আমি বললাম, “আপনার এ কথাগুলি আমাকে ভারি স্পর্শ করেছে। আমারও মনে হত যে, এ বিষয়ে এ বাঙালি এ অ-বাঙালি ব’লে তারস্বরে চীৎকার করা মূঢ়তা, কষ্টিপাথর হচ্ছে– আনন্দের গভীরতা ও স্থায়িত্ব।’
কবিবর বললেন, “নিশ্চয়। আমি বলি এই কথা যে, যখন কোনো কিছু হয়, ফুটে ওঠে, তখনই সেইটাই তার চরম সমর্থন। যদি একটা নূতন সুর দেশ গ্রহণ করে, তখন ওস্তাদ হয়তো আপত্তি করতে পারেন। তিনি তাঁর মামুলি ধারণা নিয়ে বলতে পারেন, “এঃ, এখানটা যেন– যেন– কী রকম অন্যরূপ শোনালো– এখানে এ পর্দাটা লাগল যে!’ আমি বলব, “লাগলই বা।’ রস-সৃষ্টিতে আসল কথা “কেন হল’ এ প্রশ্নের জবাবে নয়, আসল কথা “হয়েছে’ এই উপলব্ধিটিতে।’
আমি গানের প্রসঙ্গে ফিরে আসার জন্য বললাম, “এপর্যন্ত আপনার সঙ্গে আমার মতভেদ তো কিছুই নেই। আমি কেবল আপনার গানের সুরে একটা অনড় রূপ বজায় রাখার বিরোধী।’
রবীন্দ্রনাথ বললেন, “এইখানেই তোমার সঙ্গে আমার মতভেদ। আমি যে গান তৈরি করেছি তার ধারার সঙ্গে হিন্দুস্থানী সংগীতের ধারার একটা মূলগত প্রভেদ আছে– এ কথাটা কেন তুমি স্বীকার করতে চাও না? তুমি কেন স্বীকার করবে না যে, হিন্দুস্থানী সংগীতে সুর মুক্তপুরুষভাবে আপনার মহিমা প্রকাশ করে, কথাকে শরিক বলে মানতে সে যে নারাজ– বাংলায় সুর কথাকে খোঁজে, চিরকুমারব্রত তার নয়, সে যুগলমিলনের পক্ষপাতী। বাংলার ক্ষেত্রে রসের স্বাভাবিক টানে সুর ও বাণী পরস্পর আপস করে নেয়, যেহেতু সেখানে একের যোগেই অন্যটি সার্থক। দম্পতির মধ্যে পুরুষের জোর, কর্তৃত্ব, যদিও সাধারণত প্রত্যক্ষভাবে প্রবল, তবুও উভয়ের মিলনে যে সংসারটির সৃষ্টি হয় সেখানে যথার্থ কে বড়ো কে ছোটো তার মীমাংসা হওয়া কঠিন। তাই মোটের উপর বলতে হয় যে, কাউকেই বাদ দিতে পারি নে। বাংলা সংগীতের সুর ও কথার সেইরূপ সম্বন্ধ। হয়তো সেখানে কাব্যের প্রত্যক্ষ আধিপত্য সকলে স্বীকার করতে বাধ্য নয়, কিন্তু কাব্য ও সংগীতের মিলনে যে বিশেষ অখণ্ড রসের উৎপত্তি হয় তার মধ্যে কাকে ছেড়ে কাকে দেখব তার কিনারা পাওয়া যায় না। হিন্দুস্থানী গানে যদি কাব্যকে নির্বাসন দিয়ে কেবল অর্থহীন তা-না-না ক’রে সুরটাকে চালিয়ে দেওয়া হয় তা হলে সেটা সে গানের পক্ষে মর্মান্তিক হয় না। যে রসসৃষ্টিতে সংগীতেরই একাধিপত্য সেখানে তানকর্তা রাস্তা যতটা অবাধ, অন্যত্র, অর্থাৎ যেখানে কাব্যসংগীতেরই একাসনে রাজত্ব সেখানে, তেমন হতেই পারে না। বাংলা সংগীতের, বিশেষত আধুনিক বাংলা সংগীতের, বিকাশ তো হিন্দুস্থানী সংগীতের ধারায় হয় নি। আমি তো সে দাবি করছিও না। আমার আধুনিক গানকে সংগীতের একটা বিশেষ মহলে বসিয়ে তাকে একটা বিশেষ নাম দাও-না, আপত্তি কী! বটগাছের বিশেষত্ব তার ডাল-আবডালের বহুল বিস্তারে, তালগাছের বিশেষত্ব তার সরলতায় ও শাখা-পল্লবের বিরলতায়। বটগাছের আদর্শে তালগাছকে বিচার কোরো না। বস্তুত তালগাছ হঠাৎ বটগাছের মতো ব্যবহার করতে গেলে কুশ্রী হয়ে ওঠে। তার ঋজু অনাচ্ছন্ন রূপটিতেই তার সৌন্দর্য। সে সৌন্দর্য তোমার পছন্দ না হয় তুমি বটতলার আশ্রয় করো– আমার দুই’ই ভালো লাগে, অতএব বটতলায় তালতলায় দুই জায়গাতেই আমার রাস্তা রইল। কিন্তু তাই ব’লে বটগাছের ডাল-আবডাল-গুলোকে তালের গলায় বেঁধে দিয়ে যদি আনন্দ করতে চাও তা হলে তোমার উপর তালবনবিলাসীদের অভিসম্পাত লাগবে।’
