মাথা তুলে তুমি
যবে চল তব
রথে
তাকাও না কোথা
আমি ফিরি পথে
পথে,
অবসাদজাল
ঘেরে মোরে পায়
পায়।
মনে পড়ে, এই
হাতে নিয়েছিলে
সেবা–
তবু হায় আজ
মোরে চিনিবে সে
কেবা–
তোমারি চাকার
ধুলা মোরে ঢেকে
যায়।
এর প্রত্যেক পদে চোদ্দ মাত্রা, তিন কলা, সেই কলার মাত্রাসংখ্যা যথাক্রমে ছয় ছয় দুই।
অমূল্যবাবুর মতে, বাংলায় নয় মাত্রার ছন্দ নেই, আছে দশ মাত্রার, কিন্তু দশ মাত্রার ঊর্দ্ধে আর ছন্দ চলে না। আমি অনেক চিন্তা করেও তাঁর এই মতের তাৎপর্য বুঝতে পারি নি। একাদিক্রমে মাত্রাগণনা গণিতশাস্ত্রের সবচেয়ে সহজ কাজ, তাতেও যদি তিনি বাধা দেন তাহলে বুঝতে হবে, তাঁর মতে গণনার বাইরে আরো কিছু গণ্য করবার আছে। হয়তো মোট মাত্রার ভাগগুলো নিয়ে তর্ক। ভাগ সকল ছন্দেই আছে। দশ মাত্রার ছন্দ, যথা–
প্রাণে মোর আছে তার বাণী,
তার বেশি তার নাহি জানি।
এর সহজ ভাগ এই–
প্রাণে মোর
আছে তার
বাণী।
একে অন্য রকমেও ভাগ করা চলে। যথা–
প্রাণে মোর আছে
তার বাণী।
অথবা “প্রাণে’ শব্দটাকে একটু আড় করে রেখে–
প্রাণে মোর আছে তার
বাণী।
এই তিনটেই দশ মাত্রার ছন্দের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তাহলেই দেখা যাচ্ছে, ছন্দকে চিনতে হলে প্রথম দেখা চাই, তার পদের মোট মাত্রা, তারপরে তার কলাসংখ্যা, তারপরে প্রত্যেক কলার মাত্রা।
১ ২
সকল বেলা । কাটিয়া গেল, ।
৩ ৪
বিকাল নাহি । যায়।
এই ছন্দের প্রত্যেক পদে সতেরো মাত্রা। এর চার কলা। অন্ত্য কলাটিতে দুই ও অন্য তিনটি কলায় পাঁচ পাঁচ মাত্রা। এই সতেরো মাত্রা বজায় রেখে অন্যজাতীয় ছন্দ রচনা চলে কলাবৈচিত্র্যের দ্বারা। যথা–
১ ২ ৩
মন চায় । চলে আসে । কাছে, ।
৪ ৫
তবুও পা । চলে না।
বলিবার । কত কথা । আছে, ।
তবু কথা । বলে না।
এ ছন্দে পদের মাত্রা সতেরো, কলার সংখ্যা পাঁচ, তার মাত্রাসংখ্যা যথাক্রমে– চার চার দুই চার তিন। আঠারো মাত্রার দীর্ঘপয়ারে প্রথম আট মাত্রার পরে যেমন স্পষ্ট যতি আছে, এই ছন্দের প্রথম দশ মাত্রার পরে তেমনি।
নয়নে । নিষ্ঠুর । চাহনি ।
হৃদয়ে । করুণা । ঢাকা।
গভীর । প্রেমের । কাহিনী ।
গোপন । করিয়া । রাখা।
এরও পদের মাত্রা সতেরো, কলার সংখ্যা ছয়, শেষ কলাটি ছাড়া প্রত্যেক কলার মাত্রা তিন।
১ ২ ৩ ৪
অন্তর তার । কী বলিতে চায় । চঞ্চল চর । ণে,
কণ্ঠের হার । নয়ন ডুবায় । চম্পক বর । নে।
এরও সমগ্র পদের মাত্রা সতেরো। এর চারটি কলা। প্রথম তিনটি কলায় মাত্রাসংখ্যা ছয়, চতুর্থ কলায় এক। সতেরো মাত্রার ছন্দকে কলাবৈচিত্র্যের দ্বারা আরো নবনব রূপ দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু সাক্ষী আর বাড়াবার দরকার নেই।
