চক্ষুর পল্লবে নিবিড় কজ্জ্বল
গলিছে অশ্রুর নির্ঝরে।
কিন্তু, এই বোঝা পয়ারজাতীয় পালোয়ানের স্কন্ধে চাপালে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকবে না। প্রথমে বিনা-বোঝার চালটা দেখানো যাক–
শ্রাবণের কালো ছায়া নেমে আসে তমালের বনে
যেন দিক্-ললনার গলিত কাজল-বরিষনে।
এইটিকে গুরুভার করে দিই–
বর্ষার তমিস্রচ্ছায়া ব্যাপ্ত হল অরণ্যের তলে
যেন অশ্রুসিক্তচক্ষু দিগ্বধূর গলিত কজ্জলে।
এতটা ভারবৃদ্ধি যে সম্ভব হয় তার কারণ পয়ার স্থিতিস্থাপক।
ধ্বনির দুইমাত্রা এবং তিনমাত্রা বাংলা ছন্দের আদিম এবং রূঢ়িক উপাদান। তারপরে এই দুই এবং তিনের যোগে যৌগিকমাত্রার ছন্দের উৎপত্তি। তিন + দুই, তিন + চার, তিন + দুই + চার প্রভৃতি নানাপ্রকার যোগ চলেছে আধুনিক বাংলা ছন্দে। তিন +দুই-মাত্রামূলক ছন্দের দৃষ্টান্ত–
আঁধার রাতি জ্বেলেছে বাতি
অযুতকোটি তারা,
আপন কারা-ভবনে পাছে
আপনি হয় হারা।
দেখা যাচ্ছে, এখানে পদশেষের অংশটিকে খর্ব করা হয়েছে। যদি লেখা যেত–
আঁধার রাতি জ্বেলেছে বাতি
আকাশ ভরি অযুত তারা
তাহলে ছন্দের কাছে দেনা বাকি থাকত না। কিন্তু, পূর্বোক্ত প্রথম শ্লোকটির পদশেষে পাঁচমাত্রার থেকে তিনমাত্রাকে জবাব দেওয়া হয়েছে। তাহলে বুঝতে হবে, সেই তিনমাত্রা দেহত্যাগ করে ঐখানেই বসে আছে যতিকে ভর করে।
কিন্তু, এই কৈফিয়তটা সম্পূর্ণ হল বলে মনে হয় না, আরও কথা আছে। প্রকৃতির কাজের অলংকরণতত্ত্বটা আলোচ্য। দুই পা দুই হাত নিয়ে দেহটা দাঁড়ালো, দুই কাঁধে দুটো মুণ্ড বসালেই সম্মিতি অর্থাৎ ড়ঁললনঢ়ক্ষঁ ঘটত। তা না করে দুই কাঁধের মাঝখানে একটি মুণ্ড বসিয়ে সমাপ্তিটা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। কৃষ্ণচূড়ার গাছে ডাঁটার দু ধারে দুটি করে পত্রগুচ্ছ চলতে চলতে প্রান্তে এসে থামল একটিমাত্র গুচ্ছে। অলংকরণের ধারা যেখানে পূর্ণ হয়েছে সেখানে একটিমাত্র তর্জনী, ছোটো একটি ইশারা।
সকল ভাষারই যতি আছে, কিন্তু যতিকে বাটখারাস্বরূপ করে ছন্দের ওজন পূরণ বাংলা ছন্দ ছাড়া আর কোনো ছন্দে আছে কি না জানি নে। সংস্কৃত ছন্দে এই রীতি বিরল, তবু একেবারে পাওয়া যায় না তা নয়।
বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদী
হরতি দরতিমিরমতি ঘোরম্ ০ ০।
যতিকে কেবল বিরতির স্থান না দিয়ে তাকে পূর্তির কাজে লাগাবার অভ্যাস আরম্ভ হয়েছে আমাদের ছড়ার ছন্দ থেকে। ছড়া আবৃত্তি করবার সময় আপনি যতির জোগান দেয় আমাদের কান।
কাক কালো বটে, পিক সেও কালো,
কালো সে ফিঙের বেশ,
তাহার অধিক কালো যে, কন্যা,
তোমার চিকন কেশ।
এমন করে ছন্দটাকে পুরোপুরি ভরিয়ে দিলে কানের কাছে ঋণী হতে হত না। কিন্তু, এতে ছড়ার জাত যেত। ছড়ার রীতি এই যে, সে কিছু ধ্বনি জোগায় নিজে, কিছু আদায় করে কণ্ঠের কাছ থেকে; এ দুয়ের মিলনে সে হয় পূর্ণ। প্রকৃতি আমের মধুরতায় জল মিশিয়েছেন, তাকে আমসত্ত্ব করে তোলেন নি; সেজন্যে রসজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই কৃতজ্ঞ। তেমনি যথেষ্ট যতি মিশোল করা হয়েছে ছড়ার ছন্দে, শিশুকাল থেকে বাঙালি তাতে আনন্দ পায়। সে সহজেই আউড়েছে–
