ইতিপূর্বে পরম্পরা ও adventure কথা দুটি ব্যবহার করেছি। লিখতে লিখতে আরো অন্য কথা মনে হচ্ছে। ঐ সম্বন্ধে আরো কিছু বলতে চাই। আপনি লিখেছেন, “ঘড়ি দেখি নি, কিন্তু অন্তরে যে ঘড়িটা রক্তের দোলায় চলে তাতে মনে হল এক ঘণ্টা পেরোল বা।’ আমারও বিশ্বাস গান শোনবার সময় কলের ঘড়ি ব্যবহার করা উচিত নয়। নাগ্রার মতন ঘড়ি বাইরে রেখে আসা উচিত। রক্তের দোলায় যে সময় দোলে সেই organic time-এর সঙ্গেই গানের সম্বন্ধ আছে। অবশ্য, রক্তের দোলটাই গানের দোল ভাবলে ভুল করা হবে। আমি organic কথাটি biological অর্থে ব্যবহার করছি না। অনেকের পক্ষে সংগীত-উপভোগটা নিতান্তই জৈব। বড়োলোকের বাড়িতে বিবাহ উপলক্ষে সংগীতকে appetiser হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শরীর অসুস্থ হলে সব গানই দীর্ঘসূত্র, সুস্থ থাকলে সবই ক্ষণিকের মনে হওয়া স্বাভাবিক। থিয়েটার-সিনেমার গান ভাবুন। সে গান শুনতে পারি না, একান্তই জৈব বলে। সেখানে নায়কের প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে নায়িকা কাঁদতে থাকেন, এবং তাঁর ফোঁশ্ ফোঁশানির সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও বেহাগ শুনতে হয়। কিন্তু, আমরা সকলে মিলে কী পাপ করেছিলাম?
আপনি নিশ্চয় “রক্তের দোলা’ ঐভাবে লেখেন নি। আমি যে অর্থে organic time ব্যবহার করছি সেটি mechanical time-এর বিপরীত। এই দুটোর মধ্যে স্বতঃই একটা বিরোধ রয়েছে, আপনার “কিন্তু’ কথাটিতেই সেটি পরিষ্ফুট। মানুষ ঘড়ি মানতে চায় না। খেয়ালের বশেই মানুষ সাধারণত সময় মাপে। utility-র রাজ্যে, কলেজে, ঘড়ি। বৃদ্ধরা বলেন, “দাঁড়াও বাছা, বলছি কবে– পুঁটু তখনো জন্মায় নি।’ চাষাভুষোরা স্মরণীয় ঘটনা, ফসল বোনা, কাটা, প্লাবন ও জলকষ্ট দিয়েই সময় মাপে। ফ্যাক্টরি যে ফ্যাক্টরি, সেখানেও মজুররা যে তাই করে সকলেই জানেন এবং এই সাধারণ জ্ঞানটি পণ্ডিতে অনেক অঙ্ক ক’ষে ছক এঁকে উপলব্ধি করেছেন– প্রভুরা এখনো করেন নি। শ্রমিকের ক্লান্তি আসে আগ্রহের অভাবে। mechanical time হল ঘড়ির কাঁটা-মাপা ঘণ্টা, তার মাপ মিনিট ও সেকেণ্ডের যোগ-বিয়োগে। এবং যেখানে যোগ-বিয়োগই উপভোগের মাত্রা নির্ধারণ করে সেইখানেই “গান থামবে কবে’ প্রশ্নটি শ্রোতাকে উত্ত্যক্ত করে। ক্লান্ত শ্রমিকরাই বিকেলের দিকে ছুটির জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। কিন্তু, সহজ আগ্রহ ও কালের হ্রাসবৃদ্ধির মাপ নেই, ছন্দ আছে। সে ছন্দ সংখ্যামূলক নয়, অর্থাৎ তার পিছনে matter কি motion-এর যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি নেই; আছে সেই-সব ঘটনা ও স্মরণীয় অভিজ্ঞতা যার দরুন বৃদ্ধির হার কমে বাড়ে, তার অবস্থান্তরপ্রাপ্তি হয়। এর তাগিদ থামবার নয়, বাড়বার। অবশ্য, এই প্রকার development কালাতিপাতকে বলাই ভালো। বাংলায় কী প্রতিশব্দ? এক কথায়, mechanical time-এর স্বভাব হল পুনরাবর্তন, organic time-এর হল ঐতিহাসিক উদ্ঘাটন। প্রথমটি হল succession of mathematically isolated instants; দ্বিতীয়টি accumulation of connected experiences, অতএব তার ক্রিয়া cumulative। প্রথমটি গোড়ায় ফিরে আসতে পারে– ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দিলে day-light saving হয়। কিন্তু, দ্বিতীয়টি চলছে নিজের গোঁ-ভরে, তার পরিণতি নেই। প্রথমটিতে যা হয়ে গিয়েছে সেটি গত, ভূত, সত্যকারের ভূত। দ্বিতীয়টিতে যা হয়েছিল সেটি বর্তমানে রয়েছে, আবার ভূত ও বর্তমান মিলে ভবিষ্যৎকে তৈরি করবার জন্য সদাই প্রস্তুত। এগিয়ে চলবার খাতিরে, ভবিষ্যতের জন্য, organic time সব করতে পারে– নতুন, রবাহূত, অনাহূতকে বরণ করতেও সে রাজি। হিন্দুস্থানী সংগীতে আলাপের কাল organic– যে দেশে ঘড়ির dictatorship সে দেশের সংগীতের কাল mechanical হয়তো হতে পারে, ঠিক জানি না। ভাগ্যিস আমরা অসভ্য।
আমি বলছি– আলাপের কালকে ঘড়ির কাঁটা, এমন-কি রক্তের যান্ত্রিক হ্রাসবৃদ্ধি দিয়ে পরিমাণ করা যায় না। আলাপ যে বরফের গোলার মতন বাড়তে বাড়তে চলেছে। রাগিণীর রূপ যে কেবলই উন্মুক্ত হতে হতে চলেছে। আপনি বলছেন করা চাই, খুব খাঁটি কথা, আলাপই তো রাগিণীর (রচনার কথা আলাদা) সত্যকারের unfolding–চীনেদের scroll-painting-এর মতন– আলাপই সত্যকারের ইতিহাস, তাই প্রতিমূহূর্তের ইতিহাস। অবশ্য, রাগিণীরই ইতিহাস, গায়কের গলা সাধার ইতিহাস নয়। রাগিণী ব’লে পৃথক বস্তু নেই, প্রকাশেই তার অস্তিত্বস্ফুরণ।
এই ভাব থেকে আপনার ব্যবহৃত “অনিবার্য’ কথাটির বিচার চলে, তার তত্ত্ব উপলব্ধি করা যায়। অন্য সব আর্টে অনিবার্য সমাপ্তি আছে ইঙ্গিত করেছেন। মানি। কিন্তু, প্রত্যেক আর্ট্বস্তুর সময় যখন organic, অর্থাৎ অভিজ্ঞতাসাপেক্ষ, তখন একই নিয়মে সব আর্টের অনিবার্য সমাপ্তি স্থিরীকৃত হবে কী করে? সাহিত্যই ধরা যাক– রামায়ণ ও রঘুবংশের সমাপ্তি কি এক নিয়ম মানে? Henry IV আর Macbeth-এর চাল কি এক কদমে? Bernard Shaw-ও তাঁর দেশবাসী Sean O’Casey-র নাটক কি একই হারে একই স্থানে থামে? Brothers Karamazov, Fathers and Children-ও তাই। প্রথমটিতে এক দিনের ঘটনাই ৪০০।৫০০ পৃষ্ঠা জুড়ে বসে আছে, তার পর গল্প দ্রুত চলল, শেষ বেশও ঠিক নেই; দ্বিতীয়টিতে একটি চমৎকার ছেদ রয়েছে। আজকালের নভেলিস্ট (Peristley নয়) Proust-ও Joyce-কে আপনার ভালো লাগে কি না জানি না– কিন্তু, তাঁদের লেখার সীমা কোথায়? দুজনের নভেলকে সংগীতের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে– যেন counterpoint-এর খেলা। উপামাটা উপযুক্ত; দুজনেই stream of consciousness নিয়ে ব্যস্ত, দুজনেরই কারবার স্মৃতির উদ্ঘাটনপ্রক্রিয়া– কেউ exhibit করছেন না। আপনারই “গোরা’ ও “চার অধ্যায়’ ধরুন। শেষেরটায় লয় ধুনে, যেন, hectic hurry-তে, যেটি তার বিষয়বস্তুর নিতান্ত ও অত্যন্ত উপযোগী। কিন্তু, “গোরা’র চাল কি ভারী নয়? যেন গজগামিনী। আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি ভালো মন্দ বিচার করছি না– দেবী অশ্বেই আসুন, নৌকাতেই আর গজেই আসুন, দেবী হলে পুজো করব– তাতে কোনো ত্রুটি পাবেন না। আমি বলছি– এক সাহিত্যেই অনিবার্য সমাপ্তির সীমানা, রীতিনীতি, ভিন্ন ভিন্ন। “চার অধ্যায়’ বাঁশি বাজিয়ে শেষ করলেন, আর “গোরা’ লিখতে দু ভলুম লাগল– কেন? “চার অধ্যায়’ পাঁচ অধ্যায় হয় না যেমন, “গোরা’ও তেমনি চার অধ্যায়ে শেষ হয় না।