“শেষ কথা সুরবিহারের সম্বন্ধে। ইংরেজি ইম্প্রভাইজেশন কথাটির তুমি বাংলা করেছ সুরবিহার (বেশ তর্জমা হয়েছে)–এও আমি ভালোবাসি। এতে যে গুণী ছাড়া পায় তাও মানি। আমার অনেক গান আছে যাতে গুণী এ রকম ছাড়া পেতে পারেন অনেকখানি। আমার আপত্তি এখানে মূলনীতি নিয়ে নয়, তার প্রয়োগ নিয়ে।
“কতখানি ছাড়া দেব? আর, কাকে? বড়ো প্রতিভা যে বেশি স্বাধীনতা দাবি করতে পারে এ কথা কে অস্বীকার করবে? কিন্তু, এ ক্ষেত্রে ছোটো বড়োর তফাত আছেই, যে কথা সেদিন বলেছিলাম।
“আর-একটা কথা। গানের গতি অনেকখানি তরল, কাজেই তাতে গায়ককে খানিকটা স্বাধীনতা তো দিতেই হবে, না দিয়ে গতি কী? ঠেকাব কী করে? তাই, আদর্শের দিক দিয়েও আমি বলি নে যে, আমি যা ভেবে অমুক সুর দিয়েছি তোমাকে গাইবার সময়ে সেই ভাবেই ভাবিত হতে হবে। তা যে হতেই পারে না। কারণ, গলা তো তোমার এবং তোমার গলায় তুমি তো গোচর হবেই। তাই এক্স্প্রেশনের ভেদ থাকবেই যাকে তুমি বলছ ইন্টারপ্রেটশনের স্বাধীনতা। বলছিলে বিলেতেও গায়ক-বাদকের এ স্বাধীনতা মঞ্জুর। মঞ্জুর হতে বাধ্য। সাহানার মুখে যখন আমার গান শুনতাম তখন কি আমি শুধু আপনাকেই শুনতাম? না তো। সাহানাকেও শুনতাম; বলতে হত: আমার গান সাহানা গাইছে। তোমার ঢঙের সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এই-যে তোমার একটা নিজস্ব ঢঙ গড়ে উঠেছে, এটা তো খুবই বাঞ্ছনীয়। তাই তোমার স্বকীয় ঢঙে তুমি “হে ক্ষণিকের অতিথি’ গাইলে যে ভাবে, আমার সুরের গঠনভঙ্গি রেখে এক্স্প্রেশনের যে স্বাধীনতা তুমি নিলে, তাতে আমি সত্যিই খুশি হয়েছি। এ গান তুমি গ্রামোফোনে দিতে চাইছ, দিয়ো–আমার আপত্তি নেই। কারণ, এতে আমার সুররূপের কাঠামোটি (structure) জখম হয় নি। তোমার এ কথা আমিও স্বীকার করি যে, সুরকারের সুর বজায় রেখেও এক্স্প্রেশনে কম-বেশি স্বাধীনতা চাইবার এক্তিয়ার গায়কের আছে। কেবল প্রতিভা অনুসারে কম ও বেশির মধ্যে তফাত আছে এ কথাটি ভুলো না। প্রতিভাবানকে যে স্বাধীনতা দেব অকুণ্ঠে, গড়পড়তা গায়ক ততখানি স্বাধীনতা চাইলে “না’ করতেই হবে।’
কবির বলা কথাগুলি লিখলাম দ্বিপ্রহরে ও বিকেলে তাঁকে পড়ে শোনালাম। কবি খুশি হয়ে বললেন, কথাগুলি আমারই এ কথা স্বচ্ছন্দে বলতে পারি, লেখাও খুব ভালো হয়েছে, তুমি ছাপতে পারো।’
৬
…”ললিতসৃষ্টিতে যখন প্রথম দিকে মানুষ খানিকটা চলে আধোছায়া আধোআলোর রাজ্যে তখন অপরে যদি উৎসাহ দেয় তা হলে দেখা যায়–ছায়া কাটে, আলো বাড়ে। সে সময়ে তাই বড়ো কৃতজ্ঞ বোধ হয় যখন দেখি আমি যা উপলব্ধি করছি অপরের মনেও তার রঙ ধরছে–তাই না তারা সায় দিল প্রশংসার ঢেউ তুলে। কিন্তু, পরে–যখন আমাদের আত্মপ্রতীতি দানা বাঁধে, গোধুলির ছায়া যখন আলোর কাছে হার মানে, তখন কী দরকার অপরের স্বীকৃতির? তখন কি মনে হয় না–আমি যা পেয়েছি তা যখন নিশ্চয়ই পেয়েছি তখন অপরের না