প্রাকৃত-বাংলার ধ্বনির বিশেষত্ববশত দেখতে পাই, তার ছন্দ তিন মাত্রার দিকেই বেশি ঝুঁকেছে। অর্থাৎ, তার তালটা স্বভাবতই একতালাজাতীয়, কাওয়ালিজাতীয় নয়। সংস্কৃত ভাষায় এই “তাল’ শব্দটা দুই সিলেব্ল্এর; বাংলায় “ল’ আপন অন্তিম অকার খসিয়ে ফেলেছে, তার জায়গায় টি বা টা যোগ করে শব্দটাকে পুষ্ট করবার দিকে তার ঝোঁক। টি টা-এর ব্যবধান যদি না থাকে তবে ঐ নিঃস্বর ধ্বনিটি প্রতিবেশী যে-কোনো ব্যঞ্জন বা স্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পূর্ণতা পেতে চায়।
রূপসাগরের তলে ডুব দিনু আমি
এটা সংস্কৃত-বাংলার ছাঁদে লেখা। এখানে শব্দগুলো পরস্পর গা-ঘেঁষা নয়। বাংলা প্রাকৃতের অনিবার্য নিয়মে এই পদের যে শব্দগুলি হসন্ত, তারা আপনারই স্বরধ্বনিকে প্রসারিত করে ফাঁক ভরতি করে নিয়েছে। “রূপ’ এবং “ডুব’ আপন উকারধ্বনিকে টেনে বাড়িয়ে দিলে। “সাগরের’ শব্দ আপন একারকে পরবর্তী হসন্ত র-এর পঙ্গুতাচাপা দিতে লাগিয়েছে। এই উপায়ে ঐ পদটার প্রত্যেক শব্দ নিজের মধ্যেই নিজের মর্যাদা বাঁচিয়ে চলেছে। অর্থাৎ এ ছন্দে ডিমক্রেসির প্রভাব নেই। এই-রকমের ছন্দে দুই মাত্রার ধ্বনি আপন পদক্ষেপের প্রত্যেক পর্যায়ে যে অবকাশ পায় তা নিয়ে তার গৌরব। বস্তুত, এই অবকাশের সুযোগ গ্রহণ করে তার ধ্বনিসমারোহ বাড়িয়ে তুললে এ ছন্দের সার্থকতা। যথা–
চৈতন্য নিমগ্ন হল রূপসিন্ধুতলে।
প্রাকৃত-বাংলা দেখা যাক।
রূপসাগরে ডুব দিয়েছি
অরূপ রতন আশা ক’রে
এখানে “রূপ’ আপন হসন্ত “প’এর ঝোঁকে “সাগরে’র “সা’টাকে টেনে আপন করে নিয়েছে, মাঝে ব্যবধান থাকতে দেয় নি। “রূপ-সা’ তাই আপনিই তিনমাত্রা হয়ে গেল। “সাগরে’র বাকি টুকরো রইল “গরে’। সে আপন ওজন বাঁচাবার জন্যে “রে’টাকে দিলে লম্বা করে, তিন মাত্রা পুরল। “ডুব’ আপনার হসন্তর টানে “দিয়েছি’র “দি’টাকে করলে আত্মসাৎ। এমনি করে আগাগোড়া তিন মাত্রা জমে উঠল। হসন্ত-প্রধান ভাষা সহজেই তিন মাত্রার দানা পাকায়, এটা দেখেছি। এমন কি যেখানে হসন্তের ভিড় নেই সেখানেও তার ঐ একই চাল। এটা যেন তার অভ্যস্ত হয়ে মজ্জাগত হয়ে গেছে। যেমন–
অচে- । তনে- । ছিলেম । ভালো-।
আমায় । চেতন । করলি । কেনে-।
প্রাকৃত-বাংলার এই তিন মাত্রার ভঙ্গি চণ্ডীদাস জ্ঞানদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিরা সাধুভাষাতেও গ্রহণ করেছেন। যেমন–
হাসিয়া হাসিয়া মুখ নিরখিয়া
মধুর কথাটি কয়।
ছায়ার সহিতে ছায়া মিশাইতে
পথের নিকটে রয়।
কিন্তু প্রাকৃত-বাংলার ক্রিয়াপদ নিয়ে একটু ভাববার বিষয় আছে।
মত্তরোষে বীরভদ্র ছুট্ল ঊর্ধ্বশ্বাসে,
ঘূর্ণিবেগে উড়্ল ধুলো রক্ত সন্ধ্যাকাশে।
কিম্বা–
ছুট্ল কেন মহেন্দ্রের আনন্দের ঘোর,