শেষের যে দৃষ্টান্ত দেওয়া গেছে তাতে মাত্রাসংখ্যাগণনা উপলক্ষ্যে “চরণে’ শব্দকে ভাগ করে দিয়ে এক মাত্রার “ণে’ ধ্বনিকে স্বতন্ত্র কলায় বসিয়েছি। ওটা যে স্বতন্ত্রকলাভুক্ত তার প্রমাণ এই ছন্দের তাল দেবার সময় ঐ “ণে’ ধ্বনিটির উপর তাল পড়ে।
ইতিপূর্বে অন্যত্র একটি নয় মাত্রার ছন্দের দৃষ্টান্ত দেবার সময় নিম্নলিখিত শ্লোকটি ব্যবহার করেছি। তাল দেবার রীতি বদল ক’রে একে দুরকম করে পড়া যায়, দুটোই পৃথক্ ছন্দ।
বারে বারে যায় । চলিয়া
ভাসায় গো আঁখি । নীরে সে।
বিরহের ছলে । ছলিয়া
মিলনের লাগি । ফিরে সে।
এটা নয় মাত্রার শ্রেণীর ছন্দ; এর দুই কলা এবং কলাগুলি ত্রৈমাত্রিক। এর পদকে তিন কলায় ভাগ করে কলাগুলিকে দুই মাত্রার ছাঁদ দিলে এই একই ছড়া সম্পূর্ণ নূতন ছন্দে গিয়ে পৌঁছাবে। যথা –
১ ২ ৩
বারে বারে । যায় চলি । য়া
ভাসায় গো । আঁখিনীরে । সে।
বিরহের । ছলে ছলি । য়া
মিলনের । লাগি ফিরে । সে।
সারাদিন । দহে তিয়া । ষা,
বারেক না । দেখি উহা । রে।
অসময়ে । লয়ে কী আ । শা
অকারণে । আসে দুয়া । রে।
অমূল্যবাবু বলেন, এর প্রথম দুই কলায় চার চার আট এবং শেষের কলায় এক মাত্রার ছন্দ কৃত্রিম শুনতে হয়। বোধ হয় অখণ্ড শব্দকে খণ্ডিত করা হচ্ছে বলে তাঁর কাছেএটা কৃত্রিম ঠেকছে। কিন্তু, ছন্দের ঝোঁকে অখণ্ড শব্দকে দুভাগ করার দৃষ্টান্ত অনেক আছে। এরকম তর্কে বিশুদ্ধ হাঁ এবং না-এর দ্বন্দ্ব; কোনো পক্ষে কোনো যুক্তিপ্রয়োগের ফাঁক নেই। আমি বলছি, কৃত্রিম শোনায় না; তিনি বলছেন, শোনায়। আমি এখনো বলি, এই রকম কলাভাগে এই ছন্দে একটি নূতন নৃত্যভঙ্গি জেগে ওঠে, তার একটা রস আছে।
দশের বেশি মাত্রাভার বাংলা ছন্দ বহন করতে অক্ষম, এ কথা মানতে পারব না। নিম্নে বারো মাত্রার একটি শ্লোক দেওয়া গেল।
মেঘ ডাকে গম্ভীর গরজনে,
ছায়া নামে তমালের বনে বনে,
ঝিল্লি ঝনকে নীপবীথিকায়।
সরোবর উচ্ছল কূলে কূলে,
তটে তারি বেণুশাখা দুলে দুলে
মেতে ওঠে বর্ষণগীতিকায়।
শ্রোতারা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, আবৃত্তিকালে পদান্তের পূর্বে কোনো যতিই দিই নি, অর্থাৎ বারো মাত্রা একটি ঘনিষ্ঠ গুচ্ছের মতোই হয়েছে। এই পদগুলিকে বারো মাত্রার পদ বলবার কোনো বাধা আছে বলে আমি কল্পনা করতে পারি নে। উল্লিখিত শ্লোকের ছন্দে বারো মাত্রা, প্রত্যেক পদে তিন কলা, প্রত্যেক কলায় চার মাত্রা। বারো মাত্রার পদকে চার কলায় বিভক্ত করে ত্রৈমাত্রিক করলে আর-এক ছন্দ দেখা দেবে। যথা–
শ্রাবণগগন, ঘোর ঘনঘটা,
তাপসী যামিনী এলায়েছে জটা,
দামিনী ঝলকে রহিয়া রহিয়া।
এ ছন্দ বাংলাভাষায় সুপরিচিত।