চ্যাল্ফোর্ড্ ৩১ শ্রাবণ, ১৩১৯
সংগীত
আমরা গ্রীষ্ম-ঋতুর অবসানের দিকে এ দেশে আসিয়া পৌঁছিয়াছি, এখন এখানে সংগীতের আসর ভাঙিবর মুখে। কোনো বড়ো ওস্তাদের গান বা বাজনার বৈঠক এখন আর নাই। এখানকার নিকুঞ্জে গ্রীষ্মকালে পাখিরা নানা সমুদ্র পার হইয়া আসে, আবার তাহারা সভা ভঙ্গ করিয়া চলিয়া যায়। মানুষের সংগীতও এখানে সকল ঋতুতে বাজে না; তাহার বিশেষ কাল আছে,সেই সময়ে পৃথিবীর নানা ওস্তাদ নানা দিক হইতে আসিয়া এখান সংগীতসরস্বতীর পূজা করিয়া থাকে।
আমাদের দেশেও একদিন এইরূপ গীতবাদ্যের পরব ছিল। পূজাপার্বণের সময় বড়ো বড়ো ধনীদের বাড়িতে নানা দেশের গুণীরা আসিয়া জুটিত। সেই-সকল সংগীতসভায় দেশের সাধারণ লোকের প্রবেশ অবারিত ছিল। তখন লক্ষ্মী সরস্বতী একত্র মিলিতেন এবং সংগীতের বসন্তসমীরণ সমস্ত দেশের হৃদয়ের উপর দিয়া প্রবাহিত হইত। সকল দেশেই একদিন বুনিয়াদি ধনীরাই দেশের শিল্প সহিত্য সংগীতকে আশ্রয় দিয়া রক্ষা করিয়াছে। য়ুরোপে এখন গণসাধারণ সেই বুনিয়াদি বংশের স্থান অধিকার করিয়াছে; আমাদের দেশে বারোয়ারি দ্বারা যেটা ঘটিয়া থাকে সেইটে য়ুরোপে সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছে। বারোয়ারিই এখানে ওস্তাদ আনাইয়া গান শোনে; বায়োয়ারির কৃপাতেই নিরন্ন কবির দৈন্য মোচন হয়, এবং চিত্রকর ছবি আঁকিয়া লক্ষ্মীর প্রসাদ লাভ করে। কিন্তু আমাদের দেশে বর্তমানকালে ধনীদের ধনের কোনো দায়িত্ব নাই; সে ধনের দ্বারা কেবল ল্যাজারাস অস্লার হ্যমিল্টন হার্মান এবং মাকিণ্টশ-বার্ন্ কোম্পানিরই মুনফা বৃদ্ধি হইয়া থাকে; এ দিকে গণসাধারণেরও না আছে শক্তি, না আছে রুচি। আমাদের দেশে কলাবধূকে লক্ষ্মীও ত্যাগ করিয়াছেন, গণেশের ঘরেও এখনও তাহার স্থান হয় নাই।
আমার ভাগ্যক্রমে এবারে আমি লণ্ডনে আসার কয়েক সপ্তাহ পরেই ক্রিস্টল-প্যালাসের গীতশালায় হ্যাণ্ডেল-উৎসবের আয়োজন হইয়াছিল। প্রসিদ্ধ সংগীতরচয়িতা হ্যাণ্ডেল জর্মান ছিলেন, কিন্তু ইংলণ্ডেই তিনি অধিকাংশ জীবন যাপন করিয়াছিলেন। বাইবেলের কোনো কোনো অংশ ইনি সুরে বসাইয়াছিলেন,সেগুলি এ দেশে বিশেষ আদর পাইয়াছে। এই গীতগুলিই বহুশত যন্ত্রযোগে বহুশত কণ্ঠে মিলিয়া হ্যাণ্ডেলউৎসবে গাওয়া হইয়া থাকে। চারি হাজার যন্ত্রী ও গায়কে মিলিয়া এবারকার উৎসব সম্পন্ন হইয়াছিল।
এই উৎসবে আমি উপস্থিত ছিলাম। বিরাট সভাগৃহের গ্যালারিতে স্তরে স্তরে গায়ক ও বাদক বসিয়া গিয়াছে। এত বৃহৎ ব্যাপার যে দুর্বিনের সাহায্য ব্যতীত স্পষ্ট করিয়া কাহাকে দেখা যায় না, মনে হয় যেন পুঞ্জ পুঞ্জ মানুষের মেঘ করিয়াছে। স্ত্রী ও পুরুষ গায়কেরা উদারা মুদারা ও তারা সুরের কণ্ঠ অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীতে বসিয়াছে। একই রঙের একই রকমের কাপড়; সবসুদ্ধ মনে হয়, প্রকাণ্ড একটা পটের উপর কে যেন লাইনে লাইনে পশমের বুনানি করিয়া গিয়াছে।
