নিজের সম্মান যে নিজে রাখে না, পরের এমনিই কী মাথাব্যথা তাহাকে সম্মানিত করিতে আসিবে? আমরাই বা কেন আমাদের স্বজাতিকে ঘৃণা করি, স্বভাষায় কথা কই না, স্ববস্ত্র পরিতে চাই না, ইংরাজের রুমালটা কুড়াইয়া দিতে পারিলে গোলোক-প্রাপ্তিসুখ অনুভব করিতে থাকি! আমরা আমাদের ভাষার, আমাদের সাহিত্যের এমন উন্নতি করিতে চেষ্টা না করি কেন, যাহাতে আমাদের ভাষা আমাদের সাহিত্য পরম শ্রদ্ধেয় হইয়া উঠে! যে স্বদেশীয়েরা আমাদের জাতিকে, আমাদের ব্যবহারকে, আমাদের ভাষাকে, আমাদের সাহিত্যকে নিতান্ত হেয় জ্ঞান করিয়া নিজের উন্নতিগর্বে স্ফীত হইয়া উঠেন, তাঁহারাই হয়তো সভা করিয়া জাতীয় সম্মানের জন্য ইংরাজের কাছে নাম-সহি-করা দরখাস্ত পাঠাইতেছেন; নিজে যাহাদিগকে সম্মান করিতে পারেন না, প্রত্যাশা করিতে থাকেন ইংরাজেরা তাহাদিগকে সম্মান করিবে! সে স্থলে স্বজাতি বলিতে বোধ হয় তাঁহারা আপনাদের গুটি কয়েককে বুঝেন ও নিজেদের সামান্য অভিমানে আঘাত লাগাতে স্বজাতির অপমান হইয়াছে জ্ঞান করেন। আমাদের গলার শৃঙ্খলটা ধরিয়া ইংরাজ যদি আমাদিগকে তাহাদের কড়িকাষ্ঠে অত্যন্ত উঁচু জায়গায় লটকাইয়া দেয় তাহা হইলেই কি আমাদের চরম উন্নতি আমাদের পরম সম্মান হইল! যথার্থ স্থায়ী ও ব্যাপক উন্নতি কি আমাদের নিজের ভাষা নিজের সাহিত্য নিজের গৃহের মধ্য হইতে হইবে না! নহিলে পেটের মধ্যে ক্ষুধা লইয়া হাওয়া খাইয়া বেড়াইলে কীরূপ স্বাস্থ্যরক্ষা হইবে! হৃদয়ের মধ্যে আত্মাবমান বহন করিয়া অনুগ্রহলব্ধ বাহিরের সম্মান খুঁটিয়া খুঁটিয়া মোরগপুচ্ছ বিস্তার করিলে মহত্ত্ব কী! যেমন তেলা মাথায় লোকে তেল দেয়, তেমনি টাকগ্রস্ত মাথা হইতে লোকে চুল ছিঁড়িয়া লয়। যে অবমানিত, তাহাকে আরও অবমানিত করিতে লোকে কুণ্ঠিত হয় না। আমরা ঘরে অবমানিত, সেইজন্যই আমাদিগকে পরে অবমান করে। সেইজন্য বলিতেছি, আইস আমরা ঘরের সম্মান রক্ষা করিতে প্রবৃত্ত হই; স্বহস্তে আমাদের উৎকর্ষ সাধন করি; আমাদের গৃহের মধ্যে লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠা করি; তবে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে বল সঞ্চয় হইবে। তখন এমন মহত্ত্ব লাভ করিব যে, পরের কাছে সামান্য সম্মানটুকু না পাইলে দিন রাত্রি খুঁতখুঁত করিয়া মারা পড়িব না।
যাহা বলিলাম, তাহার সংক্ষেপ মর্ম এই– ইংরাজেরা আমাদিগকে সম্মান করে না, তাহাদের অপেক্ষা হীন জ্ঞান করে এইজন্য সর্বত্র শ্বেত-কৃষ্ণের প্রভেদ রাখিতে চায়। এ কথা সকলেই স্বীকার করেন। ইহার প্রতিবিধানের জন্য সকলেই প্রস্তাব করিতেছেন, আমরা ইংরাজের নিকটে খুব গলা ছাড়িয়া বলিতে থাকি, তোমরা আমাদিগকে হীন-জ্ঞান করিয়ো না, তাহা হইলেই তাহারা আমাদিগকে সম্মান করিতে আরম্ভ করিবে।
