বলা বাহুল্য, এক মাত্রা চলে না। বৃক্ষ ইব স্তব্ধো দিবি তিষ্ঠত্যেকঃ। যেই দুইয়ের সমাগম অমনি হল চলা শুরু; থাম আছে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থেমে। জন্তুর পা, পাখির পাখা,মাছের পাখনা দুই সংখ্যার যোগে চলে। সেই নিয়মিত গতির যদি আর-একটা একের অতিরিক্ত ভার চাপানো যায় তবে সেই গতিতে ভারসাম্যের অপ্রতিষ্ঠতা প্রকাশ পায়। এই অনিয়মের ঠেলায় নিয়মিত গতির বেগ বিচিত্র হয়ে ওঠে। মানুষের দেহটা তার দৃষ্টান্ত। আদিমকালের চারপেয়ে মানুষ আধুনিক কালে দুই পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তার কোমর থেকে পদতল পর্যন্ত দুই পায়ের সাহায্যে মজবুত, কোমর থেকে মাথা পর্যন্ত টলমলে। এই দুই ভাগের অসামঞ্জস্যকে সামলাবার জন্যে মানুষের গতিতে মাথা হাত কোমর পা বিচিত্র হিল্লোলে হিল্লোলিত। পাখিও দুই পায়ে চলে কিন্তু তার দেহ স্বভাবতই দুই পায়ের ছন্দে নিয়মিত, টলবার ভয় নেই তার। দুই মাত্রায় অর্থাৎ জোড় মাত্রায় যে-পদ বাঁধা হয়ে তার মধ্যে দাঁড়ানোও আছে, চলাও আছে; বেজোড় মাত্রায় চলার ঝোঁকটাই প্রধান। এইজন্যে অমিত্রাক্ষরে যেখানে-সেখানে থেমে যাবার যে নিয়ম আছে সেটা পালন করা বিষম মাত্রার ছন্দের পক্ষে দুঃসাধ্য। এইজন্যে বেজোড় মাত্রায় পদ্যধর্মই একান্ত প্রবল। চেষ্টা করে দেখা যাক বেজোড়মাত্রার দরজাটা খুলে দিয়ে। প্রথম পরীক্ষা হোক তিন মাত্রার মহলে।
বিরহী গগন ধরণীর কাছে পাঠালো লিপিকা। দিকের প্রান্তে নামে তাই মেঘ, বহিয়া সজল বেদনা, বহিয়া তড়িৎ-চকিত ব্যাকুল আকূতি। উৎসুক ধরা ধৈর্য হারায়, পারে না লুকাতে বুকের কাঁপন পল্লবদলে। বকুলকুঞ্জে রচে সে প্রাণের মুগ্ধ প্রলাপ; উল্লাস ভাসে চামেলিগন্ধে পূর্বগগনে।
পয়ার ছন্দের মতো এর গতি সিধে নয়। এই তিন মাত্রার এবং জোড়-বিজোড় মাত্রার ছন্দে পদক্ষেপ মাঘনৈষধের নায়িকাদের মতো মরালগমনে, ডাইনে-বাঁয়ে ঝোঁকে-ঝোঁকে হেলতে-দুলতে।
এবার যে-ছন্দের নমুনা দেব সেটা তিন-দুই মাত্রার, গানের ভাষায় ঝাঁপতাল-জাতীয়।
চিত্ত আজি দুঃখদোলে আন্দোলিত। দূরের সুর বক্ষে লাগে। অঙ্গনের সম্মুখেতে পান্থ মম ক্লান্তপদে গিয়েছে চলি দিগন্তরে। বিরহবেণু ধ্বনিছে তাই মন্দবায়ে। ছন্দে তারি কুন্দফুল ঝরিছে কত, চঞ্চলিয়া কাঁপিছে কাশগুচ্ছশিখা।
