অধীনতার সহিত যখনি সংগ্রাম করিয়াছে য়ুরোপ তখনি জয়ী হইয়াছে। Catholic ধর্মের অধীনতার উপর Protestant গণ জয়ী হইল। জ্ঞান ধর্ম ও রাজ্য সম্বন্ধীয় অধীনতার বিরুদ্ধে য়ুরোপ বার বার জয়ী হইয়াছে। আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ শাসনের সময় বুদ্ধধর্ম একবার বিদ্রোহ আনয়ন করিয়াছিল– অধীনতাপাশের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের মানবহৃদয় সেই একবার বলপ্রয়োগ করিয়াছিল, কিন্তু পরাভূত হইয়া নির্বাসিত হইল।
২০। ১১। ১৮৮৮, পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক
আলোচনা
“নকলের নাকাল’ সম্বন্ধে
“নকলের নাকাল’ প্রবন্ধে লেখক সাহেবিয়ানার নকল লইয়া ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন।
সমস্ত জাতি ও সমাজের মধ্যে চিরকাল অনুকরণশক্তি কাজ করিয়া আসিতেছে। খ্যাতনামা ইংরেজ লেখক ব্যাজট্ সাহেব তাঁহার “ফিজিক্স্ অ্যাণ্ড পলিটিক্স্’ গ্রন্থে জাতিনির্মাণ কার্যে এই অনুকরণশক্তির ক্রিয়া বর্ণন করিয়াছেন।
গোড়ায় একটা জাতি কী করিয়া বিশেষ একটা প্রকৃতি লাভ করে, তাহা নির্ণয় করা শক্ত। কিন্তু তাহার পরে কালে কালে তাহার যে পরিবর্তনের ধারা চলিয়া আসে, প্রধানত অনুকরণই তাহার মূল। ইংলণ্ডে রাজ্ঞী অ্যানের রাজত্বকালে ইংরেজসমাজ সাহিত্য আচার ব্যবহার যেরূপ ছিল, জর্জ-রাজগণের সময় তাহার অনেক পরিবর্তন হইয়াছিল। অথচ জ্ঞানবিজ্ঞানের নূতন প্রসার এমন-কিছু হয় নাই, যাহাতে অবস্থাপরিবর্তনের গুরুতর কারণ কিছু পাওয়া যায়।
ব্যাজট্ সাহেব বলেন এই-সকল পরিবর্তন তুচ্ছ অনুকরণের দ্বারা সাধিত হয়। একজন কিছু-একটা বদল করে, হঠাৎ কী কারণে সেটা আর-পাঁচজনের লাগিয়া যায়, অবশেষে সেটা ছড়াইয়া পড়ে। হয়তো সেই বদলটা কোনো কাজের নহে; হয়তো তাহাতে সৌন্দর্যও নাই; কিন্তু যে-লোক বদল করিয়াছে, তাহার প্রতিপত্তিবশত বা কী কারণবশত সেটা অনুকরণবৃত্তিকে উত্তেজিত করিতে পারে। এইরূপে পরিবর্তনের বৃহৎ কারণ না থাকিলেও, ছোটোখাটো অনুকরণের বিস্তারে কালে কালে জাতির চেহারা বদল হইয়া যায়।
ব্যাজট্ সাহেবের এ কথা স্বীকার্য। কিন্তু সেইসঙ্গে ইহাও বলা আবশ্যক যে, যেমন সবল সুস্থ শরীর বহিঃপ্রকৃতির সমস্ত প্রভাব নিজের অনুকূল করিয়া লয়, অস্বাস্থ্যকর যাহা-কিছু অতি শীঘ্র পরিত্যাগ করিতে পারে, তেমনই সবলপ্রকৃতি জাতি স্বভাবতই এমন-কিছুই গ্রহণ করে না বা দীর্ঘকাল রক্ষা করে না, যাহা তাহার জাতীয় প্রকৃতিকে আঘাত করিতে পারে। দুর্বল জাতির পক্ষে ঠিক উলটা। ব্যাধি তাহাকে চট করিয়া চাপিয়া ধরে এবং তাহা সে শীঘ্র ঝাড়িয়া ফেলিতে পারে না। বাহিরের প্রভাব তাহাকে অনেক সময় বিকারের দিকে লইয়া যায়, এইজন্য তাহাকে অতিশয় সাবধানে থাকিতে হয়। সবল লোকের পক্ষে যাহা বলকারক, স্বাস্থ্যজনক, রোগা লোকের পক্ষে তাহাও অনিষ্টকর হইতে পারে।
