সেই পর্দাটাই আছে আর তিনি নাই, এমন অকটা অদ্ভুত অশ্রদ্ধা লইয়া যদি সেখানে যাই তবে এই পথ-খরচাটার মতো এতবড়ো অপব্যয় আর কিছুই হইতে পারে না।
য়ুরোপীয় সভ্যতা বস্তুগত, তাহার মধ্যে আধ্যাত্মিকতা নাই, এখন একটা বুলি চারি দিকে প্রচলিত হইয়াছে। যে কারণেরই হউক এইরূপ জনশ্রুতি যখন প্রচার লাভ করিতে আরম্ভ করে, তখন তাহার আর সত্য হওয়ার প্রয়োজন থাকে না। পাঁচজনে যাহা বলে ষষ্ঠ ব্যক্তির তাহা উচ্চারণ করিতে বাধে না এবং নানা কণ্ঠের আবৃত্তিই তখন যুক্তির স্থান গ্রহণ করিয়া বসে।
এ কথা গোড়াতেই মনে রাখা দরকার, মানবসমাজে যেখানেই আমরা যে-কোনো মঙ্গল দেখি-না কেন, তাহার গোড়াতেই আধ্যাত্মিক শক্তি আছে। অর্থাৎ মানুষ কখনোই সত্যকে কল দিয়া পাইতে পারে না, তাহাকে আত্মা দিয়াই লাভ করিতে হয়। যুরোপে যদি আমরা মানুষের কোনো উন্নতি দেখি তবে নিশ্চয়ই জানিতে হইবে, সে উন্নতির মূলে মানুষের আত্মা আছে– কখনোই তাহা জড়ের সৃষ্টি নহে। বাহিরের বিকাশে আত্মারই শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়।
য়ুরোপে মানুষ মানবাত্মাকে প্রকাশ করিতেছে না, কেবল জড়বস্তুকেই স্তূপাকার করিতেছে, এ কথাও যা আর যদি বলি “বনস্পতি কেবল শুকনো পাতা ঝরাইয়া মাটি ছাইয়া ফেলে, সে আপনার জীবনকে প্রকাশ করে না’– তবে সেও তেমনি। বস্তুত, বনস্পতির প্রবল প্রাণশক্তিই প্রচুর পল্লব বর্ষণ করে, অবিশ্রাম পরিত্যক্ত মৃত পত্রে তাহার মৃত্যু প্রমাণ করে না। জীবনই প্রতি মুহূর্তে মরিতে পারে–মৃত্যু যখন বন্ধ হইয়া যায় তখনই যথার্থ মৃত্যু।
য়ুরোপে দেখিতেছি, মানুষ নবনব পরীক্ষা ও নবনব পরিবর্তনের পথে চলিতেছে–আজ যাহাকে গ্রহণ করিতেছে কাল তাহাকে সে ত্যাগ করিতেছে। সে কোথাও চুপ করিয়া থাকিতেছে না। অনেকে বলিয়া থাকেন, ইহাতেই তাহার আধ্যাত্মিকতার অভাব প্রমাণ করে।
বিশ্বজগতেও আমরা কেবলই পরিবর্তন ও মৃত্যু দেখিতেছি। তবু কি এই বিশ্ব সম্বন্ধেই ঋষিরা বলেন নাই যে, আনন্দ হইতেই এই সমস্ত-কিছু উৎপন্ন হইতেছে। অমৃতই কি আপনাকে মৃত্যু-উৎসের ভিতর দিয়া নিরন্তর উৎসারিত করিতেছে না।
বাহিরকেই চরম করিয়া দেখিলে ভিতরকে দেখা হয় না এবং বাহিরকেও সত্যরূপে গ্রহণ করা অসম্ভব হয়। য়ুরোপেরও একটা ভিতর আছে, তাহারও একটা আত্মা আছে, এবং সে আত্মা দুর্বল নহে।
য়ুরোপের সেই আধ্যাত্মিকতাকে যখন দেখিব তখনই তাহার সত্যকে দেখিতে পাইব– তখনই এমন একটি পদার্থকে জানিতে পারিব যাহাকে আত্মার মধ্যে গ্রহণ করা যায়, যাহা কেবল বস্তু নহে, যাহা কেবল বিদ্যা নহে, যাহা আনন্দ।
যে কথাটা আমি বলিবার চেষ্টা করিতেছি তাহা সহজে বুঝিবার মতো একটা ঘটনা সম্প্রতি ঘটিয়াছে। দুই হাজার যাত্রী লইয়া আট্লান্টিক সমুদ্রে এক জাহাজ পাড়ি দিতেছিল; সেই জাহাজ অর্ধরাতে চলমান হিমশৈলে ঠেকিয়া যখন ডুবিবার উপক্রম করিল তখন অধিকাংশ য়ুরোপীয় ও আমেরিকান যাত্রী নিজের জীবন-রক্ষার প্রতি ব্যাকুলতা প্রকাশ না করিয়া স্ত্রীলোক ও বালকদিগকে উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিয়াছে। এই প্রকাণ্ড অপমৃত্যুর অভিঘাতে য়ুরোপের বাহিরের আবরণ সরিয়া যাওয়াতে আমরা এক মূহূর্তে তাহার অন্তরতর মানবাত্মার একটি সত্য মূর্তি দেখিতে পাইয়াছি।
