অতএব যিনি যতই বক্তৃতা দিন, দেশের যেরূপ অবস্থা হইয়াছে এবং আমরা যেরূপ শিক্ষা পাইতেছি তাহাতে অবিবাহিত ছেলেমেয়ের বয়সের সীমা বাড়িবেই, কেহ নিবারণ করিতে পারিবে না। কিছুদিন প্রাচীন নিয়ম ও নূতন অবস্থার বিরোধে সমাজে অনেক অসুখ অশান্তি বিশৃঙ্খলা ঘটিবে, এবং ক্রমশ এই মথিত সমাজের আলোড়নে নূতন জীবন নূতন নিয়ম জাগ্রত হইয়া উঠিবে। তাহার সমস্ত ফলাফল আমরা আগে হইতে সম্পূর্ণ বিচার করিয়া স্থির করিতে পারি না। এখন আমাদের সমাজে অনেক মন্দ আছে, কিন্তু অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে বলিয়া সেগুলিকে তত গুরুতর মন্দ বলিয়া মনে হয় না; তখনো হয়তো কতকগুলি অনিবার্য মন্দ উঠিবে যাহা আমরা আগে হইতে কল্পনা করিয়া যত ভীত হইতেছি তখনকার লোকের পক্ষে তত ভীতিজনক হইবে না। দূর হইতে ইংরেজরা আমাদের কতকগুলি সামাজিক অনুষ্ঠানের নামমাত্র শুনিয়া ভয়ে বিস্ময়ে যতখানি চমক খাইয়া উঠেন, ভিতরে প্রবেশ করিলে ততখানি চমক খাইবার কিছুই নাই, সমাজের মধ্যে সন্ধান করিলে দেখা যায়, অনেক অনুষ্ঠানের ভালোমন্দ ভাগ লইয়া একপ্রকার সামঞ্জস্যবিধান হইয়াছে। তেমনি আমরাও দূর হইতে ইংরেজসমাজের অনেক আচারের নাম শুনিয়া যতটা ভয় পাই, ভিতরে গিয়া দেখিলে হয়তো জানিতে পারি ততটা আশঙ্কার কারণ নাই। তাহা ছাড়া অভ্যাসে অনেক ভালোমন্দ সৃজিত হয়। এখন যে-মেয়ে ঘোমটা দিয়া সূক্ষ্ম বসন পরে তাহাকে আমরা বেহায়া বলি না, কিছুকাল পরে যাহারা ঘোমটা না দিয়া মোটা কাপড় পরিবে তাহাদিগকে বেহায়া বলিব না। মনে করো, শ্যালীর সহিত ভগ্নিপতির অনেক স্থলে যেরূপ উপহাস চলে তাহাতে একজন বিদেশের লোক কত কী অনুমান করিয়া লইতে পারে, এবং অনুমান করিলেও তাহাকে দোষ দেওয়া যায় না, কিন্তু সত্য সত্যই ততটা ঘটে না। সমাজের এক নিয়ম অপর নিয়মের দোষসম্ভাবনা কথঞ্চিৎ সংশোধন করে। অতএব কোনো সমাজের একটিমাত্র নিয়ম স্বতন্ত্র তুলিয়া লইয়া তাহার ভালো মন্দ বিচার করিলে প্রতারিত হইতে হয়। এইজন্য আমাদের সমাজের পরিবর্তনে যে-সকল নূতন নিয়ম অল্পে অল্পে স্বভাবতই উদ্ভাবিত হইবে, আগে হইতে তাহার সম্পূর্ণ সূক্ষ্ম বিচার অসম্ভব। তাহারা অকাট্য নিয়মে পরস্পর পরস্পরকে জন্ম দিবে ও রক্ষা করিবে। সমাজে আগে-ভাগে বুদ্ধি খাটাইয়া গায়ে পড়িয়া একটা নিয়মস্থাপন করিতে যাওয়া অনেক সময় মূঢ়তা। সে-নিয়ম নিজে ভালো হইতে পারে, কিন্তু অন্য নিয়মের সংসর্গে সে হয়তো মন্দ। অতএব বাল্যবিবাহ উঠিয়া গেলে আজ তাহার ফল যতটা ভয়ানক বলিয়া মনে হইবে, তাহা হইতে যত বিপদ ও অমঙ্গল আশঙ্কা করিব, তাহার অনেকটা আমাদের কাল্পনিক। কেবল, কতকটা দেখিতেছি এবং অনেকটা দেখিতেছি না বলিয়া এত ভয়।
