সঙ্গমবিরহবিকল্পে
বরমপি বিরহো, ন সঙ্গমস্তস্যা
সঙ্গে সৈব তথৈকা
ত্রিভুবনমপি তন্ময়ং বিরহে।
…বিরহে হৃদয়ের স্বাধীনতা থাকে, সে আপনার প্রেম দিয়া সমস্ত বিরহকে পূর্ণ করিয়া ফেলে। এইজন্য… দাম্পত্যের মধ্যে বিরহ আনিয়া প্রেমকে স্বাধীন করিয়া দেওয়া হইয়াছে। কুমারসম্ভবে কুমারী গৌরী একাকিনী মহাদেবের সেবা করিতেছেন ইহা সমাজ নিয়মের ব্যতিক্রম, কিন্তু এ নিয়ম লঙ্ঘন না করিলে তৃতীয়… অমন অতুল্য কাব্যের সৃষ্টি হইবে কী করিয়া? একদিকে বসন্তপুষ্পাভরণা সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতার মতো শিরিষ… বেপথুমতী উমা, আর-একদিকে যোগাসীন মহাদেবের অগাধস্তম্ভিত সমুদ্রবিশাল হৃদয়, চক্ষুর পলকে [উভয়ের] মধ্যে বিশ্ববিজয়ী প্রেমের আকর্ষণ বদ্ধ হইবে কী করিয়া? ইহাতে কঠিন নিয়মের কারাপ্রাচীরের মধ্য হইতেও স্বাধীন প্রকৃতির জয়সংগীত ধ্বনিত হইতেছে। রাধাকৃষ্ণের সমাজবিদ্রোহী প্রেমগান যে আমাদের এই আটঘাট [বাঁধা] সমাজের ও সর্বত্র প্রচলিত হইল ইহাতেও প্রমাণ হইতেছে আমাদের রুদ্ধ হৃদয় ব্যাকুলভাবে প্রেমের স্বাধীনতা [খুঁজিতেছে]। চিরদিন বদ্ধ থাকিয়াও সৌন্দর্যের প্রতি হৃদয়ের সেই স্বাধীন আকাঙক্ষা এখনও সম্পূর্ণ বিনষ্ট [হয় নাই]। কারণ,… সমাজনিয়ম আর যাহাই করুক, প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য আপন জটিল জালের দ্বারা আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতে পারে নাই। প্রকৃতি তাহার বিচিত্র সৌন্দর্য দ্বারা সর্বদা আমাদের সৌন্দর্যচাঞ্চল্য জাগাইয়া রাখে… সে কী করিতে চায়; বৃদ্ধ সমাজপতিরা এই চাঞ্চল্য দমন করিবার জন্য নানা ফন্দি বাহির করেন, কিন্তু সেই চঞ্চলতা জীবন থাকিতে কিছুতেই বাঁধা পড়ে না।
প্রাকৃতিক শক্তি সকলকে লোপ করিয়া বাহাদুরী করাকে সভ্যতা বলে না, সাধারণ মঙ্গলের প্রতি লক্ষ্য করিয়া… নিয়মিত করাই সভ্যতার কার্য। স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে একটি অমোঘ আকর্ষণ আছে এইজন্য ভয়ে ভয়ে তাড়াতাড়ি উভয়ের… দিলে মঙ্গল হয় না, সেই আকর্ষণকে যথানিয়মে মানবের কার্যে প্রয়োগ করা আবশ্যক। আমরা কোনো প্রাকৃতিক শক্তিকে লোপ করিতে পারি না, কিন্তু নিয়মিত করিয়া আপন কার্যে লাগাইতে পারি।
বিদ্যাসুন্দর এবং আমাদের সাধারণ প্রচলিত প্রেমগান হইতে এই প্রমাণ হয় যে, সমাজনিয়মের শাসন সত্ত্বেও প্রেম আমাদের হৃদয় হইতে লুপ্ত হয় নাই, কেবল সূর্যকিরণের অভাবে কলুষিত হইয়া গিয়াছিল। আকাঙক্ষা হৃদয়ে হৃদয়ে বিরাজ করিতেছিল, কেবল তাহা মুক্ত আকাশের অধিকার হইতে বঞ্চিত হইয়া কুঞ্চিত কীটের ন্যায় মৃত্তিকাতলে সহস্র গহ্বর খোদিত করিয়াছিল। হেয় বিকৃত অমরতা লাভ করিয়া সে তলে তলে সমাজকে ধ্বংসের পথে আকর্ষণ করিতেছিল।
২৬। ১১। ১৮৮৮, পারিবারিক স্মৃতিলিপি পুস্তক
