদের ছোকরা চাপরাসী মাহমুদ জান, রাসকেল না ইডিয়ট কী বলব! সেই ঘটিয়েছে কাণ্ডখানা। আপনি যখন দিন সাতেক এলেন না, তখন ওই মাহমুদ মণিকে একটা খাসা আরব্য উপন্যাস শোনালে। রাসকেলটা গল্প বানাতে আস্ত পাঠান। সে মণিকে বললে, ‘বাদশা আমানুল্লা খান সৈয়দ সায়েবকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এদেশে বিয়ে না করে দামড়ার মত ঘুরে বেড়ানো অত্যন্ত অনুচিত। লোকনিন্দা হয়, বিশেষ করে আপনি যখন শিক্ষক। তারপর সৈয়দ সায়েবের হাত ধরে তাকে নিয়ে গেলেন তার মেয়েইস্কুলে। সেখানে দু’শো মেয়েকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হুকুম দিলেন, বেছে নাও। সৈয়দ সাহেব আর কি করেন! শাহানবাদশার হুকুম। না মানলে গর্দন। আর মেয়েগুলোই বা কি কম খাপসুরত! সৈয়দ সায়েব বিয়ে করে মশগুল। তাই এদিকে আসার ফুরসৎ তার আর কই?’

আমি জীবনে ওই একবারই গীতাবর্ণিত নিষ্কল্প প্রদীপ-শিখাবৎ!

মহবুব আলী বললেন, ‘মণি তো চিৎকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তার পর শয্যা নিল, এই ড্রইং-রুমের দরজার গোড়ায়। একটানা রোজার উপবাস। রাত্রেও খায় না।–’

আমিও শুধালুম, ‘মণি বিশ্বাস করলে ওই গাঁজাখুরি?’

‘কেন করবে না? মণি মাঝে মাঝে মোটরে করে আমার বিবির সঙ্গে শহরে যায়। পথে পড়ে মেয়ে-ইস্কুল! দেখেছে, মেয়েগুলোর বরফের মত ফরসা রঙ, বেদানার মত ট্যাবট্যাবা লাল গাল, ধনুকের মত ভুরু—’

আমি বললুম, ‘থাক থাক। আপনাকে আর কবিত্ব করতে হবে না। কিন্তু আমি তো পছন্দ করি শ্যামবর্ণ—’।

এইবার মহবুব আলীর মুখে ফুটল মধুর হাসি। ন্যাকরা-গলা আবদেরে আবদেরে সুরে বললেন, ‘তা হলে মণিকে ডেকে সেই সুসমাচার শুনিয়ে দি এবং এটাও বলব কি যে, আপনি মণিকে কাবুলী মেয়েদের চেয়ে বেশি খাপসুরত বলে মনে করেন?’

আমি তো রেগে টঙ। চিৎকার করে বললুম, বিলুন, বলুন, বিশ্বসুদ্ধকে বলুন। আমার কী আপত্তি? মণি যখন বিশ্বাস করে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তখন তো আপনার সব সমস্যা সমাধান হয়ে গিয়েছে।’

মহবুব আলী হাসলেন, আরও মধুর হাসি। আমার গা জ্বলে গেল।

অমিয় ছানিয়া বললেন, ‘ওই তো আপনার ভুল। তাই যদি হত। তবে আপনাকে দেখামাত্রই মণি হাসির বন্যা জাগাল কেন? চিৎকার করে তখন কী বলেছে, শুনেছেন? না, আপনি পশতু বোঝেন না। বলেছে, ওঁর হাতে মেহদীর দাগ নেই, উনি বিয়ে করেন নি।’

আমি চুপ। শেষটায় কাতর কণ্ঠে শুধালুম, ‘মেহদীর দাগ ছাড়া কি কখনও বিয়ে হয় না?