বলা-বাহুল্য, আমি সমাজের পরিবর্তন সম্বন্ধে যত কথা বলিয়াছি তাহা প্রধানত শিক্ষিত-সমাজের পক্ষে খাটে। অতএব শীঘ্র বাল্যবিবাহ দূর হওয়া শিক্ষিত সমাজেই সম্ভব। কিন্তু তাহা আপনি সহজ নিয়মে হইবে। যাঁহারা আইন করিয়া জবরদস্তি করিয়া এ প্রথা উঠাইতে চান তাঁহারা এ প্রথাকে নিতান্ত স্বতন্ত্র করিয়া লইয়া ইহার দুই-একটি ফলাফলমাত্র বিচার করিয়াছেন, হিন্দুসমাজের বাল্যবিবাহের আনুষঙ্গিক অন্যান্য প্রথা তাঁহারা দেখেন নাই। সামাজিক অন্যান্য সহকারী নিয়মের মধ্য হইতে বাল্যবিবাহকে বলপূর্বক উৎপাটন করিলে সমাজে সমূহ দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলার প্রাদুর্ভাব হইবে। অল্পে অল্পে নূতন অবস্থার প্রভাবে সমাজের সমস্ত নিয়ম নূতন আকার ধারণ করিয়া সমাজের বর্তমান অবস্থার সহিত আপন উপযোগিতাসূত্র বন্ধন করিতেছে। অতএব যাঁহারা বাল্যবিবাহের বিরোধী তাঁহাদিগকে অকারণ ব্যস্ত হইতে হইবে না।
তেমনই, যাঁহারা একান্নবর্তী-পরিবার হইতে বিচ্যুত হইয়া নূতন অবস্থা ও নূতন শিক্ষার আবর্তে পড়িয়া আচার ও উপদেশ হইতে বাল্যবিবাহ দূর করিয়া দিয়াছেন, তাঁহারা ব্রাহ্মসমাজভুক্ত ব্রাহ্ম অথবা বিদেশগমন দ্বারা জাতিচ্যুত হইলেও বিবেচক হিন্দুমণ্ডলী তাঁহাদিগকে দুর্নীতির প্রশ্রয়দাতা মহাপাতকী জ্ঞান না করেন। তাঁহারা কিছুই অন্যায় করেন নাই। তাঁহারা বর্তমান শিক্ষা ও বর্তমান অবস্থার অনুগত হইয়া আপন কর্তব্যবুদ্ধির প্ররোচনায় যুক্তিসংগত কাজই করিয়াছেন। কারণ আমি পূর্বেই বলিয়াছি, অবস্থাবিশেষে বাল্যবিবাহ উপযোগী হইলেও অবস্থাবিপর্যয়ে তাহা অনিষ্টজনক।
এই দীর্ঘ প্রবন্ধে কী কী বলিয়াছি, এইখানে তাহার একটি সংক্ষেপ পুনরাবৃত্তি আবশ্যক।
প্রথম। হিন্দুবিবাহসম্বন্ধে অনেকে অনেক কথাই বলিয়া থাকেন, কিন্তু ঐতিহাসিক পদ্ধতি-অনুসারে হিন্দুবিবাহ সমালোচন না করাতে তাঁহাদের কথার সত্যমিথ্যা কিছুই স্থির করিয়া বলা যায় না। শাস্ত্রের ইতস্তত হইতে শ্লোকখণ্ড উদ্ধৃত করিয়া একই বিষয়ের পক্ষে এবং বিপক্ষে মত দেওয়া যাইতে পারে।
দ্বিতীয়। যাঁহারা বলেন, হিন্দুবিবাহের প্রধান লক্ষ্য দম্পতির একীকরণতার প্রতি, তাঁহাদিগকে এই উত্তর দেওয়া হইয়াছে যে, তাহা হইলে পুরুষের বহুবিবাহ এ দেশে কোনোক্রমে প্রচলিত হইতে পারিত না।
তৃতীয়। আজকাল অনেকেই বলেন হিন্দুবিবাহ আধ্যাত্মিক। তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে, আধ্যাত্মিক শব্দের অর্থ কী। উক্ত শব্দের প্রচলিত অর্থ হিন্দুবিবাহে নানা কারণে প্রয়োগ করা যাইতে পারে না; উক্ত কারণ-সকল একে একে দেখানো হইয়াছে।