আমাদের দেশের সংগীতে কী ইহাই আমরা অনুভব করি না। য়ুরোপের সংগীতে দেখিতে পাই, মানুষের সমস্ত ঢেউ-খেলার সঙ্গে তাহার তাল-মানের যোগ আছে, মানুষের হাসিকান্নার সঙ্গে তাহার প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ। আমাদের সংগীত মানুষের জীবনলীলার ভিতর হইতে উঠে না, তাহার বাহির হইতে বহিয়া আসে। য়ুরোপের সংগীতে মানুষ আপনার ঘরের আলো, উৎসবের আলো, নানা রঙের ঝাড়ে লণ্ঠনে বিচিত্র করিয়া জ্বালাইয়াছে; আমাদের সংগীতে দিগন্ত হইতে চাঁদের আলো আসিয়া পড়িয়াছে। সেইজন্য বারবার ইহা অনুভব করিয়াছি, আমাদের সংগীত আমাদের সুখদুঃখকে অতিক্রম করিয়া চলিয়া যায়। আমাদের বিবাহের রাত্রে রশনচৌকিতে সাহানা বাজে। কিন্তু, সেই সাহানার তানে মধ্যে প্রমোদের ঢেউ খেলে কোথায়। তাহার মধ্যে যৌবনের চাঞ্চল্য কিছুমাত্র নাই, তাহা গম্ভীর, তাহার মিড়ের ভাঁজে ভাঁজে করুণা। আমাদের দেশে আধুনিক বিবাহে সানাইয়ের সঙ্গে বিলাতি ব্যাণ্ড বাজানো বড়োমানুষি বর্বরতার একটা অঙ্গ। উভয়ের প্রভেদ একেবারে সুস্পষ্ট। বিলাতি ব্যাণ্ডের সুরে মানুষের আমোদ-আহ্লাদের সমারোহ ধরণী কাঁপাইয়া তুলিতেছে; যেমন লোকজনের ভিড়,যেমন হাস্যালাপ, যেমন সাজসজ্জা, যেমন ফুলপাতা-আলোকের ঘটা, ব্যাণ্ডের সুরের উচ্ছ্বাসও ঠিক তেমনি। কিন্তু, বিবাহের প্রমোদসভাকে চারি দিকে বেষ্টন করিয়া যে অন্ধকার রাত্রি নিস্তব্ধ হইয়া আছে, যেখানে লোকলোকান্তরের অনন্ত উৎসব নীরব নক্ষত্রসভায় প্রশান্ত আলোকে দীপ্যমান, সাহানার সুর সেইখানকার বাণী বহন করিয়া প্রবেশ করে। আমাদের সংগীত মানুষের প্রমোদশালার সিংহাদ্বারটা ধীরে ধীরে খুলিয়া দেয় এবং জনতার মাঝখানে আসীমকে আহ্বান করিয়া আনে। আমাদের সংগীত একের গান, একলার গান– কিন্তু তাহা কোণের এক নহে, তাহা বিশ্বব্যাপী এক।
হার্মনি অতিমাত্র প্রবল হইলে গীতটিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফলে, এবং গীত যেখানে অত্যন্ত স্বতন্ত্র হইয়া উঠিতে চায় সেখানে হার্মনিকে কাছে আসিতে দেয় না। উভয়ের মধ্যে এই বিচ্ছেদটা কিছুদিন পর্যন্ত ভালো। প্রত্যেকের পূর্ণপরিণত রূপটিকে পাইবার জন্য কিছুকাল প্রত্যেকটিকে সাতন্ত্র্যের অবকাশ দেওয়াই উচিত। কিন্তু, তাই বলিয়া চিরকালই তাহাদের আইবুড় থাকাটাকে শ্রেয় বলিতে পারি না। বর ও কন্যা যতদিন যৌবনের পূর্ণতা না পায় ততদিন তাহাদের পৃথক হইয়া বাড়িতে দেওয়াই ভালো, কিন্তু তার পরেও যদি তাহারা মিলিতে না পারে তবে তাহারা অসম্পূর্ণ হইয়া থাকে। গীত ও হার্মনির যে মিলিবার দিন আসিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। সেই মিলনের আয়োজনও শুরু হইয়াছে।