আমাদের সভ্যতায়
জ্ঞানের রাস্তার দুই ভাগ আছে– একটা ঐন্দ্রিয়ক অর্থাৎ শারীরিক আর-একটা মানসিক। একটা, ঊতদঢ়ড় প্রত্যক্ষ করা, আরেকটা তাহার মধ্য হইতে তন্ত্র উদ্ভাবন। জলবায়ুর প্রভাবজনিত জড়তাবশত আমাদের দেশে সেই শারীরিক অংশের প্রতি অবহেলা ছিল। সুতরাং মানসিক দিকটাই স্বভাবত অতিপ্রবল হইয়া সমস্ত জ্ঞানরাজ্য অধিকার করিয়া লইল। অলস শরীর পড়িয়া রহিল, মন ঘরে বসিয়া তন্ত্র বাঁধিতে লাগিল।
পৃথিবীর মধ্যে বৃহৎ সমতলক্ষেত্রে বৃহৎ সভ্যতার দুই দৃষ্টান্ত আছে। এক চীন আর-এক ভারতবর্ষ। উভয় দেশেই সভ্যতার মধ্যে জীবনের গতি নাই– নূতন গ্রহণ ও পুরাতন পরিহার নামক জীবনের যে প্রধান তাহা নাই। যাহা কিছু উদ্ভূত হয় তাহা তৎক্ষণাৎ বদ্ধ হইয়া যায়, তাহার আর বর্ধনশক্তি থাকে না। বহিঃপ্রকৃতির সহিত সংঘর্ষণে তাহাদের চরিত্র দৃঢ় হইয়াছে, বাধা অতিক্রমণের চেষ্টাতেই তাহারা স্বভাবত সুখ পায় এবং বহিঃপ্রকৃতিকে তাহারা অবহেলার সামগ্রী মনে করে না, সর্বদাই তাহার প্রতি তাহাদের মনোযোগ দায়ে পড়িয়া আকৃষ্ট হয়। প্রকৃতির সহিত সংগ্রামে কাল্পনিক কেল্লা কোনো কাজেই লাগে না। কঠিন Fact সকলের মধ্যে যে বৃহৎ নিয়ম বিরাজ করে সেই নিয়মকে আবিষ্কার করিলে তবে Facts-এর উপর জয়লাভ করিবার সম্ভাবনা থাকে। এরূপ স্থলে কেহ ইচ্ছা করিয়া ঘরে বসিয়া মিথ্যা মায়াগণ্ডি রচনা করিয়া চোখ বুজিয়া নিজেকে নিরাপদ জ্ঞান করিতে পারে না। শরীর মন দুই একসঙ্গে সমান বলে কাজ করিতে থাকে– তাই দুয়েরই উন্নতি হয় এবং মাঝে হইতে [কাম] সিদ্ধ হয়। আমরা যদি পৃথিবীতে না জন্মিয়া কোনো কল্পনারাজ্যে জন্মিতাম তাহা হইলে কোনো ভাবনা ছিল না; তাহা হইলে কেবলমাত্র মানসিক ও আধ্যাত্মিক চর্চা করিয়া আমরা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিতে পারিতাম। কিন্তু পৃথিবীতে শরীরকে অবহেলা করিয়া মন উন্নতি লাভ করিতে পারে না। বহিশ্চক্ষুকে উপেক্ষা করিয়া কেবল অন্তশ্চক্ষুর সাহায্যে জ্ঞান লাভ করা যায় না। আমাদের দেশে শরীর হইতে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হইয়া [মন] অস্বাভাবিক কুষ্মাণ্ডের মতো অকালে অন্যায়রূপ ডাগর হইয়া উঠিয়াছিল। অনেকগুলো আশ্চর্য আশ্চর্য কাজ করিয়াছিল, কিন্তু কোনোটাই পূর্ণতা লাভ করে নাই, সকলগুলোই মাঝে এক সময় হঠাৎ টোল খাইয়া তুবড়াইয়া বাঁকিয়া শুকাইয়া গেল। অঙ্কুর উদ্গম হইল শস্য হইল কিন্তু তাহার মধ্যে নূতন শস্যের বীজ হইল না। যাহা হইয়াছিল তাহার স্মৃতিমাত্র রহিল। নব নব জীবনের মধ্যে জীবন্ত হইয়া রহিল না। য়ুরোপে Alchemy Chemistry হইল, Astrology Astronomy হইল– কিন্তু আমাদের দেশে শিশুবিজ্ঞান হঠাৎ লম্বা হইয়া উঠিয়া মাজা ভাঙিয়া পড়িয়া রহিল। বোধ হয় ইহার কারণ আমাদের সভ্যতায় মন ও শরীর, অন্তর ও বাহিরের অসমান বিকাশ।