এইখানে আমার মনে একটি আশঙ্কা জন্মিতেছে। যে-শব্দের পরিষ্কার অর্থ নাই অথবা নির্দিষ্ট হয় নাই তাহা ইচ্ছামত নানা স্থানে নানা অর্থে প্রয়োগ করা যাইতে পারে। ইহাতে সে-শব্দের উপযোগিতা বাড়ে কি কমে তাহা বিচারের যোগ্য। সকলেই জানেন আমাদের বাংলাভাষায় “ইয়ে’ নামক সর্বভুক্ সর্বনাম শব্দ আছে; শব্দ বা ভাবের অভাব হইলেই তৎক্ষণাৎ “ইয়ে’ আসিয়া ভাষার শূন্যতা পূর্ণ করিয়া দেয়। এই সুবিধা থাকাতে আমাদের মানসিক আলস্য ও ভাবপ্রকাশের অক্ষমতা সাহায্যপ্রাপ্ত হইতেছে। Magnetism-এর স্বরূপ সম্পূর্ণ অবগত না থাকাতে উক্ত শব্দকে আশ্রয় করিয়া অনেক বৈজ্ঞানিক উপকথা সমাজে প্রচলিত হয়। Magnetism-এর কুহেলিকাময় ছদ্মবেশে আবৃত হইয়া আমাদের আর্যশাস্ত্রের অনেক প্রমাণহীন উক্তি ও অর্থহীন আচার বিজ্ঞানের সহিত এক পঙ্ক্তিতে আসন পাইবার মন্ত্রণা করে। সম্প্রতি Psychic Force নামক আর-একটি অজ্ঞাতকুলশীল শব্দ Magnetism-এর পদ অধিকার করিবার চেষ্টা করিতেছে। যতদিন-না স্বরূপ নির্দিষ্ট হইয়া তাহার মুক্তিলাভ হয় ততদিন সে প্রদোষের অন্ধকারে জীর্ণমতের ভগ্নভিত্তির মধ্যে ও দেবতাহীন প্রাচীন দেবমন্দিরের ভগ্নাবশেষে প্রেতের ন্যায় সঞ্চরণ করিয়া বেড়াইবে। অতএব মুক্তির উদ্দেশেই কথার অর্থ নির্দেশ করিয়া দেওয়া আবশ্যক। বিবাহ “আধ্যাত্মিক’ বলিতে কী বুঝায়। যদি কেহ বলেন যে, সাংসারিক কার্য সুশৃঙ্খলে নির্বাহ করিবার অভিপ্রায়ে বিবাহ করার নামই আধ্যাত্মিক বিবাহ, কেবলমাত্র নিজের সুখ নহে সংসারের সুখের প্রতি লক্ষ করিয়া বিবাহ করাই আধ্যাত্মিকতা, তবে বোধ হয় আধ্যাত্মিক শব্দের প্রতি অত্যাচার করা হয়। পার্ল্যামেণ্ট-সভায় সমস্ত ইংলণ্ড এবং তাহার অধীনস্থ দেশের সুখ সম্পদ সৌভাগ্য নির্ধারিত হয়, কিন্তু পার্ল্যামেণ্ট-সভা কি আধ্যাত্মিকতার আদর্শস্বরূপ গণ্য হইতে পারে। যদি বল পার্ল্যামেণ্ট-সভার সহিত ধর্মের কোনো যোগ নাই তাহা ঠিক নহে। দেশের Church যাহাতে যথানিয়মে অব্যাহতরূপে বজায় থাকে পার্ল্যামেণ্টকে তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিতে হয়। উক্ত সভার প্রত্যেক সভ্যকে ঈশ্বরে বিশ্বাস স্বীকার করিতে হয় এবং ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করিতে হয়। যদি বল, পার্ল্যামেণ্টের কার্যকে ইংরেজরা ধর্মকার্য বলিয়া মনে করেন না, কিন্তু বিবাহকে আমরা ধর্মকার্য বলিয়া মনে করি, অতএব আমাদের বিবাহ আধ্যাত্মিক- তবে তৎসম্বন্ধে বক্তব্য এই যে, আমাদের কোন্ কাজটা ধর্মের সহিত জড়িত নহে। সম্মুখযুদ্ধে নিহত হওয়া ক্ষত্রিয়ের ধর্ম ও পুণ্যের কারণ বলিয়া উক্ত হইয়াছে, এমন-কি, ক্রূরকর্মা দুর্যোধনকে যুধিষ্ঠির স্বর্গস্থ দেখিয়া যখন বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করিলেন তখন দেবগণ তাঁহাকে এই বলিয়া সান্ত্বনা করেন যে, ক্ষত্রিয় সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হইয়া