আধুনিক পাশ্চাত্য সাহিত্যে গদ্যে কাব্য রচনা করেছেন ওয়াল্ট্ হুইট্ম্যান। সাধারণ গদ্যের সঙ্গে তার প্রভেদ নেই, তবু ভাবের দিক থেকে তাকে কাব্য না বলে থাকবার জো নেই। এইখানে একটা তর্জমা করে দিই।
লুইসিয়ানাতে দেখলুম একটি তাজা ওক্ গাছ বেড়ে উঠছে; একলা সে দাঁড়িয়ে, তার ডালগুলো থেকে শ্যাওলা পড়ছে ঝুলে। কোনো দোসর নেই তার, ঘন সবুজ পাতায় কথা কইছে তার খুশিটি। তার কড়া খাড়া তেজালো চেহারা মনে করিয়ে দিলে আমারই নিজেকে। আশ্চর্য লাগল, কেমন করে এ গাছ ব্যক্ত করছে খুশিতে ভরা আপন পাতাগুলিকে যখন না আছে ওর বন্ধু না আছে দোসর। আমি বেশ জানি, আমি তো পারতুম না। গুটিকতক পাতাওয়ালা একটি ডাল তার ভেঙে নিলেম, তাতে জড়িয়ে দিলেম শ্যাওলা। নিয়ে এসে চোখের সামনে রেখে দিলেম আমার ঘরে; প্রিয় বন্ধুদের কথা স্মরণ করাবার জন্যে যে তা নয়। (সম্প্রতি ঐ বন্ধুদের ছাড়া আর কোনো কথা আমার মনে ছিল না।) ও রইল একটি অদ্ভুত চিহ্নের মতো, পুরুষের ভালোবাসা যে কী তাই মনে করাবে। তা যাই হোক, যদিও সেই তাজা ওক গাছ লুইসিয়ানার বিস্তীর্ণ মাঠে একলা ঝল্মল্ করছে, বিনা বন্ধু বিনা দোসরে খুশিতে ভরা পাতাগুলি প্রকাশ করছে চিরজীবন ধরে, তবু আমার মনে হয়, আমি তো পারতুম না।
এক দিকে দাঁড়িয়ে আছে কঠিন বলিষ্ঠ সতেজ ওক গাছ, একলা আপন আত্মসম্পূর্ণ নিঃসঙ্গতায় আনন্দময়; আর-এক দিকে একজন মানুষ, সেও কঠিন বলিষ্ঠ সতেজ, কিন্তু তার আনন্দ অপেক্ষা করছে প্রিয়সঙ্গের জন্যে– এটি কেবলমাত্র সংবাদরূপে গদ্যে বলবার বিষয় নয়। এর মধ্যে কবির আপন মনোভাবের একটি ইশারা আছে। একলা গাছের সঙ্গে তুলনায় একলা বিরহী-হৃদয়ের উৎকণ্ঠা আভাসে জানানো হল। এই প্রচ্ছন্ন আবেগের ব্যঞ্জনা, এই তো কাব্য; এর মধ্যে ভাববিন্যাসের শিল্প আছে, তাকেই বলব ভাবের ছন্দ।
চীন-কবিতার তরজমা থেকে একটি দৃষ্টান্ত দেখাই।
স্বপ্ন দেখলুম, যেন চড়েছি কোনো উঁচু ডাঙায়; সেখানে চোখে পড়ল গভীর এক ইঁদারা। চলতে চলতে কণ্ঠ আমার শুকিয়েছে; ইচ্ছে হল, জল খাই। ব্যগ্র দৃষ্টি নামতে চায় ঠাণ্ডা সেই কুয়োর তলার দিকে। ঘুরলেম চারদিকে, দেখলেম ভিতরে তাকিয়ে, জলে পড়ল আমার ছায়া। দেখি এক মাটির ঘড়া কালো সেই গহ্বরে; দড়ি নাই যে তাকে টেনে তুলি। ঘড়াটা পাছে তলিয়ে যায় এই ভেবে প্রাণ কেন এমন ব্যাকুল হল। পাগলের মতো ছুটলেম সহায় খুঁজতে। গ্রামে গ্রামে ঘুরি, লোক নেই একজনও, কুকুরগুলো ছুটে আসে টুঁটি কামড়ে ধরতে। কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এলেম কুয়োর ধারে। জল পড়ে দুই চোখ বেয়ে, দৃষ্টি হল অন্ধপ্রায়। শেষকালে জাগলেম নিজেরই কান্নার শব্দে। ঘর নিস্তব্ধ, স্তব্ধ সব বাড়ির লোক; বাতির শিখা নিবো-নিবো, তার থেকে সবুজ ধোঁয়া উঠছে, তার