মহবুব আলী বললেন, ‘বোঝান গিয়ে মণিকে। আপনাকে কতবার বলেছি, ও পাঠানমেয়ে, ও বোঝে পাঠানদের কায়দাকানুন। ও শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় পাঠানজগতে। বিশ্বভুবনের খবর ও রাখে না। ’

আমি শুধালুম, আপনাকে গতবারে দেখেছিলুম, এ-ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত দুশ্চিস্তাগ্রস্ত। সেটা হঠাৎ কেটে গেল কী প্রকারে? আমার তো মনে হচ্ছে জিনিসটে আরও বেশি প্যাঁচালো হয়ে যাচ্ছে।’

তিন বললেন, ‘পাঠান-মেয়েরা সচরাচর ব্যাপ-চাচার আদেশমত নাক কান বুজে বিয়ে করে। কিন্তু হঠাৎ কখনও যদি পাঠান মেয়ে কাউকে ভালবেসে ফেলে তখন সে আগুনে হাত না দেওয়াই ভাল। ব্যাপারটায় গুরুত্ব গোড়ার দিকে আমি বুঝতে পারি নি; তাই তার একটা সমাধান খুঁজেছিলুম। এখন নিরাশ হয়ে অভয় মেনে বসে আছি।’

আমি আর কী বলব! অত্যন্ত চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরলুম।

***

সমস্যার ফয়সালা করে দিল বাচ্চায়ে সকাও কাবুল আক্রমণ করে। আমি থাকি শহরের মাঝখানে, ব্রিটিশ লিগেশন শহরের বাইরে মাইল দেড়েক দূরে। বাচ্চা এসেছে সেদিক থেকেই এবং থানা গেড়েছে লিগেশন আর শহরের মাঝখানে। লিগেশন আর শহর একে অন্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সেখানে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

কয়েকদিন পরে বাচ্চা হটে গেল। তখন ব্রিটিশ প্লেন এসে বিদেশী মেয়েদের পেশাওয়ার নিয়ে যেতে লাগল। খবর পেয়েই ছুটে গেলুম আমার বন্ধু মৌলানা জিয়াউদ্দীনের স্ত্রীর জন্য একটা সীট যোগাড় করতে।

মহবুব আলীর কলিং-বেল টেপা মাত্রই এবারে দরজা খুলল না। তখন হ্যান্ডেল ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল।

খানিকক্ষণ পর মহবুব আলী এলেন। মুখ বিষ। কোন ভূমিকা না দিয়েই বললেন, ‘কাবুল নিরাপদ স্থান নয় বলে লিগেশনের সব মেয়েদের পেশাওয়ারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমার স্ত্রী চলে গিয়েছেন। মণিও গেছে।’

আমি বলতে চাইলুম, ‘ভালই হল, কিন্তু বলতে পারলুম না।’

তারপর বললেন, ‘আপনাকে বলে কি হবে, তবু বলি। যে কদিন শহর লিগেশন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল সে কদিন এখানে অনেক রকম গুজব পোছত, কেউ বলত কাবুলে লুঠতরাজ আরম্ভ হয়ে গেছে, কেউ বলত বিদেশীদের সব খুন করে ফেলা হয়েছে। আর মণি ছুটোছুটি করেছে, এ-চাপরাসী থেকে ও-চাপরাসীর কাছে, এ-আরদালীর কাছ থেকে ও-আরদালীর কাছে। টাকা দিয়ে লোভ পর্যন্ত দেখিয়েছে, আপনার কুশল সংবাদ নিয়ে আসবার জন্যে।

আমি চুপ।

‘তারপর যখন সে জানতে পারলে তাকেও আমার স্ত্রীর সঙ্গে পেশাওয়ার চলে যেতে হবে তখন এক বিপর্যয় কাণ্ড করে তুললে। কান্নাকাটি জুড়ে দিয়ে বললে, সে কিছুতেই দেশে ফিরে যাবে না। এক রকম গায়ের জোরে তাকে প্লেনে তুলে দিতে হল।’

