মানুষের চরিত্র, বিশেষত তাহার দোষগুলি, ঝোপঝাপের মধ্যেই থাকে এবং পায়ের শব্দ শুনিলেই দৌড় মারিতে চায়, এইজন্যই নিন্দার এত সুখ। আমি নাড়ী-নক্ষত্র জানি, আমার কাছে কিছুই গোপন নাই, নিন্দুকের মুখে এই কথা শুনিলেই বোঝা যায়, সে ব্যক্তি জাত-শিকারি। তুমি তোমার যে অংশটা দেখাইতে চাও না আমি সেইটাকেই তাড়াইয়া ধরিয়াছি। জলের মাছকে আমি ছিপ ফেলিয়া ধরি, আকাশের পাখিকে বাণ মারিয়া পাড়ি, বনের পশুকে জাল পাতিয়া বাঁধি–ইহা কত সুখের! যাহা লুকায় তাহাকে বাহির করা, যাহা পালায় তাহাকে বাঁধা, ইহার জন্য মানুষ কী না করে!
দুর্লভতার প্রতি মানুষের একটা মোহ আছে। সে মনে করে যাহা সুলভ তাহা খাঁটি নহে, যাহা উপরে আছে তাহা আবরণমাত্র, যাহা লুকাইয়া আছে তাহাই আসল। এইজন্যই গোপনের পরিচয় পাইলে সে আর-কিছু বিচার না করিয়া প্রকৃতের পরিচয় পাইলাম বলিয়া হঠাৎ খুশি হইয়া উঠে। এ কথা সে মনে করেন যে, উপরের সত্যের চেয়ে নীচের সত্য যে বেশি সত্য তাহা নহে; এ কথা তাহাকে বোঝানো শক্ত যে, সত্য যদি বাহিরে থাকে তবুও তাহা সত্য এবং ভিতরে যেটা আছে সেটা যদি সত্য না হয় তবে তাহা অসত্য। এই মোহবশতই কাব্যের সরল সৌন্দর্য অপেক্ষা তাহার গভীর তত্ত্বকে পাঠক অধিক সত্য বলিয়া মনে করিতে ভালোবাসে এবং বিজ্ঞ লোকেরা নিশাচর পাপকে আলোকচর সাধুতার অপেক্ষা বেশি বাস্তব বলিয়া তাহার গুরুত্ব অনুভব করে। এইজন্য মানুষের নিন্দা শুনিলেই মনে হয় তাহার প্রকৃত পরিচয় পাওয়া গেল। পৃথিবীতে অতি অল্প লোকের সঙ্গই আমাকে ঘরকন্না করিতে হয়, অথচ এত-শত লোকের প্রকৃত পরিচয় লইয়া লাভটা কী? কিন্তু প্রকৃত পরিচয়ের জন্য ব্যগ্রতা মানুষের স্বভাবসিদ্ধ ধর্ম, সেটা মনুষ্যত্বের প্রধান অঙ্গ, অতএব তাহার সঙ্গ বিবাদ করা চলে না; কেবল যখন দুঃখ করিবার দীর্ঘ অবকাশ পাওয়া যায় তখন এই ভাবি যে, যাহা সুন্দর, যাহা সম্পূর্ণ, যাহা ফুলের মতো বাহিরে বিকশিত হইয়া দেখা দেয়, তাহা বাহিরে আসে বলিয়াই বুদ্ধিমান মানুষ ঠকিবার ভয়ে তাহাকে বিশ্বাস করিয়া তাহাতে সম্পূর্ণ আনন্দ ভোগ করিতে সাহস করে না। ঠকাই কি সংসারে চরম ঠকা? না-ঠকাই কি চরম লাভ?