গ্রামে হপ্তায় বিশেষ একদিন হাট বসে, বৎসরে বিশেষ একদিন মেলা হয়। সেইদিন পরস্পরের পণ্যবিনিময় করিয়া মানুষের যাহার যাহা অভাব আছে তাহা মিটাইয়া লয়। মানুষের ইতিহাসেও তেমনি এক-একটা যুগে হাটের দিন আসে; সেদিন যে যার আপন আপন সামগ্রী ঝুড়িতে করিয়া আনিয়া পরের সামগ্রী সংগ্রহ করিতে আসে। সেদিন মানুষ বুঝিতে পারে একমাত্র নিজের উৎপন্ন জিনিসে মানুষের দৈন্য দূর হয় না; বুঝিতে পারে, নিজের ঐশ্বর্যের একমাত্র সার্থকতা এই যে, তাহাতে পরের জিনিস পাইবার অধিকার জন্মে। এইরূপ যুগকে য়ুরোপের ইতিহাসে রেনেসাঁসের যুগ বলিয়া থাকে। পৃথিবীতে বর্তমান যুগে যে রেনেসাঁসের হাট বসিয়া গেছে এত বড়ো হাট ইহার আগে আর-কোনোদিন বসে নাই। তাহার প্রধান কারণ, আজ পৃথিবীতে চারি দিকের রাস্তা যেমন খোলসা হইয়াছে এমন আর-কোনোদিন ছিল না।
কিছুদিন পূর্বে একজন মনীষী আমাকে বলিয়াছিলেন, য়ুরোপে ভারতবর্ষীয় রেনেসাঁসের একটা কাল আসন্ন হইয়াছে। ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক ভাণ্ডারে যে সম্পদ সঞ্চিত আছে হঠাৎ তাহা য়ুরোপের নজরে পড়িতেছে এবং য়ুরোপ অনুভব করিতেছে, সেগুলিতে তাহার প্রয়োজন আছে। এতদিন ভারতবর্ষের চিত্রশিল্প ও স্থাপত্য য়ুরোপের অবজ্ঞাভাজন হইয়াছিল, এখন তাহার বিশেষ একটি মহিমা য়ুরোপ দেখিতে পাইয়াছে।
অতি অল্পকাল হইল ভারতবর্ষীয় সংগীতের উপরও য়ুরোপের দৃষ্টি পড়িয়াছে। আমি ভারতবর্ষে থাকিতেই দেখিয়াছি, য়ুরোপীয় শ্রোতা তন্ময় হইয়া সুরবাহারে বাগেশ্রী রাগিণীর আলাপ শুনিতেছেন। একদিন দেখিলাম, একজন ইংরেজ শ্রোতা একটি সভায় বসিয়া দুইজন বাঙালি যুবকের নিকট সামবেদের গান শুনিতেছেন। গায়ক দুইজন বেদমন্ত্রে ইমন-কল্যাণ ভৈরবী প্রভৃতি বৈঠকি সুর যোগ করিয়া তাঁহাকে সামগান বলিয়া শুনাইতেছেন। তাঁহাকে আমর বলিতে হইল, এ জিনিসটাকে সামগান বলিয়া গ্রহণ করা চলিবে না। দেখিলাম, তাঁহাকে সতর্ক করিয়া দেওয়া আমার পক্ষে নিতান্ত বাহুল্য; কারণ, তিনি আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। আমাকে তিনি বেদমন্ত্র আবৃত্তি করিতে বলিলে আমি অল্প যেটুকু জানি সেই অনুসারে আবৃত্তি করিলাম। তখনি তিনি বলিলেন, এ তো যজুর্বেদের আবৃত্তির প্রণালী। বস্তুত আমি যজুর্বেদের মন্ত্রই আবৃত্তি করিয়াছিলাম। বেদগান হইতে আরম্ভ করিয়া ধ্রুপদ-খেয়ালের রাগমান- লয় তিনি তন্ন তন্ন করিয়া সন্ধান করিয়াছেন–তাঁহাকে সহজে ফাঁকি দিবার জো নাই। ইনি ভারতবর্ষীয় সংগীত সম্বন্ধে বই লিখিতেছেন।
শ্রীমতী মড্ মেকার্থির লেখা মডার্ন-রিভিয়ু পত্রিকায় মাঝে মাঝে বাহির হইয়াছে। শিশুকাল হইতেই সংগীতে ইঁহার অসামান্য প্রতিভা। নয় বৎসর বয়স হইতেই ইনি প্রকাশ্য সভায় বেহালা বাজাইয়া শ্রোতাদিগকে বিস্মিত করিয়াছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ইঁহার হাতে স্নায়ুঘটিত পীড়া হাওয়াতে ইঁহার বাজনা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। ইনি ভারতবর্ষে থাকিয়া কিছুকাল বিশেষভাবে দক্ষিণ ভারতের সংগীত আলোচনা করিয়াছেন ; ইনিও সে সম্বন্ধে বই লিখিতে প্রবৃত্ত আছেন।