তমালবনে ঝরিছে বারিধারা,
তড়িৎ ছুটে আঁধারে দিশাহারা।
ছিঁড়িয়া ফেলে কিরণকিঙ্কিণী
আত্মঘাতী যেন সে পাগলিনী।
পঞ্চমাত্রাঘটিত এই বারোমাত্রাকেও কেন যে বারোমাত্রা বলে স্বীকার করব না, আমি বুঝতেই পারি নে।
কেবল নয় মাত্রার পদ বলার দ্বারা ছন্দের একটা সাধারণ পরিচয় দেওয়া হয়, সে পরিচয় বিশেষভাবে সম্পূর্ণ হয় না। আমার সাধারণ পরিচয়, আমি ভারতীয়; বিশেষ পরিচয়, আমি বাঙালি; আরও বিশেষ পরিচয়, আমি বিশেষ পরিবারের বিশেষ নামধারী মানুষ। নয় মাত্রার পদবিশিষ্ট ছন্দ সাধারণভাবে অনেক হতে পারে। আরও বিশেষ পরিচয় দাবি করলে, এর কলাসংখ্যা এবং সেই কলার মাত্রাসংখ্যার হিসাব দিতে হয়।
কোনো কোনো ছন্দে কলাবিভাগ করতে ভুল হবার আশঙ্কা আছে। যেমন– গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা। পয়ারের চোদ্দ মাত্রা থেকে এক মাত্রা হরণ ক’রে এই তেরো মাত্রার ছন্দ গঠিত। অর্থাৎ “গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরিষন’ এবং এই ছন্দটি বস্তুত এক, এমন মনে হতে পারে। আমি তা স্বীকার করি নে; তার সাক্ষী শুধু কান নয়, তালও বটে। এই দুটি ছন্দে তালের ঘা পড়েছে কী রকম তা দেখা উচিত।
২ ১
গগনে গরজে মেঘ । ঘন বরিষণ।
সাধারণ পয়ারের নিয়মে এতে দুটি আঘাত।
১ ২ ৩
গগনে গরজে মেঘ । ঘন বর । ষা।
এতে তিনটি আঘাত। পদটি তিন অসমান ভাগে বিভক্ত। পদের শেষবর্ণে স্বতন্ত্র ঝোঁক দিলে তবেই এর ভঙ্গিটাকে রক্ষা করা হয়। “বরষা’ শব্দের শেষ আকার যদি হরণ করা যায় তাহলে ঝোঁক দেবার জায়গা পাওয়া যায় না, তাহলে অক্ষরসংখ্যা সমান হলেও ছন্দ কাত হয়ে পড়ে।
“আঁধার রজনী পোহালো’ পদের অন্তবর্ণে দীর্ঘস্বর আছে, কিন্তু নয় মাত্রার ছন্দের পক্ষে সেটা অনিবার্য নয়। তারি একটি প্রমাণ নিচে দেওয়া গেল।
জ্বেলেছে পথের আলোক
সূর্যরথের চালক,
অরুণরক্ত গগন।
বক্ষে নাচিছে রুধির,
কে রবে শান্ত সুধীর
কে রবে তন্দ্রামগন।
বাতাসে উঠিছে হিলোল,
সাগর-ঊর্মি বিলোল,
এল মহেন্দ্রলগন,
কে রবে তন্দ্রামগন।
এই তর্কক্ষেত্রে আর-একটি আমার কৈফিয়ত দেবার আছে। অমূল্যবাবুর নালিশ এই যে, ছন্দের দৃষ্টান্তে কোনো কোনো স্থলে দুই পঙ্ক্তিকে মিলিয়ে আমি কবিতার এক পদ বলে চালিয়েছি। আমার বক্তব্য এই, লেখার পঙ্ক্তি এবং ছন্দের পদ এক নয়। আমাদের হাঁটুর কাছে একটা জোড় আছে বলে আমরা প্রয়োজনমতো পা মুড়ে বসতে পারি, তৎসত্ত্বেও গণনায় ওটাকে এক পা বলেই স্বীকার করি এবং অনুভব করে থাকি। নইলে চতুষ্পদের কোঠায় পড়তে হয়। ছন্দেও ঠিক তাই–
সকল বেলা কাটিয়া গেল,
বিকাল নাহি যায়।