এ ছন্দ পাঁচ মাত্রার মাঝখানে ভাগ করে থামতে পারে না; এর যতিস্থাপনায় বৈচিত্র্যের যথেষ্ট স্বাধীনতা নেই।
এবার দেখানো যাক তিন-চার মাত্রার ছন্দ।–
মালতী সারাবেলা ঝরিছে রহি রহি কেন যে বুঝি না তো। হায় রে উদাসিনী, পথের ধূলিরে কি করিলি অকারণে মরণসহচরী। অরুণ গগনের ছিলি তো সোহাগিনী। শ্রাবণবরিষনে মুখর বনভূমি তোমারি গন্ধের গর্ব প্রচারিছে সিক্ত সমীরণে দিশে দিশান্তরে। কী অনাদরে তবে গোপনে বিকশিয়া বাদল-রজনীতে প্রভাত-আলোকেরে কহিলি "নহে নহে'।
উপরের দৃষ্টান্তগুলি থেকে দেখা যায়, অসম ও বিষম মাত্রার ছন্দে পঙ্ক্তিলঙ্ঘন চলে বটে, কিন্তু তার এক-একটি ধ্বনিগুচ্ছ সমান মাপের, তাতে ছোটো-বড়ো ভাগের বৈচিত্র্য নেই। এইজন্যেই একমাত্র পয়ারছন্দই অমিত্রাক্ষর রীতিতে কতকটা গদ্যজাতীয় স্বাধীনতা পেয়েছে।
এইবার আমার শ্রোতাদের মনে করিয়ে দেবার সময় এল যে, এই-সব পঙ্ক্তিলঙ্ঘক ছন্দের কথাটা উঠেছে প্রসঙ্গক্রমে। মূলকথাটা এই যে, কবিতায় ক্রমে-ক্রমে ভাষাগত ছন্দের আঁটা-আঁটির সমান্তরে ভাবগত ছন্দ উদ্ভাবিত হচ্ছে। পূর্বেই বলেছি, তার প্রধান কারণ, কবিতা এখন কেবলমাত্র শ্রাব্য নয়, তা প্রধানত পাঠ্য। যে সুবিনিড় সুনিয়মিত ছন্দ আমাদের স্মৃতির সহায়তা করে তার অত্যাবশ্যকতা এখন আর নেই। একদিন খনার বচনে চাষবাসের পরামর্শ লেখা হয়েছিল ছন্দে। আজকালকার বাংলায় যে “কৃষ্টি’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে খনার এই-সমস্ত কৃষির ছড়ায় তাকে নিশ্চিত এগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু, এই ধরনের কৃষ্টি প্রচারের ভার আজকাল গদ্য নিয়েছে। ছাপার অক্ষর তার বাহন, এইজন্যে ছন্দের পুঁটুলিতে ঐ বচনগুলো মাথায় করে বয়ে বেড়াবার দরকার হয় না। একদিন পুরুষও আপিসে যেত পাল্কিতে, মেয়েও সেই উপায়েই যেত শ্বশুরবাড়িতে। এখন রেলগাড়ির প্রভাবে একত্রে একই রথে জায়গা পায়। আজকাল গদ্যের অপরিহার্য প্রভাবের দিনে ক্ষণে-ক্ষণে দেখা যাবে কাব্যও আপন গতিবিধির জন্যে বাঁধাছন্দের ময়ূরপংখিটাকে অত্যাবশ্যক বলে গণ্য করবে না। পূর্বেই বলেছি, অমিত্রাক্ষর ছন্দে সব-প্রথমে পাল্কির দরজা গেছে খুলে, তার ঘটাটোপ হয়েছে বর্জিত। তবুও পয়ার যখন পঙ্ক্তির বেড়া ডিঙিয়ে চলতে শুরু করেছিল তখনো সাবেকি চালের পরিশেষরূপে গণ্ডির চিহ্ন পূর্বনির্দিষ্ট স্থানে