আমি বলিতেছি, প্রথমত, এ প্রস্তাবটা অসংগত, দ্বিতীয়ত, যদি বা ইংরাজরা আমাদিগের প্রতি সম্মানের ভান করে, তাহাতেই বা আমাদের লাভ কী! বিকারের রোগী কতকগুলা প্রলাপ বকিতেছে দেখিয়া তুমি নাহয় তাহার মুখে কাপড় গুঁজিয়া দিলে কিন্তু তাহার রোগের উপায় কী করিলে! আমাদের দেশের দুরবস্থার কারণ তাহার অস্থি-মজ্জার মধ্যে নিহিত রহিয়াছে, বাহ্যিক লক্ষণ যে-সকল প্রকাশ পাইতেছে তাহা ভালো বৈ মন্দ নহে, কারণ, তাহাতে রোগের নির্ণয় হয়। আমি তাহার রীতিমতো চিকিৎসার জন্য সকলের কাছে প্রার্থনা করিতেছি। আর, রোগও তো এক-আধটা নহে; আমাদের দেশের শরীরং তো ব্যাধিমন্দিরং নহে এ যে একেবারে ব্যাধিব্যারাকং।
যদি আমার এই কথা কাহারো যথার্থ বলিয়া বোধ হয়, যদি দৈবক্রমে আমার এ-সকল কথা কাহারও হৃদয়ের মধ্যে স্থান পায়, তিনি সহসা এমন স্থির করিতে পারেন যে, একটা সভা আহ্বান করিয়া সকলে মিলিয়া দেশের উন্নতি সাধনে প্রবৃত্ত হওয়া যাক। কিন্তু আমার বলিবার অভিপ্রায় তাহা নহে।
এখন আমাদের কী কাজ! এখন কি “সভা’ নামক একটা প্রকাণ্ডকায় যন্ত্রের মধ্যে আমাদের সমস্ত কাজকর্ম ফেলিয়া দিয়া আমরা নিশ্চিন্ত হইব? মনে করিব যে, আমাদের স্বদেশকে একটা এঞ্জিনের পশ্চাতে জুড়িয়া দিলাম, এখন এ ঊর্ধ্বশ্বাসে উন্নতির পথেই ছুটিতে থাকুক! এখন কি Public নামক একটা কাল্পনিক ভাঙা-কুলার উপরে দেশের সমস্ত ছাই ফেলিবার ভার অর্পণ করিব ও যদি তাহাতে ত্রুটি দেখিতে পাই, তবে সেই অনধিগম্য উপছায়ার প্রতি অত্যন্ত অভিমান করিয়া ঘরের ভাত বেশি করিয়া খাইব! অর্থাৎ, কর্তব্য কাজকে কোনো মতেই গৃহের মধ্যে না রাখিয়া অনাবশ্যক জেঠাইমার মতো অবসর পাইবামাত্র সুদূরে গঙ্গাতীরে সমর্পণ করিয়া আসিব ও তাহার পরম সদ্গতি করিলাম মনে করিয়া আত্মপ্রসাদসুখ অনুভব করিব! তাহা নয়। জিজ্ঞাসা করি, Public কোথায়, Public কী! চারি দিকে মরুভূমির এই যে বালুকাসমষ্টি ধূধূ করিতেছে দেখিতেছি, ইহাই কি Public! ইহার মধ্য হইতে কয়েক মুষ্টি একত্র করিয়া স্তূপ করিয়া একটা যে মূর্তির মতো গড়িয়া তোলা হয়, তাহাই কি ঙয়থরভদ ! তাহারই মাথার উপরে আমরা যত পারি কার্যভার নিক্ষেপ করি ও তাহা বার বার ধসিয়া যায়। তাহার মধ্যে অটল স্থায়িত্বের লক্ষণ কি আমরা কিছু দেখিতে পাইতেছি!
কথায় কথায় সভা ডাকিয়া Public নামক একটা কাল্পনিক মূর্তির হৃদয় হাতড়াইয়া বেড়াইবার একটা কুফল আছে। তাহাতে কোনো কাজই হইয়া উঠে না; একটা কাজ উঠিলেই মনে হয়, আমি কী করিব, একটা বিরাট সভা নহিলে এ কাজ হইতে পারে না! আমি একলা যতটুকু কাজ করিতে পারি, ততটুকুও কোনো কালে হইয়া উঠে না। মনে করি, হয় একটা অত্যন্ত ফলাও ব্যাপার করিব, নয় কিছুই করিব না। ক্ষুদ্র কাজ মনে করিলেই হাসি আসে। তাহা ছাড়া হয়তো এমনও মনে হয়, সভা করিয়া তোলা সভ্যদেশপ্রচলিত একটা দস্তুর; সুতরাং সভা না করিয়া কোনো কাজ করিলে মনের তেমন তৃপ্তি হয় না! ইহা ব্যতীত, নিজের উদ্যম নিজের উৎসাহ, নিজের দায়িকতা, অতলস্পর্শ সভার গর্ভে অকাতরে জলাঞ্জলি দিয়া আসা যায়।