অমূল্যবাবু একে দুই চরণ বলেন, আমি বলি নে। এই দুটি ভাগকে নিয়েই ছন্দের সম্পূর্ণতা। যদি এমন হত–
সকল বেলা কাটিয়া গেল,
বকুলতলে আসন মেলো–
তাহলে নিঃসংশয়ে একে দুই চরণ বলতুম।
পুনর্বার বলি যে, যে-বিরামস্থলে পৌঁছিয়ে পদ্যছন্দ অনুরূপ ভাগে পুনরাবর্তন করে সেইপর্যন্ত এসে তবেই কোন্টা কোন্ ছন্দ এবং তার মাত্রার পরিমাণ কত তার নির্ণয় সম্ভব, মাঝখানে কোনো একটা জোড়ের মুখে গণনা শেষ করা অসংগত। সংস্কৃত বা প্রাকৃত ছন্দশাস্ত্রে এই নিয়মেরই অনুসরণ করা হয়। দৃষ্টান্ত–
পৈঙ্গল-ছদঃ সূত্রাণি
ভংজিঅ মলঅচোলবই ণিবলিঅ
গংজিঅ গুজ্জরা।
মালবরাঅ মলঅগিরি লুক্কিঅ
পরিহরি কুংজরা।
খুরাসাণ খুহিঅ রণমহ মুহিঅ
লংঘিঅ সাঅরা।
হম্মীর চলিঅ হারব পলিঅ
রিউগণহ কাঅরা॥
গ্রন্থকার বলছেন “বিংশত্যক্ষরাণি’ এবং “পঞ্চবিংশতিমাত্রাঃ’ প্রতিপাদং দেয়াঃ’। এর পদে পদে কুড়িটি অক্ষর ও পঁচিশটা মাত্রা, ছত্রের এই পরিচয়।
পঢ়ম দহ দিজ্জিআ
পুণবি তহ কিজ্জিআ
পুণবি দহ তহ বিরই জাআ।
এম পরি বিবিহু দল
মত্ত সততীস পল
এহু কহ ঝুল্লণা ণাঅরাআ॥
ভাষ্যকারের ব্যাখ্যা এই : প্রথমং দশমাত্রা দীয়ন্তে। অর্থাৎ তত্র বিরতিঃ ক্রিয়তে। পুনরপি তথা কর্তব্যা। পুনরপি সপ্তদশমাত্রাসু বিরতির্জাতা চ। অনয়ৈব রীত্যা দলদ্বয়েপি মাত্রাঃ সপ্তত্রিংশৎ পতন্তি। এমনি করে দলগুলিকে মিলিয়ে যে ছন্দের সাঁইত্রিশ মাত্রা “তামিমাং নাগরাজঃ পিঙ্গলো ঝুল্লণামিতি কথয়তি’। আমি যাকে ছন্দোবিশেষের রূপকল্প বা প্যাটার্ন্ বলছি “ঝুল্লণা’ ছন্দে সেইটে সাঁইত্রিশ মাত্রায় সম্পূর্ণ, তারপরে তার অনুরূপ পুনরাবৃত্তি। অমূল্যবাবু হয়তো এর কলাগুলির প্রতি লক্ষ্য রেখে একে পাঁচ বা দশমাত্রার ছন্দ বলবেন, কিন্তু পাঁচ বা দশমাত্রায় এর পদের সম্পূর্ণতা নয়।
যার ভাগগুলি অসমান এমন ছন্দ দেখা যাক–
কুংতঅরু ধণুদ্ধরু
হঅবর গঅবরু
ছক্কলু বিবি পা-
ইক্ক দলে।
এই ছন্দ সম্বন্ধে বলা হয়েছে “দ্বাত্রিংশন্মাত্রাঃ পাদে সুপ্রসিদ্ধাঃ’। এই ছন্দকে বাংলায় ভাঙতে গেলে এইরকম দাঁড়ায়।
কুঞ্জপথে জ্যোৎস্নারাতে
চলিয়াছে সখীসাথে
মল্লিকাকাকলিকার
মাল্য হাতে।
চার পঙ্ক্তিতে এই ছন্দের পূর্ণরূপ এবং সেই পূর্ণরূপের মাত্রাসংখ্যা বত্রিশ। ছন্দে মাত্রাগণনার এই ধারা আমি অনুসরণ করা কর্তব্য মনে করি। মনে নেই, আমার কোনো পূর্বতন প্রবন্ধে অন্য মত প্রকাশ করেছি কি না; যদি করে থাকি তবে ক্ষমা প্রার্থনা করি।
সবশেষে পুনরায় বলি, ছন্দের স্বরূপনির্ণয় করতে হলে সমগ্রের মাত্রাসংখ্যা, তার কলাসংখ্যা ও কলাগুলির মাত্রাসংখ্যা জানা আবশ্যক। শুধু তাই নয়, যেখানে ছন্দের রূপকল্প একাধিক পদের দ্বারা সম্পূর্ণ হয় সেখানে পদসংখ্যাও বিচার্য। যথা–