চার হাজার কণ্ঠে ও যন্ত্রে সংগীত জাগিয়া উঠিল। ইহার মধ্যে একটি সুর পথ ভুলিল না। চার হাজার সুরের ধারা নৃত্য করিতে করিতে একসঙ্গে বাহির হইল, তাহারা কেহ কাহাকেও আঘাত করিল না। অথচ সমতান নহে, বিচিত্র তানের বিপুল সম্মিলন। এই বহুবিচিত্রকে এমনতরো অনিন্দনীয় সুসম্পূর্ণতায় এক করিয়া তুলিবার মধ্যে যে বৃহৎ শক্তি আছে, আমি তাহাই অনুভব করিয়া বিস্মিত হইয়া গেলাম। এত বড়ো বৃহৎ ক্ষেত্রে অন্তরে বাহিরে এই জাগ্রত শক্তির কোথাও কিছুমাত্র ঔদাস্য নাই, জড়ত্ব নাই। আসন বসন হইতে আরম্ভ করিয়া গীতকলায় পারিপাট্য পর্যন্ত সর্বত্র তাহার অমোঘ বিধান প্রত্যেক অংশটিকে সমগ্রের সঙ্গে মিলাইয়া নিয়ন্ত্রিত করিতেছে।
মাঝে মাঝে ছাপানো প্রোগ্রাম খুলিয়া গানের কথার সঙ্গে সুরকে মিলাইয়া দেখিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। কিন্তু, মিল যে দেখিতে পাইয়াছিলাম তহা বলিতে পারি না। এত বড়ো একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার গড়িয়া তুলিলে সেটা যে একটা যন্ত্রের জিনিস হইয়া উঠিবে তাহাতে সন্দেহ নাই। বাহিরের আয়তন বৃহৎ বিচিত্র ও নির্দোষ হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু ভাবের রসটি চাপা পড়িয়াছে। আমার মনে হইল, বৃহৎ ব্যূহবদ্ধ সৈন্যদল যেমন করিয়া চলে এই সংগীতের গতি সেইরূপ; ইহাতে শক্তি আছে ,কিন্তু লীলা নাই।
কিন্তু, তাই বলিয়া সমস্ত য়ুরোপীয় সংগীত পদার্থটাই যে এই শ্রেণীর তাহা বলিলে সত্য বলা হইবে না। অর্থাৎ, য়ুরোপীয় সংগীতে আকারের নৈপুণ্যই প্রধান, ভাবের রস প্রধান নহে, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য হইতে পারে না। কারণ, ইহা প্রত্যক্ষ দেখা যাইতেছে, সংগীতের রসসুধায় য়ুরোপকে কিরূপ মাতাইয়া তোলে। ফুলের প্রতি মৌমাছির আগ্রহ দেখিলেই বুঝা যাইবে ফুলে মধু আছে, সে মধু আমার গোচর না হইতেও পারে।
য়ুরোপের সঙ্গে আমাদের দেশের সংগীতের একজায়গায় মূলতঃ প্রভেদ আছে, সে কথা সত্য। হার্মনি বা স্বরসংগতি য়ুরোপীয় সংগীতের প্রধান বস্তু আর রাগরাগিণীই আমাদের সংগীতের মুখ্য অবলম্বন। য়ুরোপ বিচিত্রের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াছে, আমরা একের দিকে। বিশ্বসংগীতে আমরা দেখিতেছি বিচিত্রের তান সহস্রধারায় উচ্ছ্বসিত হইতেছে, একটি আর-একটির প্রতিধ্বনি নহে, প্রত্যেকেরই নিজের বিশেষত্ব আছে, অথচ সমস্তই এক হইয়া আকাশকে পূর্ণ করিয়া তুলিতেছে। হার্মনি, জগতের সেই বহুরূপের বিরাট নৃত্যলীলাকে সুর দিয়া দেখাইতেছে। কিন্তু, নিশ্চয়ই মাঝখানে একটি এক-রাগিণীর গান চলিতেছে; সেই গানের তানলয়টিকেই ঘিরিয়া ঘিরিয়া নৃত্য আপনার বিচিত্র গতিকে সার্থক করিয়া তুলিতেছে । আমাদের দেশের সংগীত সেই মাঝখানের গানটিকে ধরিবার চেষ্টা করিতেছে। সেই গভীর, গোপন, সেই এক– যাহাকে ধ্যানে পাওয়া যায়, যাহা আকাশে স্তব্ধ হইয়া আছে। চিরধাবমান বিচিত্রের সঙ্গে যোগ দিয়া তাল রাখিয়া চলা, ইহাই য়ুরোপীয় প্রকৃতি; আর চিরনিস্তব্ধ একের দিকে কান পাতিয়া, মন রাখিয়া, আপনাকে শান্ত করা, ইহাই আমাদের স্বভাব।