রবীন্দ্রনাথ একটু থেমে আবার বলতে আরম্ভ করলেন, “বাংলার বৈশিষ্ট্য যে অবিমিশ্র সংগীতে নয় তার একটা প্রমাণ যন্ত্রসংগীতের ক্ষেত্রে মেলে। সংগীতের বিশুদ্ধতম রূপ কিসে? না, যন্ত্রসংগীতে। এ কথা তো অস্বীকার করা চলে না? কিন্তু, দেখো, বাংলাদেশ কখনো হিন্দুস্থানীদের মতো যন্ত্রীর জন্ম দিয়েছে কি? আরো দেখো ওরা কেমন অকিঞ্চিৎকর কথা গানের মধ্যে অম্লানবদনে চালিয়ে দেয়। অক্ষমতাবশত নয়, সুরের তুলনায় তাদের কাছে কথার খাতির কম ব’লে। বাঙালি ভাগ্যদোষে কুকাব্য লিখতে পারে, কিন্তু অকাব্য লিখতে কিছুতেই তার কলম সরবে না। “সামলিয়ানে মোরি এঁদোরিয়া চোরিরে।’ এঁদোরিয়া মানে বুঝি জলের ঘড়ার বিড়ে। শ্যামচাঁদ সেটি চুরি করেছেন, কাজেই তার অভাবে শ্রীরাধার জল আনার মহা অসুবিধা ঘটছে। এইটেই হল সংগীতের বাক্যাংশ। অপর পক্ষে বাঙালি কবি এঁদোরিয়া চুরি নিয়ে পুলিস-কেসের আলোচনা করতে পারে, কিন্তু গান লিখতে পারে না।’
… আমি বললাম, “এ কথা আমি মানি। কিন্তু তাই ব’লে কি আপনি বলতে চান যে ওদের গান শেখা আমাদের পণ্ডশ্রম মাত্র?’
কবিবর জোরের সঙ্গে বলে উঠলেন, “কখনোই নয়। আমরা কি ইংরেজি শিখি না? শিখি তো? কেন শিখি? ইংরেজি সাহিত্যকে আমাদের সাহিত্যে হুবহু নকল করবার জন্য নয়। তার রসপানে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের অন্তর্গূঢ় স্বকীয় শক্তিকেই নূতন উদ্যমে ফলবান করে তোলবার জন্যে। রেনেসাঁস-যুগে ইংরেজি সাহিত্য ধাক্কা পেয়েছিল ইটালি থেকে, কিন্তু তার জাগরণটা তার নিজেরই। শেক্সপিয়রের অধিকাংশ নাট্যবস্তুই বিদেশের আমদানি, কিন্তু তাই ব’লেই শেক্স্পিয়রের রচনা ইংরেজি সাহিত্যে চোরাই মাল এমন কথা তো বলা চলে না। গানের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই; হিন্দুস্থানী সংগীত ভালো করে শিখলে তা থেকে আমরা লাভ না করেই পারব না। তবে এ লাভটা হবে তখনই যখন আমরা তাদের দানটা যথার্থ আত্মসাৎ করে তাকে আপন রূপ দিতে পারব। তর্জমা করে বা ধার করে সত্যিকার রসসৃষ্টি হয় না; সাহিত্যেও না, সংগীতেও না।’
আমি বললাম, “তা তো বটেই। তবে কোনো সভ্যতার দানই তো অনড় অচল থাকতে পারে না। তাই, বাঙালির গান কেন হিন্দুস্থানী সংগীত থেকে লাভ করবে না! এ লাভ করাই তো স্বাভাবিক; কারণ সত্য লাভে তো মৌলিকতা নষ্ট হয় না, অনুকরণেই হয়। আমরা আমাদের নিত্য-নতুন বিচিত্র অভিজ্ঞতা দিয়েই তো শিল্পজগতে নতুন সৃষ্টি করে থাকি? এবং এতেই তো সমৃদ্ধতর হার্মনি গড়ে ওঠে?’
কবিবর বললেন, “ওঠেই তো। দেখো, য়ুরোপীয় সভ্যতার সংস্পর্শে কি আমরা একটা নতুন সমৃদ্ধি লাভ করি নি? না, যদি না করতাম তবে সেটাই বাঞ্ছনীয় হত?’