কিন্তু এ-সকল বিষয়ের ভার আমার উপরে নাই, মনুষ্যচরিত্র আমি জন্মিবার বহু পূর্বেই তৈরি হইয়া গেছে। কেবল এই কথাটা আমি বুঝিবার ও বুঝাইবার চষ্টায় ছিলাম যে সাধারণত মানুষ নিন্দা করিয়া যে সুখ পায় তাহা বিদ্বেষের সুখ নহে। বিদ্বেষ কখনোই সাধারণভাবে সুখকর হইতে পারে না এবং বিদ্বেষ সমস্ত সমাজের স্তরে স্তরে পরিব্যপ্ত হইলে যে বিষ হজম করা সমাজের অসাধ্য। আমরা বিস্তর ভালো লোক নিরীহ লোককেও নিন্দা করিতে শুনিয়াছি; তাহার কারণ এমন নহে যে সংসারে ভালো লোক, নিরীহ লোক নাই–তাহার কারণ এই যে, সাধারণত নিন্দার মূল প্রস্রবণটা মন্দভাব নয়।
কিন্তু বিদ্বেষমূলক নিন্দা সংসারে একেবারেই নাই, একথা লিখিতে গেলে সত্যযুগের জন্য অপেক্ষা করিতে হয়। তবে সে নিন্দা সম্বন্ধে অধিক কথা বলিবার নাই। কেবল প্রার্থনা এই যে, এরূপ নিন্দা যাহার স্বভাবসিদ্ধ সেই দুর্ভাগাকে যেন দয়া করিতে পারি।
অগ্রহায়ণ, ১৩০৯
পাগল
পশ্চিমের একটি ছোটো শহর। সম্মুখে বড়ো রাস্তার পরপ্রান্তে খোড়ো চালগুলার উপরে পাঁচ-ছয়টা তালগাছ বোবার ইঙ্গিতের মতো আকাশে উঠিয়াছে, এবং পোড়ো বাড়ির ধারে প্রাচীন তেঁতুল গাছ তাহার লঘুচিক্কণ ঘন পল্লবভার সবুজ মেঘের মতো স্তূপে স্তূপে স্ফীত করিয়া রহিয়াছে। চালশূন্য ভামা ভিটার উপরে ছাগ-ছানা চরিতেছে। পশ্চাতে মধ্যাহ্ন-আকাশের দিগন্তরেখা পর্যন্ত বনশ্রেণীর শ্যামলতা।
আজ এই শহরটির মাথার উপর হইতে বর্ষা হঠাৎ তাহার কালো অবগুণ্ঠন একেবারে অপসারিত করিয়া দিয়াছে।
আমার অনেক জরুরি লেখা পড়িয়া আছে-তাহারা পড়িয়াই রহিল। জানি, তাহা ভবিষ্যতে পরিতাপের কারণ হইবে; তা হউক, সেটুকু স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। পূর্ণতা কোন্ মূর্তি ধরিয়া হঠাৎ কখন আপনার আভাস দিয়া যায় তাহা তো আগে হইতে কেহ জানিয়া প্রস্তুত হইয়া থাকিতে পারে না, কিন্তু যখন সে দেখা দিল তখন তাহাকে শুধু-হাতে অভ্যর্থনা করা যায় না। তখন লাভক্ষতির আলোচনা যে করিতে পারে সে খুব হিসাবি লোক, সংসারে তাহার উন্নতি হইতে থাকিবে, কিন্তু হে নিবিড় আষাঢ়ের মাঝখানে একদিনের জ্যোতির্ময় অবকাশ, তোমার শুভ্রমেঘমাল্যখচিত ক্ষণিক অভ্যুদয়ের কাছে আমার সমস্ত জরুরি কাজ আমি মাটি করিলাম–আজ আমি ভবিষ্যতের হিসাব করিলাম না–আজ আমি বর্তমানের কাছে বিকাইলাম।
দিনের পর দিন আসে, আমার কাছে তাহারা কিছুই দাবি করে না; তখন হিসাবের অঙ্ক ভুল হয় না, তখন সকল কাজই সহজে করা যায়। জীবনটা তখন এক দিনের সঙ্গ আর-এক দিন, এক কাজের সঙ্গ আর-এক কাজ দিব্য গাঁথিয়া-গাঁথিয়া অগ্রসর হয়; সমস্ত বেশ সমানভাবে চলিতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ কোনো খবর না দিয়া একটা বিশেষ দিন সাত-সমুদ্র-পারের রাজপুত্রের মতো আসিয়া উপস্থিত হয়, প্রতিদিনের সঙ্গ তাহার কোনো মিল হয় না, তখন মুহূর্তের মধ্যে এতদিনকার সমস্ত খেই হারাইয়া যায়–তখন বাঁধা কাজের পক্ষে বড়োই মুশকিল ঘটে।
কিন্তু এই দিনই আমাদের বড়ো দিন–এই অনিয়মের দিন, এই কাজ নষ্ট করিবার দিন। যে দিনটা আসিয়া আমাদের প্রতিদিনকে বিপর্যস্ত করিয়া দেয় সেইদিন আমাদের আনন্দ। অন্যদিনগুলি বুদ্ধিমানের দিন, সাবধানের দিন, আর একটা দিন পুরা পাগলামির কাছে সম্পূর্ণভাবে উৎসর্গ-করা।