নিরামিষ আহারে দেহ মন উভয়েরই যেরূপ পুষ্টি হয়, আমিষযুক্ত আহারে সেরূপ হয় না।
আমরা এক শতাব্দীর ঊর্ধ্বকাল একটি প্রবল আমিষাশী জাতির দেহমনের সাতিশয় পুষ্টি অস্থিমজ্জায় অনুভব করিয়া আসিতেছি, মতপ্রচারের উৎসাহে চন্দ্রনাথবাবু সহসা তাহাদিগকে কী করিয়া ভুলিয়া গেলেন বুঝিতে পারি না। তাহারাই কি আমাদিগকে ভোলে, না আমরাই তাহাদিগকে ভুলিতে পারি? তাহাদের দেহের পুষ্টি মুষ্টির অগ্রভাগে আমাদের নাসার সম্মুখে সর্বদাই উদ্যত হইয়া আছে, এবং তাহাদের মনের পুষ্টি যদি অস্বীকার করি তবে তাহাতে আমাদেরই বোধশক্তির অক্ষমতা প্রকাশ পায়।
প্রমাণস্থলে লেখকমহাশয় হবিষ্যাশী অধ্যাপকপণ্ডিতের সহিত আমিষাশী নব্য বাঙালির তুলনা করিয়াছেন। এইরূপ তুলনা নানা কারণে অসংগত।
প্রথমত, মুখের এক কথাতেই তুলনা হয় না। অনির্দিষ্ট আনুমানিক তুলনার উপর নির্ভর করিয়া সর্বসাধারণের প্রতি অকাট্য মত জারি করা যাইতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, যদি-বা স্বীকার করা যায় যে, অধ্যাপকপণ্ডিতেরা মাংসাশী যুবকের অপেক্ষা বলিষ্ঠ ও দীর্ঘজীবী ছিলেন, তথাপি আহারের পার্থক্যই যে সেই প্রভেদের কারণ তাহার কোনো প্রমাণ নাই। সকলেই জানেন অধ্যাপকপণ্ডিতের জীবন নিতান্তই নিরুদ্বেগ এবং আধুনিক যুবকদিগের পক্ষে জীবনযাত্রানির্বাহ বিষম উৎকণ্ঠার কারণ হইয়া পড়িয়াছে, এবং উদ্বেগ যেরূপ আয়ুক্ষয়কর এরূপ আর কিছুই নহে।
নিরামিষাশী শ্রীযুক্ত ঈশানচন্দ্র মুখোপাধ্যায় মহাশয় যতই বলিষ্ঠ ও নম্রপ্রকৃতি হউন-না কেন, তাঁহাকে “সাত্ত্বিক আহারের উৎকৃষ্টতার” প্রমাণস্বরূপে উল্লেখ করা লেখকমহাশয়ের পক্ষে যুক্তিসংগত হয় নাই। আমিও এমন কোনো লোককে জানি যিনি দুইবেলা মাংস ভোজন করেন অথচ তাঁহার মতো মাটির মানুষ দেখা যায় না। আরো এমন ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত অনেক আছে, কিন্তু সেগুলিকে প্রমাণস্বরূপে উল্লেখ করিয়া ফল কী। চন্দ্রনাথবাবুর বিবেচনা করিয়া দেখা উচিত এরূপ ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত প্রমাণস্বরূপে প্রয়োগ করিলে বুঝায় যে, তাঁহার মতে অন্যপক্ষে একজনও বলিষ্ঠ এবং নির্মলপ্রকৃতির লোক নাই।
আধুনিক শিক্ষিত যুবকদের প্রতি চন্দ্রনাথবাবুর অভিযোগ এই যে :
তাঁহারা অসংযতেন্দ্রিয়, তাঁহাদের সংযমশিক্ষা একেবারেই হয় না। এইজন্য তাঁহারা প্রায়ই সম্ভোগপ্রিয়, ভোগাসক্ত হইয়া থাকেন। শুধু আহারে নয়, ইন্দ্রিয়াধীন সকল কার্যেই তাঁহারা কিছু লুব্ধ, কিছু মুগ্ধ, কিছু মোহাচ্ছন্ন।
অসংযতেন্দ্রিয় এবং সংযমশিক্ষাহীন, সম্ভোগপ্রিয় এবং ভোগাসক্ত, মুগ্ধ এবং মোহাচ্ছন্ন, কথাগুলার প্রায় একই অর্থ। উপস্থিতক্ষেত্রে চন্দ্রনাথবাবুর বিশেষ বক্তব্য এই যে, নব্যদের লোভটা কিছু বেশি প্রবল।