আমি বললাম, “এখানে আপনার কথাগুলো সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার আছে। প্রথমত আমি বলতে চাই এই কথা যে, আপনি যে উপমাটিকে এত বড়ো করে তুললেন সেটি মনোজ্ঞ হলেও কলাকারুর আপেক্ষিক বিচারে এরূপভাবে উপমাকে প্রধান করাতে মূল বিষয়টি সম্বন্ধে অনেক সময় একটু ভুল বোঝার সহায়তা করা হয় ব’লে আমার অনেক সময়ে মনে হয়। ধরুন, হিন্দুস্থানী সুর ও বাংলা গান দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস এ কথা আপনিই বেশি জোর করে বলছেন। অথচ, উপমা দিচ্ছেন দুটো গাছের সঙ্গে, যেন হিন্দুস্থানী সংগীত ও বাংলা সংগীতের মধ্যে প্রকৃতি-ভেদটি অনেকটা বটের শাখাপত্র ও তালের ঋজু রূপের মধ্যে প্রভেদেরই মতন। কিন্তু বস্তুতই কি এ দুই সংগীতের প্রকৃতি-ভেদটি এইরূপ? অন্তত এটা স্বতঃসিদ্ধবৎ ধরে নেওয়া চলে না, এটা প্রমাণসাপেক্ষ, এটা তো মানেন? তবে এ কথা যাক। আমি শুধু আর্টের ক্ষেত্রে রিলেটিভ মূল্য-নির্ধারণের উপমার একান্ত বিশ্বাসযোগ্যতার উপর খুব নির্ভর করা সব সময়ে ঠিক নয় এই কথাটিই বলতে চাই। এখন আমি আপনার মূল যুক্তির সম্পর্কে দু-চারটি কথা বলব। আপনি যে ভাবে রচয়িতার অনুভূতিটিকেই প্রামাণ্য বলে মনে করছেন আমি স্বীকার করি কোনো শিল্প বা শিল্পীর সৃষ্টিকে সে ভাবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু, আর-একটা view-pointও আছে, যেটা নিতান্ত অগভীর নয়, এ কথাও আপনাকে স্বীকার করতে হবে। আনাতোল ফ্রান্স্ কোথায় বেশ বলেছেন যে, “প্রত্যেক সুকুমার’ সাহিত্যের একটা মস্ত মহিমা এই যে, প্রতি পাঠক তার মধ্যে নিজেকেই দেখে। আপনার কবিতার আবেদনও যে বিভিন্ন লোকের কাছে বিভিন্ন রকমের হতে বাধ্য। এ কথা তো আপনাকে মানতেই হবে। তা হলে গানের ক্ষেত্রেই বা তা না হবে কেন? আমার তো মনে হয় শিল্পীর শিল্পসৃষ্টির ভিতরকার কথাটা– শিল্পের মধ্য দিয়ে একটা বিশ্বজনীনতার তারে আঘাত দেওয়া। অর্থাৎ, আমার মনে হয় আসল কথা নানা লোকে আপনার কবিতার মধ্যে দিয়ে কত রকম suggestion-এর খোরাক সংগ্রহ করে। আপনি ঠিক কী ভেবে আপনার নানান কবিতা লিখেছেন বা নানান গান রচনা করেছেন সেটা তো গ্রহীতার কাছে সব চেয়ে বড়ো কথা নয়– বিশেষত যখন একজন কখনোই অপর কারুর প্রাণটি ঠিক ধরতে পারে না। আপনি নিজেই কি লেখেন নি যে, কবিকে লোকে যেমন ভাবে কবি তেমন নয়? তাই আমার মনে হয় যে, সব চেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে আপনার কবিতা বা গানের মধ্য দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন লোকে কী রকম ভিন্ন ভিন্ন রস সঞ্চয় করে। এ কথাটার খুব extreme সিন্ধান্তটিও আমার কাছে ভুল মনে হয় না। অর্থাৎ, যদি একজন যথার্থ শিল্পী আপনার কোনো গানকে সম্পূর্ণ নতুন সুরে গেয়ে আনন্দ পান ও পাঁচজনকে আনন্দ দেন, এমন-কি তা হলেও আপনার তাতে দুঃখ না পেয়ে আনন্দই পাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কেননা, আর্টের কষ্টিপাথর হচ্ছে আনন্দের গভীরতা। অথচ, আপনি বলতে পারেন যে, এ ক্ষেত্রে আপনার গানের মধ্যে “আপনি’ যে সুরটি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন সেটা বজায় রইল না। মান্লাম। কিন্তু– কিছু মনে করবেন না– তাতে কি সত্যই খুব আসে যায়? বিশেষত যখন ভারতীয় গানের ধারায় শিল্পী চিরকাল কম-বেশি স্বাধীনতা পেয়ে এসেছেন এ কথা আপনি অস্বীকার করতে পারেন না।’