মোগলরাজত্বের সময়েও কি মুসলমানের অনুকরণ আমাদের দেশে ব্যাপ্ত হয় নাই। নিশ্চয়ই তাহাতে ভালোমন্দ দুইই ঘটিয়াছিল। কিন্তু ইংরেজিয়ানার নকলের সহিত তাহার একটি গুরুতর প্রভেদ ছিল, তাহার আলোচনা আবশ্যক।
মুসলমানরাজত্ব ভারতবর্ষেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাহিরে তাহার মূল ছিল না। এইজন্য মুসলমান ও হিন্দু-সভ্যতা পরস্পর জড়িত হইয়াছিল। পরস্পরের মধ্যে স্বাভাবিক আদানপ্রদানের সহস্র পথ ছিল। এইজন্য মুসলমানের সংস্রবে আমাদের সংগীত সাহিত্য শিল্পকলা বেশভূষা আচারব্যবহার, দুই পক্ষের যোগে নির্মিত হইয়া উঠিতেছিল। উর্দুভাষার ব্যাকরণগত ভিত্তি ভারতবর্ষীয়, তাহার অভিধান বহুলপরিমাণে পারসিক ও আরবি। আধুনিক হিন্দুসংগীতও এইরূপ। অন্য সমস্ত শিল্পকলা হিন্দু ও মুসলমান কারিকরের রুচি ও নৈপুণ্যে রচিত। চাপকান-জাতীয় সাজ যে মুসলমানের অনুকরণ তাহা নহে, তাহা উর্দুভাষার ন্যায় হিন্দুমুসলমানের মিশ্রিত সাজ; তাহা ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন আকারে গঠিত হইয়া উঠিয়াছিল।
লেখক লিখিয়াছেন, বিলাতিয়ানার মূল আদর্শ বিলাতে, ভারতবর্ষ হইতে বহুদূরে। সুতরাং এই আদর্শ আমরা অবলম্বন করিলে বরাবর তাহাকে জীবিত রাখিতে পারিব না, মূলের সহিত প্রত্যক্ষ যোগ না থাকাতে, আজ না হউক কাল তাহা বিকৃত হইয়া যাইবে।
বিলাতের যাহা-কিছু সম্পূর্ণ আমাদের করিয়া লইতে পারি, অর্থাৎ যাহাতে করিয়া আমাদের মধ্যে অন্যায় আত্মবিরোধ না ঘটে, চারি দিকের সহিত সামঞ্জস্য নষ্ট না হয়, যাহা আমাদের সহিত মিশ্রিত হইয়া আমাদিগকে পোষণ করিতে পারে, ভারাক্রান্ত বা ব্যাধিগ্রস্ত না করে, তাহাতেই আমাদের বলবৃদ্ধি এবং তাহার বিপরীতে আমাদের আয়ুক্ষয়মাত্র।
সাহেবিয়ানা আমাদের পক্ষে বোঝা। তাহারক কাঠখড় অধিকাংশ বিলাত হইতে আনাতেই হয়, তাহার খরচ অতিরিক্ত। তাহা আমাদের সর্বসাধারণের পক্ষে নিতান্ত দুঃসাধ্য। তাহাতে আমাদের নিজের আদর্শ, নিজের আশ্রয় নষ্ট করে, অথচ তৎপরিবর্তে যে-আদর্শ যে-আশ্রয় দেয়, তাহা আমরা সম্পূর্ণ ভাবে বিশুদ্ধভাবে রক্ষা করিতে পারি না। তীর ছাড়িয়া যে-নৌকায় পা দিই, সে-নৌকার হাল অন্যত্র। মাঝে হইতে স্বেচ্ছাচার-অনাচার প্রবল হইয়া উঠে।
সেইজন্য প্রতিদিন দেখিতেছি, আমাদের দেশী সাহেবিয়ানার মধ্যে কোনো ধ্রুব আদর্শ নাই; ভালোমন্দ শিষ্ট-অশিষ্টর স্থলে সুবিধা-অসুবিধা ইচ্ছা-অনিচ্ছা দখল করিয়া বসিয়াছে। কেহ-বা নিজের সুবিধামতে একরূপ আচরণ করে, কেহ-বা অন্যরূপ; কেহ-বা যেটাকে বিলাতি হিসাবে কর্তব্য বলিয়া জানে, দেশী সমাজের উত্তেজনার অভাবে আলস্যবশত তাহা পালন করে না; কেহ-বা যেটা সকল সমাজের মতেই গর্হিত বলিয়া জানে, স্বাধীন আচারের দোহাই দিয়া স্পর্ধার সহিত তাহা চালাইয়া দেয়। এক দিকে অবিকল অনুকরণ, এক দিকে উচ্ছৃঙ্খল স্বাধীনতা। এক দিকে মানসিক দাসত্ব, অন্য দিকে স্পর্ধিত ঔদ্ধত্য। সর্বপ্রকার আদর্শচ্যুতিই ইহার কারণ।