যেমনি দেখিয়াছি অমনি তাহার কাছে মাথা প্রণত করিতে আমাদের আর লজ্জা হয় নাই। অমনি আত্মার পরিচয়ে আত্মার আনন্দ উদারভাবে প্রকাশ পাইয়াছে।
এই ঘটনার অনতিকালের মধ্যে আমাদের কয়েকজন বন্ধু ঢাকা হইতে স্টিমারে করিয়া ফিরিতেছিলেন। স্টিমারের আঘাতে পদ্মার মাঝখানে একটি নৌকা ডুবিয়া গেল, তাহার তিনজন আরোহী জলের মধ্যে পড়িল। অনতিদূরে পাশ দিয়া আর-একখানা নৌকা চলিয়া যাইতেছিল–জাহাজের সকল লোকে মিলিয়া চীৎকার করিয়া উদ্ধারের জন্য তাহারা মাঝিকে বিস্তর ডাকাডাকি করিল, সে কর্ণপাত মাত্র না করিয়া চলিয়া গেল; বিপদের কোনো আশঙ্কা ছিল না, নিকটেও সে ছিল, কাজটাকে কোনোমতেই দুঃসাধ্য বলা চলে না।
আমার আর-একদিনের কথা মনে পড়িল। রাত্রে কেবল ঝড় হইয়া গিয়াছে। সকালবেলা বাতাসের বেগ কমিয়া গিয়াছে, কিন্তু নদী চঞ্চল। গোরাই নদীর তীরে আমার বোট বাঁধা; হঠাৎ মনে হইল, নদীর মাঝখান দিয়া স্ত্রীলোকের দেহ ভাসিয়া চলিয়াছে, জলের উপরে চুল এলাইয়া পড়িয়াছে, আর কিছুই দেখা যায় না। ঘাটের কাছে যাহারা ছিল আমি সকলকেই ডাকিয়া বলিলাম, “আমার ছোটো লাইফ-বোটটি বাহিয়া উহাকে উদ্ধার করিয়া আনো, কী জানি হয়তো বাঁচিয়া আছে।’ কেহই অগ্রসর হইল না। আমি বলিলাম, “যে-কেহ যাইবে প্রত্যেককে আমি পাঁচ টাকা পুরস্কার দিব।’ তখন কয়েকজন লোক নৌকা ভাসাইয়া দিয়া তাহাকে তুলিয়া আনিল, এবং মূর্ছিত স্ত্রীলোকটি ক্রমশ চেতনা লাভ করিল। পুরস্কারের আশা না থাকিলে কেহই যাইত না।
আর-একদিন আমি বোটে করিয়া বড়ো বিল দিয়া আসিতেছিলাম। বিলের জল যেখানে নদীতে আসিয়া পড়ে সেকানে মাছ ধরিবার সুবিধা করিবার জন্য জেলেরা বড়ো বড়ো খোঁটা পুঁতিয়া জলের নির্গমনপথকে সংকীর্ণ করিয়া দেয়, তাহাতে জলধারার বেগ অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠে; এইরূপ স্থানে অনেক বোঝাই নৌকাকে বিপন্ন হইতে দেখিয়াছি। এই সংকীর্ণ পথ পার হইবার কালে আমার বোট কোনোমতে খোঁটার আঘাত বাঁচাইতে গিয়া ভারি একটি সংকটের জায়গায় আটকাইয়া পড়িল। আট-দশ হাত দূরেই জেলেরা মাছ ধরিতেছিল। আমাদের সাহায্য করিবার জন্য তাহাদিগকে ডাকাডাকি করা গেল, তাহারা তাকাইয়াও দেখিল না। বোটের মাঝি পুরস্কার কবুল করিল। তাহারা ডাক বাড়াইবার প্রত্যাশায় বধিরতার ভাণ করিল। ডাক বাড়িয়া যখন বেশ একটা মোটা অঙ্কে উঠিয়াছে তখন জেলেদের শ্রবণশক্তির বাধা হঠাৎ সম্পূর্ণ দূর হইয়া গেল। অথচ তাহাদেরই কৃতকর্মের ফল আমরা ভোগ করিতে বসিয়াছিলাম আমাদের দেশের কোনো পাঠককে এ কথা বলা বাহুল্য, যদি হাকিমের বোট হইত তাহা হইলে ইহাদের শ্রুতিশক্তির পরীক্ষায় অন্যরূপ ফল দেখা যাইত।