করায় তো আর সেটা না-পাওয়া হয়ে যেতে পারে না? আনন্দ হল সৃষ্টির অনুষঙ্গী, নিত্যসঙ্গী–সে যখন এসে বলে “অয়মহং ভোঃ–আমি আছি হে’ তখন তাকে নামঞ্জুর করবে সাধ্য কার? কাজেই তখনো কেন আমরা হাত পাতব অপরের কাছে–তা সে আমাদের সমসাময়িকদের কাছেই হোক বা নিত্যকালের ভাবী সভাসদ্দের কাছেই হোক? স্বয়ং আত্মপ্রতীতি যখন শিরোপা দিল তখন অপরের সেলামি তৃপ্তি দিতে পারে, কিন্তু অপরিহার্য সে নয়।
…”আমি যখন গান বাঁধি তখনই সব চেয়ে আনন্দ পাই। মন বলে–প্রবন্ধ লিখি, বক্তৃতা দিই, কর্তব্য করি, এ-সবই এর কাছে তুচ্ছ। আমি একবার লিখেছিলাম–
যবে কাজ করি, প্রভু দেয় মোরে মান। যবে গান করি, ভালোবাসে ভগবান।
এ কথা বলি কেন?–এইজন্যে যে, গানে যে আলো মনের মধ্যে বিছিয়ে যায় তার মধ্যে আছে এই দিব্যবোধ যে, যা পাবার নয় তাকেই পেলাম আপন ক’রে, নতুন ক’রে। এই বোধ যে, জীবনের হাজারো অবান্তর সংঘর্ষ হানাহানি তর্কাতর্কি এ-সব এর তুলনায় বাহ্য– এই’ই হল সারবস্তু–কেননা, এ হল আনন্দলোকের বস্তু, যে লোক জৈবলীলার আদিম উৎস। প্রকাশলীলায় গান কিনা সব চেয়ে সূক্ষ্ম etherealতাই তো সে অপরের স্বীকৃতির স্থূলতার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তাই নয়, নিজের হৃদয়ের বাণীকে সে রাঙিয়ে তোলে সুরে। যেমন, ধরো, যখন ভালোবাসার গান গাই তখন পাই শুধু গানের আনন্দকেই না; ভালোবাসার উপলব্ধিকেও মেলে এমন এক নতুন নৈশ্চিত্যের মধ্যে দিয়ে যে, মন বলে পেয়েছি তাকে যে অধরা, যে আলোকবাসী, যে “কাছের থেকে দেয় না ধরা–দূরের থেকে ডাকে’।
“কিন্তু, তা ব’লে এ কথা মনে করে বোসো না যেন যে, নিত্যকালের সাড়াকে আমি অস্বীকার করছি। বরং নিত্যকালকে মানি ব’লেই বর্তমান কালকে অতিস্বীকারের মর্যাদা দিতে বাধে। না বেধেই পারে না। কারণ, প্রতি যুগের মধ্যেই আছে বটে কয়েকটি নিত্যকালের মন, যাদের নাম রসিক মন–কিন্তু, বাকি সব? তাদের মন তো নিত্যমন নয়, সত্য রসিক তো তারা নয়। অতীত কালের সাড়া দেবার নানান ধারা পর্যালোচনা ক’রে ও ভাবী কালের সাড়া কল্পনা করে তবে এ কথা বুঝতে পারি, চিনতে পারি তাদেরকে যাদের জন্য গান বাঁধি, কবিতা লিখি।…
“য়ুরোপে প্রথম যৌবনে যখন আমি ওদের গান শুনতে যাই তখন আমার ভালো লাগে নি। কিন্তু, আমি দেখতাম সার বেঁধে পর পর ওরা দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা টিকিটের জন্যে। কী যে আগ্রহ, কী যে আনন্দ ওদের ভালো কন্সার্ট-হলে ভালো গান শুনে–দেখেছ তো তুমিও স্বচক্ষে। প্রথম-প্রথম আমি বুঝতাম না ওদের গান। কিন্তু, তা ব”লে এ কথা কখনো বলি নি যে, ওদের কী যে সব বাজে গান! বলতাম আমিই বুঝতে পারছি না এর মর্ম, ওদের গানের ইডিয়ম জানি নে ব’লে, শিখি নি ব’লে। অর্থাৎ, ওদের গানে প্রথম-প্রথম আনন্দ না পেলেও এমন অশ্রদ্ধার কথা কোনোদিন বলি নি যে, আনন্দ পাওয়াটা ওদের অন্যায়।