কাক কালো, কোকিল কালো,
কালো ফিঙের বেশ,
তাহার অধিক কালো, কন্যে,
তোমার চিকন কেশ।
কিম্বা–
টুমুস টুমুস বাদ্যি বাজে,
লোকে বলে কী,
শামুকরাজা বিয়ে করে
ঝিনুকরাজার ঝি
১৩৪১
মোটকথা – ২ (দুই মাত্রা বা দুই মাত্রার গুণক নিয়ে)
গদ্যছন্দ
গদ্য বলতে বুঝি যে-ভাষা আলাপ করবার ভাষা; ছন্দোবদ্ধ পদে বিভক্ত যে ভাষা তাই পদ্য। আর, রসাত্মক বাক্যকেই আলংকারিক পণ্ডিত কাব্য সংজ্ঞা দিয়েছেন। এই রসাত্মক বাক্য পদ্যে বললে সেটা হবে পদ্যকাব্য আর গদ্যে বললে হবে গদ্যকাব্য। গদ্যেও অকাব্য ও কুকাব্য হতে পারে, পদ্যেও তথৈবচ। গদ্যে তার সম্ভাবনা বেশি, কেননা ছন্দেরই একটা স্বকীয় রস আছে– সেই ছন্দকে ত্যাগ করে যে-কাব্য সুন্দরী বিধবার মতো তার অলংকার তার আপন বাণীদেহেই, বাইরে নয়। এ কথা বলা বাহুল্য যে, গদ্যকাব্যেও একটা আবাঁধা ছন্দ আছে। আন্তরিক প্রবর্তনা থেকে কাব্য সেই ছন্দ চলতে চলতে আপনি উদ্ভাবিত করে, তার ভাগগুলি অসম হয় কিন্তু সবসুদ্ধ জড়িয়ে ভারসামঞ্জস্য থেকে সে স্খলিত হয় না। বড়ো-ওজনের সংস্কৃত ছন্দে এই আপাতপ্রতীয়মান মুক্তগতি দেখতে পাওয়া যায়। যেমন–
মেঘৈ র্মেদুর । মম্বরং বনভুবঃ । শ্যামস্তমা । লদ্রুমৈঃ।
এই ছন্দ সমান ভাগ মানে না, কিন্তু সমগ্রের ওজন মেনে চলে। মুখের কথায় আমরা যখন খবর দিই তখন সেটাতে নিশ্বাসের বেগে ঢেউ খেলায় না। যেমন–
তার চেহারাটা মন্দ নয়।
কিন্তু ভাবের আবেগ লাগবামাত্র আপনি ঝোঁক এসে পড়ে। যেমন–
কী সুন্দর তার চেহারাটি।
একে ভাগ করলে এই দাঁড়ায় —
কী সুন্ । দর তার । চেহারাটি।
মরে যাই তোমার বালাই নিয়ে।
এত গুমর সইবে না গো, সইবে না– এই বলে দিলুম।
কথা কয় নি তো কয়নি
চলে গেছে সামনে দিয়ে,
বুক ফেটে মরব না তাই বলে।
এ-সমস্তই প্রতিদিনের চলতি কথার সহজ ছন্দ, গদ্যকাব্যের গতিবেগে আত্মরচিত। মনকে খবর দেবার সময় এর দরকার হয় না, ধাক্কা দেবার সময়ে আপনি দেখা দেয়, ছান্দসিকের দাগ-কাটা মাপকাঠির অপেক্ষা রাখে না।
১৩৪১
সংগীত ও ছন্দ
অনেকদিন হইতেই কবিতা লিখিতেছি, এইজন্য যতই বিনয় করি না কেন এটুকু না বলিয়া পারি না যে, ছন্দের তত্ত্ব কিছু কিছু বুঝি। সেই ছন্দের বোধ লইয়া যখন গান লিখিতে বসিলাম, তখন চাঁদ সদাগরের উপর মনসার যে-রকম আক্রোশ, আমার রচনার উপর তালের ওস্তাদি দেবতা তেমনি ফোঁস করিয়া উঠিলেন। আমার জানা ছিল, ছন্দের মধ্যে যে-নিয়ম আছে তাহা বিধাতার গড়া নিয়ম, তা কামারের গড়া নিগড় নয়। সুতরাং, তাঁর সংযমে সংকীর্ণ করে না, তাহাতে বৈচিত্র্যকে উদঘাটিত করিতে থাকে। সেই কথা মনে রাখিয়া বাংলা কাব্যে ছন্দকে বিচিত্র করিতে সংকোচ বোধ করি নাই।