টুট্ল কেন উর্বশীর মঞ্জীরের ডোর।
বৈকালে বৈশাখী এল আকাশলুণ্ঠনে,
শুক্লরাতি ঢাক্ল মুখ মেঘাবগুণ্ঠনে।
এদের সম্বন্ধে কী বলা যাবে।
প্রধানত ক্রিয়াপদেরই বিশেষ রূপটাতে প্রাকৃত-বাংলার চেহারা ধরা পড়ে। উপরের ছড়াগুলিতে “উড়্ল’ “ছুট্ল’ “টুট্ল’ “ঢাক্ল’ প্রভৃতি প্রয়োগ নিয়ে তর্কটা ছন্দের তর্ক নয়, ভাষারীতির। এইরকম ক্রিয়াপদ যদি ব্যবহার করি তবে ধরে নিতে হবে ঐ ছড়াগুলি প্রাকৃত-বাংলাতেই লেখা হচ্ছে। আমি যে প্রবন্ধ লিখছি এও প্রাকৃত-বাংলার ঠাটে। যদি আমাকে কারো সঙ্গে মুখে মুখে আলোচনা করতে হত তাহলে এই লেখার সঙ্গে আমার মুখের কথার কোনো তফাত থাকত না। মাঝে মাঝে অভ্যাসদোষে হয়তো ইংরেজি শব্দ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যেত, কিন্তু কখনোই “করিয়াছিল’ “গিয়াছে’ ধরনের ক্রিয়াপদ ভুলেও ব্যবহার করতে পারতুম না। আবার প্রাকৃত-বাংলার ক্রিয়াপদ সংস্কৃত-বাংলায় ব্যবহার করাও চলে না। প্রবোধচন্দ্র “বিচিত্রা’য় লিখেছেন যে, বাঙালি কবিরা সাহস করে কবিতায় “করিব’ “চলিব’ প্রভৃতি প্রয়োগ না করে কেন “করব’ “চলব’ প্রয়োগ না করেন। যদি প্রশ্নটার অর্থ এই হয় যে, অযথাস্থানে কেন করি নে তবে তার উত্তর দেওয়া অনাবশ্যক। যদি বলেন, যথাস্থানেও কেন করি নে, তবে তার উত্তরে বলব, যথাস্থানে করে থাকি।
যে তর্ক নিয়ে লেখা শুরু করেছিলেম সেটাতে ফিরে আসা যাক। বাংলায় হসন্তমধ্য শব্দগুলোয় কয় মাত্রা গণনা করা হবে, তাই নিয়ে সংশয় উঠেছে।
যেগুলি ক্রিয়াপদ নয় সে সম্বন্ধে আমার বক্তব্য এ প্রবন্ধের গোড়াতেই আলোচনা করেছি। বলেছি, নিয়মের বিকল্প চলে; কেননা, বাঙালির কান সাধারণ ব্যবহারে সেই বিকল্প মঞ্জুর করেছে। এ ক্ষেত্রে হিসাবে একটা মাত্রার কমিবেশি নিয়ে তর্ক ওঠে না।
চিম্নি ভেঙে গেছে দেখে গিন্নি রেগে খুন;
ঝি বলে, আমার দোষ নেই ঠাকরুন।
অন্তত “চিমনি’কে দুই মাত্রা করায় কবির দোষ হয় নি। আবার
চিমনি ফেটেছে দেখে গৃহিণী সরোষে;
ঝি বলে, ঠাক্রুন মোর নাই কোনো দোষ।
এ রকম বিপর্যয়ও চলে। একই ছড়ায় “চিম্নি’কে একমাত্রা গ্রেস মার্কা দেওয়া হয়েছে, অথচ “ঠাক্রুন’কে খর্ব করে তিনমাত্রায় নামানো গেল। অপরাধ ঘটেছে বলে মনে করি নি।
কুস্তির আখড়ায় ভিস্তিকে ধরে
জল ছিটাইয়া দাও, ধুলা যাক মরে।
অপর পক্ষে–
রাস্তা দিয়ে কুস্তিগির চলে ঘেঁষাঘেঁষি,
এক্টা নয় দুটো নয় একশোর বেশি।
প্রয়োজনমতো এটাও চলে, ওটাও চলে। নিখতির মাপে বিচার করতে গেলে বিশুদ্ধ ওজনের পয়ার হচ্ছে–
পালোয়ানে পালোয়ানে চলে ঘেঁষাঘেষি।
তাতে প্রত্যেক অক্ষর নিখুঁত একমাত্রা, সবসুদ্ধ চোদ্দটা। “রাস্তা’ “কুস্তি’ প্রভৃতি শব্দে ওজন বেড়ে যায়, তবুও বহুসহিষ্ণু পয়ারকে কাবু করতে পারে না।