আমি কিছু বলি নি।

***

একদিন কাবুলে অনেক কষ্ট সওয়ার পর খবর পেলুম, অ্যারোপ্লেনে জিয়াউদ্দীন ও আমার জন্য জায়গা হয়েছে। আগের রাত্রে মহবুব আলী আমাকে গুডজার্নি বাঁভইয়াজ জানাতে এলেন। বিদায়ের সময় আমাকে একটা মোটা খাম দিয়ে বললেন, ‘আপনি পেশাওয়ারে পৌঁছে আমার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মণিকে খবর দেবেন। মণি এলে তার হাতে খামটা দিয়ে বলবেন—এটা মহবুব আলীর স্ত্রীর হাতে দিয়ো।’

আমি বললুম, ‘আমি তো পশতু বলতে পারি নে।’

তিনি কথা কটি উর্দু হরফে লিখে বার তিনেক আমাকে দিয়ে পড়িয়ে নিলেন।

অ্যারোপ্লেনে বসে পরের দিন অনেক চিন্তা করেছিলুম। কী চিন্তা করেছিলুম, সে-কথা দয়া করে জিজ্ঞাসা করবেন না।

পেশাওয়ার পৌঁছেই গেলুম মহবুব আলীর শ্বশুরবাড়ি। বৈঠকখানায় ঢুকে দেখি, দুই বৃদ্ধ মুরুব্বী স্থানীয় লোক বসে আছেন। আমি মহবুব আলীর কুশল সংবাদ জানিয়ে তাদের অনুরোধ জানালুম, মণিকে একটু খবর দিতে। ভদ্রলোকেরা একটু চমকে উঠলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সামলে নিয়ে বললেন, ‘খবর দিচ্ছি। এঁরা চমকে উঠলেন কেন? তবে কি এ-বাড়ির মেয়েরা বৈঠকখানায় আসে না? তাহলে মহবুব আলীর সেটা বোঝা উচিত ছিল।

মণি এল। আমাকে দেখে অন্দরের দোরের গোড়ায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়াল। মুখে কথা নেই। মুরুর্কীদের দিকে একবার তাকালে। র্তারা তখন অন্য দিকে ঘাড় ফিরিয়ে নিয়েছেন। মণি মৃদু কণ্ঠে একটি শব্দ শোধালে, ‘সলামত?’ কথাটা ফার্সী। হয়তো পশতুতেও চলে। অর্থ ‘কুশল?’

আমি ঘাড় নাড়িয়ে বললুম, হ্যাঁ।’

তারপর তার কাছে গিয়ে খামটা দিয়ে সেই শেখা বুলিতে পশতুতে বললুম, ‘এটা মহবুব আলীর স্ত্রীর হাতে দিয়ো।’ মণির মুখ খুশিতে ভরে উঠল। যা বলল সে-ভাষা না জেনেও বুঝতে পারলুম, সে বলছে, পশতু তা হলে শিখেছেন?’

আমি দুঃখ দেখিয়ে ঘাড় নেড়ে না।’ জানালুম।

মণি ভিতরে চলে গেল।

আমি উঠি উঠি করছিলুম। এমন সময় চাকর এসে বললে কিছু খেয়ে যেতে। পাঠানের বাড়িতে না খেয়ে চলে যাওয়া বড় বেয়াদবি।

মণি টেবিলে খাবার সাজিয়ে দোরের আড়ালে দাঁড়াল।

একটি কথা বলল না।

বাড়ি থেকে বেরবার সময় একবার পিছনের দিকে তাকালুম, মণিকে শেষ সেলাম জানাবার জন্য। কোথাও পেলুম না।

টাঙ্গাতে উঠে। উলটো দিকে মুখ করে বসতেই নজর গেল দোতলার বারান্দার দিকে। দেখি মণি দাঁড়িয়ে। মাথায় ওড়না নেই। আর দু চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে, লম্বা লম্বা ধারা বেয়ে।

টাঙ্গা মোড় নিল।

সে রাত্রে দেশের ট্রেন ধরলুম।

Exit mobile version