আমি বললাম, “অবান্তর হলেও এখানে আপনাকে একটা প্রশ্ন করি। অনেকে বলেন যে, অমুক বাঙালি নাট্যকারই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি সাহিত্যিক। যুক্তি জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা উত্তর দেন যে, বর্তমান বাংলা সাহিত্যিকদের মধ্যে এক তাঁর মধ্যেই য়ুরোপের বিন্দুমাত্রও প্রভাব প্রতিফলিত হয় নি। আমার সত্যিই আশ্চর্য মনে হয় যখন আমি বিজ্ঞ ও বুদ্ধিমান লোকের মুখেও অম্লানবদনে এরূপ যুক্তি প্রযুক্ত হতে শুনি। এরূপ কূপমণ্ডূকতা বোধ হয় আমাদের দেশে যে রকম নির্বিচারে হাততালি পায় অন্য কোনো সভ্যদেশে সেভাবে গৃহীত হতে পারে না– নয় কি? আমার তো ব্যক্তিগতভাবে ৺পিতৃদেবের ভাষা, refinement, সমৃদ্ধ রসিকতা, আপনার অপূর্ব লিখনভঙ্গি বা শরৎবাবুর লেখাও– সে খাঁটি বাঙালি সাহিত্যিকের লেখার চেয়ে ঢের উচ্চশ্রেণীর লেখা মনে হয়। আপনার কি মনে হয় না যে, এ রকম নিয়ত “খাঁটি বাঙালি হও’ “খাঁটি বাঙালি হও’ করে চীৎকার করা শুধু সাহিত্যিক chauvinism মাত্র?’
কবিবর বললেন, “তা তো বটেই। দুর্গম গিরিশিখরের উৎস থেকে যে আদি নির্ঝরটি ক্ষীণ ধারায় বইছে তাকেই বিশুদ্ধ গঙ্গা ব’লে মানব আর যে ভাগীরথী উদার ধারায় সমুদ্রে এসে মিলেছে, তার সঙ্গে পথে বহু উপনদীর মিশ্রণ ঘটেছে ব’লে তাকেই অশুদ্ধ ও অপবিত্র বলব– এমন কথা নিশ্চয়ই অশ্রদ্ধেয়। প্রাণের একটা শক্তি হচ্ছে গ্রহণ করার শক্তি, আর-একটা শক্তি হচ্ছে দান করার। যে মন গ্রহণ করতে জানে না সে ফসল ফলাতেও জানে না, সে তো মরুভূমি। যদি বাঙালির বিরুদ্ধে কেউ এ অভিযোগ আনে যে, তার মনের উপর য়ুরোপীয় সভ্যতা সব আগে প্রভাব বিস্তার করেছে, তা হলে আমি তো অন্তত তাতে বিন্দুমাত্রও লজ্জা পাই না, বরং গৌরব বোধ করি। কারণ, এই’ই জীবনের লক্ষ্য।’
আমি বললাম, “আপনার কথাগুলি আমার ভারি ভালো লাগল। আর্টজগতে চিন্তারাজ্যের একটু খবর রাখলেই তো দেখা যায় যে, এক সভ্যতা নিত্য অপর সভ্যতা থেকে নূতন সম্পদের খোরাক জুগিয়ে নিয়েছে– নয় কি? তাই যে দু-চার জন লোক থেকে থেকে তারস্বরে রোদন করে ওঠেন যে “গেল গেল– য়ুরোপীয় সভ্যতার সংস্পর্শে এসে বাঙালির বাঙালিত্ব ঘুচে গেল’, তাঁদের সে আর্তনাদে অন্তত আমার মন তো সাড়া দিতে চায় না।’
কবিবর বললেন, “তা তো বটেই। তা ছাড়া, কোন্টা বাঙালির আর কোন্টা বাঙালির নয়, তার বিচার শোনবার জন্য আমরা কি কোনো স্পেশাল ট্রিবিউনালের মুখ তাকিয়ে থাকব? বাঙালি গ্রহণ-বর্জনের দ্বারাই আপনি তার বিচার করছে। হাজার প্রমাণ দাও-না যে, বিজয়বসন্ত বাংলার বিশুদ্ধ কথাসাহিত্য, বঙ্কিমের নভেল বিশুদ্ধ বঙ্গীয় বস্তু নয়, তবু বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতা বিজয়বসন্তকে ত্যাগ করে বিষবৃক্ষকে গ্রহণ করার দ্বারাই প্রমাণ করছে যে, ইংরাজি-সাহিত্য-বিশারদ বঙ্কিমের নভেল বাংলার নিজস্ব জিনিস। আমি তো একবার তোমার পিতার গানের সম্বন্ধে লিখেছিলাম যে, তাঁর গানের মধ্যেও য়ুরোপীয় আমেজ যদি কিছু এসে থাকে তবে তাতে দোষের কিছু থাকতে পারে না, যদি তার মধ্য দিয়ে একটা নূতন রস ফুটে উঠে বাঙালির রূপ গ্রহণ করে। আর দেখো য়ুরোপীয় সভ্যতা আমাদের দুয়ারে এসেছে ও আমাদের পাশে শতবর্ষ বিরাজ করেছে। আমি বলি– আমরা কি পাথর না বর্বর, যে, তার উপহারের ডালি প্রত্যাখ্যান করে চলে যাওয়াই আমাদের ধর্ম হয়ে উঠবে? যদি একান্ত অবিমিশ্রতাকেই গৌরবের বিষয় বলে গণ্য করা হয়, তা হলে বনমানুষের গৌরব মানুষের গৌরবের চেয়ে বড়ো হয়ে দাঁড়ায়। কেননা, মানুষের মধ্যেই মিশেল চলছে, বনমানুষের মধ্যে মিশেল নেই।’