রয়ে গেছে। ঠিক যেন পুরোনো বাড়ির অন্দরমহল; তার দেয়ালগুলো সরানো হয় নি, কিন্তু আধুনিককালের মেয়েরা তাকে অস্বীকার করে অনায়াসে সদরে যাতায়াত করছে। অবশেষে হাল-আমলের তৈরি ইমারতে সেই দেয়ালগুলো ভাঙা শুরু হয়েছে। চোদ্দ অক্ষরের গণ্ডিভাঙা পয়ার একদিন “মানসী’র এক কবিতায় লিখেছিলুম, তার নাম নিষ্ফল-প্রয়াস। অবশেষে আরো অনেক বছর পরে বেড়াভাঙা পয়ার দেখা দিতে লাগল “বলাকা’য়, “পলাতকা’য়। এতে করে কাব্যছন্দ গদ্যের কতকটা কাছে এল বটে, তবু মেয়ে-কম্পার্ট্মেন্ট্ রয়ে গেল, পুরাতন ছন্দোরীতির বাঁধন খুলল না। এমন কি, সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষায় আর্যা প্রভৃতি ছন্দে ধ্বনিবিভাগ যতটা স্বাধীনতা পেয়েছে আধুনিক বাংলায় ততটা সাহসও প্রকাশ পায় নি। একটি প্রাকৃত ছন্দের শ্লোক উদ্ধৃত করি।
বরিস জল ভমই ঘণ গঅণ সিঅল পবণ মণহরণ কণঅ-পিঅরি ণচই বিজুরি ফুল্লিআ ণীবা। পত্থর-বিত্থর-হিঅলা পিঅলা [ নিঅলং] ণ আবেই॥
মাত্রা মিলিয়ে এই ছন্দ বাংলায় লেখা যাক।
বৃষ্টিধারা শ্রাবণে ঝরে গগনে, শীতল পবন বহে সঘনে, কনক-বিজুরি নাচে রে, অশনি গর্জন করে। নিষ্ঠুর-অন্তর মম প্রিয়তম নাই ঘরে।
বাঙালি পাঠকের কান একে রীতিমতো ছন্দ বলে মানতে বাধা পাবে তাতে সন্দেহ নেই, কারণ এর পদবিভাগ প্রায় গদ্যের মতোই অসমান। যাই হোক, এর মধ্যে একটা ছন্দের কাঠামো আছে; সেটুকু ও যদি ভেঙে দেওয়া যায় তাহলে কাব্যকেই কি ভেঙে দেওয়া হল। দেখা যাক।
অবিরল ঝরছে শ্রাবণের ধারা, বনে বনে সজল হাওয়া বয়ে চলেছে, সোনার বরন ঝলক দিয়ে নেচে উঠছে বিদ্যুৎ, বজ্র উঠছে গর্জন করে। নিষ্ঠুর-অন্তর আমার প্রিয়তম ঘরে এল না।
একে বলতে হবে কাব্য, বুদ্ধির সঙ্গে এর বোঝাপড়া নয়, একে অনুভব করতে হয় রসবোধে। সেইজন্যেই যতই সামান্য হোক, এর মধ্যে বাক্যসংস্থানের একটা শিল্পকলা শব্দব্যবহারের একটা “তেরছ চাহনি’ রাখতে হয়েছে। সুবিহিত গৃহিণীপনার মধ্যে লোকে দেখতে পায় লক্ষ্মীশ্রী, বহু উপকরণে বহু অলংকারে তার প্রকাশ নয়। ভাষার কক্ষেও অনতিভূষিত গৃহস্থালি গদ্য হলেও তাকে সম্পূর্ণ গদ্য বলা চলবে না, যেমন চলবে না আপিসঘরের অসজ্জাকে অন্তঃপুরের সরল শোভনতার সঙ্গে তুলনা করা। আপিসঘরে ছন্দটা প্রত্যক্ষই বর্জিত, অন্যত্র ছন্দটা নিগূঢ় মর্মগত, বাহ্য ভাষায় নয়, অন্তরের ভাবে।