আলো পড়ছে আমার চোখের জলে। ঘণ্টা বাজল, রাতদুপুরের ঘণ্টা, বিছানায় উঠে বসলুম, ভাবতে লাগলুম অনেক কথা। মনে পড়ল, যে-ডাঙাটা দেখছি সে চাং-আনের কবরস্থান; তিনশো বিঘে পোড়ো জমি, ভারি মাটি তার, উঁচু-উঁচু সব ঢিবি; নিচে গভীর গর্তে মৃতদেহ শোওয়ানো। শুনেছি, মৃত মানুষ কখনো-কখনো দেখা দেয় সমাধির বাইরে। আজ আমার প্রিয় এসেছিল ইঁদারায় ডুবে-যাওয়া সেই ঘড়া, তাই দুচোখ বেয়ে জল পড়ে আমার কাপড় গেল ভিজে।
এতে পদ্যছন্দ নেই, এতে জমানো ভাবের ছন্দ। শব্দবিন্যাসে সুপ্রত্যক্ষ অলংকরণ নেই, তবুও আছে শিল্প।
উপসংহারে শেষকথা এই যে, কাব্যের অধিকার প্রশস্ত হতে চলেছে। গদ্যের সীমানার মধ্যে সে আপন বাসা বাঁধছে ভাবের ছন্দ দিয়ে। একদা কাব্যের পালা শুরু করেছি পদ্যে, তখন সে মহলে গদ্যের ডাক পড়ে নি। আজ পালা সাঙ্গ করবার বেলায় দেখি, কখন অসাক্ষাতে গদ্যে-পদ্যে রফানিষ্পত্তি চলছে। যাবার আগে তাদের রাজিনামায় আমিও একটা সই দিয়েছি। এককালের খাতিরে অন্যকালকে অস্বীকার করা যায় না।
বৈশাখ, ১৩৪১
চিঠিপত্র – ১ (জে, ডি, এণ্ডার্সন্কে লিখিত)
আপনি বলিয়াছেন, আমাদের উচ্চারণের ঝোঁকটা বাক্যের আরম্ভে পড়ে। ইহা আমি অনেক দিন পূর্বে লক্ষ্য করিয়াছি। ইংরেজিতে প্রত্যেক শব্দেরই একটি নিজস্ব ঝোঁক আছে। সেই বিচিত্র ঝোঁকগুলিকে নিপুণভাবে ব্যবহার করার দ্বারাই আপনাদের ছন্দ সংগীতে মুখরিত হইয়া উঠে। সংস্কৃত ভাষার ঝোঁক নাই কিন্তু দীর্ঘহ্রস্বস্বর ও যুক্তব্যঞ্জনবর্ণের মাত্রাবৈচিত্র্য আছে, তাহাতে সংস্কৃত ছন্দ ঢেউ খেলাইয়া উঠে। যথা–
অস্ত্যুত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা।
উক্ত বাক্যের যেখানে যেখানে যুক্তব্যঞ্জনবর্ণ বা দীর্ঘস্বর আছে সেখানেই ধ্বনি গিয়া বাধা পায়। সেই বাধার আঘাতে আঘাতে ছন্দ হিল্লোলিত হইয়া উঠে।
যে ভাষায় এইরূপ প্রত্যেক একটি বিশেষ বেগ আছে সে ভাষার মস্ত সুবিধা এই যে, প্রত্যেক শব্দটিই নিজেকে জানান দিয়া যায়, কেহই পাশ কাটাইয়া আমাদের মনোযোগ এড়াইয়া যাইতে পারে না। এইজন্য যখন বাক্য ( sentence) আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হয় তখন তাহার উচ্চনীচতার বৈচিত্র্যবশত একটা সুস্পষ্ট চেহারা দেখিতে পাওয়া যায়। বাংলা বাক্যের অসুবিধা এই যে, একটা ঝোঁকের টানে একসঙ্গে অনেকগুলো শব্দ অনায়াসে আমাদের কানের উপর দিয়া পিছলিয়া চলিয়া যায়। তাহাদের প্রত্যেকটার সঙ্গে সুস্পষ্ট পরিচয়ের সময় পাওয়া যায় না। ঠিক যেন আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের মতো। বাড়ির কর্তাটিকেই স্পষ্ট করিয়া অনুভব করা যায় কিন্তু তাঁহার পশ্চাতে তাঁহার কত পোষ্য আছে, তাহারা আছে কি নাই, তাহার হিসাব রাখিবার দরকার হয় না।