বৃষ্টি পড়ছে টাপুর টুপুর নদেয় আসছে বন্যা,
শিব ঠাকুরের বিয়ের বাসরে দান হবে তিন কন্যা।
রামপ্রসাদের একটি গান আছে–
মা আমায় ঘুরাবি কত
চোখবাঁধা বলদের মতো।
এটাও তিনমাত্রা লয়ের ছন্দ।
মা-আ । মায় ঘু । রাবি- । কত-।
ফাঁক ভরাট করতে হলে হবে এই চেহারা–
হে মাতা আমারে ঘুরাবি কতই
চক্ষুবদ্ধ বৃষের মতোই।
যাঁরা অক্ষর গণনা করে নিয়ম বাঁধেন তাঁদের জানিয়ে রাখা ভালো যে, স্বরবর্ণে টান দিয়ে মিড় দেবার জন্যেই প্রাকৃত-বাংলা ছন্দে কবিরা বিনা দ্বিধায় ফাঁক রেখে দেন; সেই ফাঁকগুলো ছন্দেরই অঙ্গ, সে সব জায়গায় ধ্বনির রেশ কিছু কাজ করবার অবকাশ পায়।
হারিয়ে ফেলা বাঁশি আমার পালিয়েছিল বুঝি
লুকোচুরির ছলে।
এর মধ্যে প্রায় প্রত্যেক যতিতে ফাঁক আছে।
১ ২ ৩ ৪
হারিয়ে ফেলা- । বাঁশি আমা-র । পালিয়েছিল । বুঝি–।
৫ ৬
লুকোচুরি-র । ছলে- ।
কিছু বৈচিত্র্যও দেখছি। প্রথম দুটি বিভাগে সমান্তরাল ফাঁক। কিন্তু তিনের ভাগে ফাঁক বাদ গিয়ে একেবারে চতুর্থ ভাগের শেষে দীর্ঘ ফাঁক পড়েছে। পাঠক “হারিয়ে ফেলা’র পরেও ফাঁক না দিয়ে একেবারে দ্বিতীয় ভাগের শেষে যদি সেটা পূরণ করে দেন তবে ভালোই শুনতে হবে। কিন্তু যদি বেফাঁক ঠাসবুনানির বিশেষ ফরমাশ থাকে তাহলে সেটাও চেষ্টা করলে মন্দ হবে না।
স্বপ্ন আমার বন্ধনহীন সন্ধ্যাতারার সঙ্গী
মরণযাত্রীদলে,
স্বর্ণবরণ কুজ্ঝটিকায় অস্তশিখর লঙ্ঘি
লুকায় মৌনতলে।
এই কথাটা লক্ষ্য করবার বিষয় যে, হসন্তবর্ণের হ্রস্ব বা দীর্ঘ যে মাত্রাই থাক্ পাঠ করতে বাঙালি পাঠকের একটুও বাধে না, ছন্দের ঝোঁক আপনিই অবিলম্বে তাকে ঠিকমতো চালনা করে।
পাৎলা করিয়া কাটো কাৎলা মাছেরে,
উৎসুক নাৎনি যে চাহিয়া আছে রে।
এই ছড়াটা পড়তে গেলে বাঙালি নিঃসংশয়ে স্বতই খণ্ড ৎ-এর পূর্ববর্তী স্বরবর্ণকে দীর্ঘ করে পড়বে। আবার যেমনি নিম্নের ছড়াটি সামনে ধর–
পাৎলা করি কাটো, প্রিয়ে, কাৎলা মাছটিরে;
টাট্কা তেলে ফেলে দাও সরষে আর জিরে;
ভেট্কি যদি জোটে তাহে মাখো লঙ্কাবাঁটা,
যত্ন করে বেছে ফেলো টুক্রো যত কাঁটা।
অমনি প্রাক্হসন্ত স্বরগুলিকে ঠেসে দিতে এক মুহূর্তও দেরি হবে না। এই যে বাংলা স্বরবর্ণের সজীবতা, একে কোনো কড়া নিয়মের চাপে আড়ষ্ট করে তাকে সর্বত্র সমানভাবে ব্যবহারযোগ্য করা উচিত– এ মত চালালে বাংলাভাষাকে ফাঁকি দেওয়া হবে। শুকনো আমসত্ত্বের মধ্যেই সাম্য, কিন্তু সরস আমের মধ্যে বৈচিত্র্য, ভোজে কোন্টার দাম বেশি তা নিয়ে তর্ক অনাবশ্যক।