প্রাচীন ব্রাহ্মণবটুদের ঐ প্রবৃত্তিটা যে মোটেই ছিল না, এ কথা চন্দ্রনাথবাবু বলিলেও আমরা স্বীকার করিতে পারিব না। লেখকমহাশয় লুব্ধ পশুর সহিত নব্য পশুখাদকের কোনো প্রভেদ দেখিতে পান না। কিন্তু এ কথা জগদ্বিখ্যাত যে, ব্রাহ্মণপণ্ডিতকে বশ করিবার প্রধান উপায় আহার এবং দক্ষিণা। অধ্যাপকমহাশয় ঔদরিকতার দৃষ্টান্তস্থল। যিনি একদিন লুচিদধির গন্ধে উন্মনা হইয়া জাতিচ্যুত ধনীগৃহে ঊর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান হইয়াছিলেন এবং আহারান্তে বাহিরে আসিয়া কৃত কার্য অম্লানমুখে অস্বীকার করিয়াছিলেন তাঁহারই পৌত্র আজ “চপকট্লেটের সৌরভে বাবুর্চি বাহাদুরের খাপরেলখচিত মুর্গিমণ্ডপাভিমুখে ছোটেন’ এবং অনেকে তাহা বাহিরে আসিয়া মিথ্যাচরণপূর্বক গোপনও করেন না। উভয়ের মধ্যে কেবল সময়ের ব্যবধান কিন্তু সংযম ও সাত্ত্বিকতার বড়ো ইতরবিশেষ দেখি না। তাহা ছাড়া নব্য ব্রাহ্মণদিগের প্রাচীন পিতৃপুরুষেরা যে ক্রোধবর্জিত ছিলেন তাঁহাদের তর্ক ও বিচারপ্রণালী দ্বারা তাহাও প্রমাণ হয় না।
যাহা হউক, প্রাচীন বঙ্গসমাজে ষড়্রিপু নিতান্ত নির্জীবভাবে ছিল এবং আধুনিক সমাজে আমিষের গন্ধ পাইবামাত্র তাহারা সব ক’টা উদ্দাম হইয়া উঠিয়াছে, এটা অনেকটা লেখকমহাশয়ের কল্পনামাত্র। তাঁহার জানা উচিত, আমরা প্রাচীন কালের যুবকদিগকে প্রত্যক্ষ দেখিতে পাই না; যাহাদিগকে দেখি তাঁহারা যৌবনলীলা বহুপূর্বে সমাধা করিয়া ভোগাসক্তির বিরুদ্ধে উপদেশ দিতে আরম্ভ করিয়াছেন। এইজন্য আমাদের সহজেই ধারণা হয়, তবে বুঝি সেকালে কেবলমাত্র হরিনাম এবং আত্মারই আমদানি ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে যে-সকল পীতবর্ণ জীর্ণ বৈষয়িক এবং রসনিমগ্ন পরিপক্ক ভোগী বৃদ্ধ দেখা যায়, তাহাতে বুঝা যায়, সত্যযুগ আমাদের অব্যবহিত পূর্বেই ছিল না।
সামিষ এবং নিরামিষ আহারের তুলনা করা আমার উদেশ্যে নহে। আমি কেবল এইটুকু বলিতে চাহি, আহার সম্বন্ধে প্রবন্ধ লিখিতে গিয়া একটা ঘরগড়া দৈববাণী রচনা করা আজকালকার দিনে শোভা পায় না। এখনকার কালে যদি কোনো দৈবদুর্যোগে কোনো লোকের মনে সহসা একটা অভ্রান্ত সত্যের আবির্ভাব হইয়া পড়ে অথচ সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রমাণ দেখা না দেয়, তবে তাঁহার একমাত্র কর্তব্য সেটাকে মনে মনে পরিপাক করা। গুরুর ভঙ্গিতে কথা বলার একটা নূতন উপদ্রব বঙ্গসাহিত্যে সম্প্রতি দেখা দিতেছে। এরূপ ভাবে সত্য কথা বলিলেও সত্যের অপমান করা হয়, কারণ সত্য কোনো লেখকের নামে বিকাইতে চাহে না, আপনার যুক্তি দ্বারা সে আপনাকে প্রমাণ করে, লেখক উপলক্ষ মাত্র।