যে-ধর্ম উপার্জন করেন তাহারই প্রভাবে স্বর্গ প্রাপ্ত হন। এক্ষণে জিজ্ঞাস্য এই, ক্ষত্রিয় দুর্যোধন যে-যুদ্ধ অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন তাহাকে আধ্যাত্মিক যুদ্ধ বলিবে কি না। শরীর রক্ষার্থে আহারব্যবহার সম্বন্ধে ধর্মের নামে শাস্ত্রে সহস্র অনুশাসন প্রচলিত আছে; তাহার সকলগুলিকে আধ্যাত্মিক বলা যায় কি না। শূদ্রকে শাস্ত্রজ্ঞান দেওয়া আমাদের ধর্মে নিষিদ্ধ, কিন্তু যদি অন্য-একজন ব্রাহ্মণ মাঝখানে থাকেন ও তাঁহাকে উপলক্ষ রাখিয়া শূদ্র শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করে তাহাতে অধর্ম নাই। এক্ষণে জিজ্ঞাস্য এই শূদ্র শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করিলে তাহার আধ্যাত্মিকতার ব্যাঘাত হয় কি না এবং ব্রাহ্মণ মধ্যবর্তী থাকিলেই সে ব্যাঘাত দূর হয় কি না। ধর্মের অঙ্গস্বরূপ নির্দিষ্ট হইলেও এ-সকল লৌকিক নিয়ম না আধ্যাত্মিক নিয়ম? যখন আমাদের সকল কার্যই ধর্মকার্য তখন ধর্মানুষ্ঠানমাত্রকে যদি আধ্যাত্মিকতা বল, তবে আধ্যাত্মিক বিবাহের বিশেষ উল্লেখ করিবার আবশ্যকতা নাই, তবে আমরা যাহাই করি-না কেন আধ্যাত্মিকতার হাত এড়াইবার জো নাই।
যদি বল হিন্দু স্বামীস্ত্রীর সম্বন্ধ অনন্ত সম্বন্ধ, দেহের অবসানে স্বামীস্ত্রীর বিচ্ছেদ নাই এইজন্য তাহা আধ্যাত্মিক, তবে সে কথাও বিচার্য। কারণ হিন্দুশাস্ত্রে কর্মফলানুসারে জন্মান্তরপরিগ্রহ কল্পিত হইয়াছে। স্ত্রীপুরুষের মধ্যে জন্মজন্মান্তরসঞ্চিত কর্মফলের প্রভেদ আছেই, অতএব পরজন্মে পুনরায় উভয়ের দাম্পত্যবন্ধন দৈবক্রমে হইতেও পারে কিন্তু তাহা অবশ্যম্ভাবী নহে। আমাদের শাস্ত্রে জন্মান্তরের ন্যায় স্বর্গনরক কল্পনাও আছে, কিন্তু সকল সময়ে স্ত্রী পুরুষ উভয়েরই যে একত্রে স্বর্গ বা নরকে গতি হইবে তাহা নহে। যদি পুণ্যবলে উভয়েই স্বর্গে যায় তবে পুণ্যের তারতম্য অনুসারে লোকভেদ আছে, এবং পাপভেদে নরকেও সেইরূপ ব্যবস্থা। আমাদের শাস্ত্রে পাপপুণ্যের নিরতিশয় সূক্ষ্ম বিচারের কল্পনা আছে, এ স্থলে বিবাহের অনন্তকালস্থায়িত্ব সম্ভব হয় কিরূপে। অতএব হিন্দুশাস্ত্রমতে সাধারণত ইহজীবনেই দাম্পত্যবন্ধনের সীমা, অতএব তাহাকে ইহলৌকিক অর্থাৎ সাংসারিক বলিতে আপত্তি কিসের। দাম্পত্য বন্ধনের ঐহিক সীমাসম্বন্ধে সাধারণের বিশ্বাস বদ্ধমূল। কুমারী যখম স্বামী প্রার্থনা করে তখন সে বলে, যেন রামের মতো বা মহাদেবের মতো স্বামী পাই। পূর্বজন্মের স্বামী এ জন্মেও আধ্যাত্মিক মিলনে বদ্ধ হইয়া তাহার অনুসরণ করিবে এ বিশ্বাস যদি কুমারীর থাকিত, তবে এ প্রার্থনা সে করিত না। বাল্মীকির রামায়ণে কী আছে স্মরণ নাই, কিন্তু সাধারণে প্রচলিত গান এবং উপাখ্যানে শুনা যায় সীতা রামকে বলিতেছেন, পরজন্মে যেন তোমার মতো স্বামী পাই– কিন্তু তোমাকেই পাই এ কথা কেন বলা হয় নাই।