বাংলা-প্রাকৃত ভাষার কাব্যে স্বরধ্বনির যে প্রাণবান্ স্বচ্ছন্দতা আছে সংস্কৃত-বাংলা ভাষা, যাকে আমরা সাধুভাষা বলি, তার মধ্যে পড়ে সে কেন জেনানা মেয়ের মতো দেয়ালে আটকে পড়ে গেল। তার কারণ, সংস্কৃত-বাংলা কৃত্রিম ভাষা, ওখানে বাইরের নিয়মের প্রাধান্য, তার আপন নিয়ম অনেক জায়গায় কুণ্ঠিত। সভাস্থলে একটি আসনে একটি মানুষের স্থান নির্দিষ্ট; কারো বা দেহ ক্ষীণ, আসনে ফাঁক থেকে যায়; কারো বা স্থূল দেহ, আসনে ঠেসে বসতে হয়; কিন্তু গোনাগণ্তি চৌকি, সীমা নির্দিষ্ট। যদি ফরাশে বসতে হত তাহলে কলেবরের তারতম্য ধরে পরস্পরের আসনের সীমানায় কমিবেশি স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটত। কিন্তু সভ্যতার মর্যাদার দিকে দৃষ্টি রেখে স্বভাবের নিয়মকে বাঁধানিয়মে পাকা করে দিতে হয়। তাতে কিছু পীড়ন ঘটলেও গাম্ভীর্যের পক্ষে তার একটা সার্থকতা আছে। সেইজন্যেই সভার রীতি ও ঘরের রীতিতে কিছু ভেদ থাকেই। শকুন্তলার বাকল দেখে দুষ্যন্ত বলেছিলেন : কিমিব হি মধুরাণাং মণ্ডনং নাকৃতীনাম্। কিন্তু যখন তাঁকে রাজান্তঃপুরে নিয়েছিলেন তখন তাঁকে নিশ্চয়ই বাকল পরান নি। তখন শকুন্তলার স্বাভাবিক শোভাকে অলংকৃত করেছিলেন, সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্যে নয়, মর্যাদারক্ষার জন্যে। রাজরানীর সৌন্দর্য ব্যক্তি-বিশেষে বিচিত্র, কিন্তু তাঁর মর্যাদার আদর্শ সকল রাজরানীর মধ্যে এক। ওটা প্রকৃতির হাতে তৈরি নয়, রাজসমাজের দ্বারা নির্দিষ্ট। অর্থাৎ, ওটা প্রাকৃত নয়, সংস্কৃত। তাই দুষ্যন্ত স্বীকার করেছিলেন বটে বনলতার দ্বারা উদ্যানলতা পরাভূত, তবু উদ্যানকে বনের আদর্শে রমণীয় করে তুলতে নিশ্চয় তাঁর সাহস হয় নি। তাই, আমি নিজে আকন্দফুল ভালোবাসি, কিন্তু আমার সাধুসমাজের মালি ঐ গাছের অঙ্গুর দেখবামাত্র উপড়ে ফেলে। সে যদি কবি হত, সাধুভাষায় ছাড়া কবিতা লিখত না। সাধুভাষার ছন্দের বাঁধারীতি যে-জাতীয় ছন্দে চলে এবং শোভা পায় সে হচ্ছে পয়ারজাতীয় ছন্দ। এখানে ফাঁক-ফাঁক নির্দিষ্ট আসনের উপর নানা ওজনেরই ধ্বনিকে চড়ানো নিরাপদ্। এখানে ঠিক চোদ্দটা অক্ষরকে বাহন করে যুগ্ম-অযুগ্ম নানারকমের ধ্বনিই একত্র সভা জমাতে পারে।
কাব্যলীলা একদিন যখন শুরু করেছিলেম তখন বাংলাসাহিত্যে সাধুভাষারই ছিল একাধিপত্য। অর্থাৎ, তখন ছিল কাটা-কাটা পিঁড়িতে ভাগ-করা ছন্দ। এই আইনের অধীনে যতক্ষণ পয়ারের এলাকায় থাকি ততক্ষণ আসনপীড়া ঘটে না। কিন্তু, তিনমাত্রামূলক ছন্দের দিকে আমার কলমের একটা স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল। ঐ ছন্দে প্রত্যেক অক্ষরে স্বতন্ত্র-আরূঢ় সকল ওজনের ধ্বনিকেই সমান দরের একক বলে ধরে নিতে বারম্বার কানে বাজত। সেইজন্যে যুক্ত-অক্ষর অর্থাৎ যুগ্মধ্বনি বর্জন করবার একটা দুর্বল অভ্যাস আমাকে ক্রমেই পেয়ে বসেছিল। ঠোকর খাবার ভয়ে পদগুলোকে একেবারে সমতল করে যাচ্ছিলুম। সব জায়গায় পেরে উঠি নি, কিন্তু মোটের উপর চেষ্টা ছিল। “ছবি ও গান’এ “রাহুর প্রেম’ কবিতা পড়লে দেখা যাবে, যুক্ত-অক্ষর ঝেঁটিয়ে দেবার প্রয়াস আছে তবু তারা পাথরের টুকরোর মতো রাস্তার মাঝে মাঝে উঁচু হয়ে রইল। তাই যখন লিখেছিলুম–