অথচ প্রাকৃত-বাংলার প্রকৃতি সমতল নয়। সংস্কৃতের নিয়মে না হোক, নিজের নিয়মে তার একটা ঢেউখেলা আছে। তার কথার সকল অংশ সমান ওজনের নয়, বস্তুত পদে পদেই তার শব্দ বন্ধুর হয়ে ওঠে। তার কারণ, প্রাকৃত-বাংলায় হসন্তের প্রাদুর্ভাব খুব বেশি। এই হসন্তের দ্বারা ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে সংঘাত জন্মাতে থাকে, সেই সংঘাতে ধ্বনি গুরু হয়ে ওঠে। প্রাকৃত-বাংলার এই গুরুধ্বনির প্রতি যদি সদ্ব্যবহার করা যায় তাহলে ছন্দের সম্পদ বেড়ে যায়। প্রাকৃত-বাংলার দৃষ্টান্ত–
বৃষ্টি পড়ে টাপুর্ টুপুর্ নদেয়্ এল বান্।
শিব্ ঠাকুরের্ বিয়ে হবে তিন্ কন্যে দান্॥
এক্ কন্যে রাঁধেন্ বাড়েন্ এক্ কন্যে খান্।
এক্ কন্যে না পেয়ে বাপের্ বাড়ি যান্॥
এই ছড়াটিতে দুটি জিনিস দেখবার আছে। এক হচ্ছে, বিসর্গের ঘটকালিতে ব্যঞ্জনের সঙ্গে ব্যঞ্জনের সম্মিলন, আর এক হচ্ছে “বৃষ্টি’ এবং “কন্যে’ কথার যুক্তবর্ণকে যথোচিত মর্যাদা দেওয়া। এই ছড়া সাধু বাংলার ছন্দে বাঁধলে পালিশ-করা আবলুস কাঠের মতো পিছল হয়ে ওঠে।
বারি ঝরে ঝর ঝর নদিয়ায় বান।
শিবঠাকুরের বিয়ে তিন মেয়ে দান॥
এক মেয়ে রাঁধিছেন এক মেয়ে খান।
এক মেয়ে ক্ষুধাভরে পিতৃঘরে যান॥
এতে যুক্তবর্ণের সংযোগ হলেও ছন্দের উল্লাস তাতে বিশেষ বাড়ে না। যথা–
মন্দ মন্দ বৃষ্টি পড়ে নবদ্বীপে বান।
শিবঠাকুরের বিয়া তিন কন্যা দান॥
এক কন্যা রান্ধিছেন এক কন্যা খান।
এক কন্যা ঊর্ধ্বশ্বাসে পিতৃগৃহে যান॥
এই-সব যুক্তবর্ণের যোগে এ ছন্দ বন্ধুর হয়ে উঠেছে বটে কিন্তু তরঙ্গিত হয় নি; কেননা যুক্তবর্ণ যথেচ্ছ ছড়ানো হয়েছে মাত্র, তাদের মর্যাদা অনুসারে জায়গা দেওয়া হয় নি। অর্থাৎ, হাটের মধ্যে ছোটোয় বড়োয় যেমন গায়ে গায়ে ভিড় করে তেমনি, সভার মধ্যে যেমন তারা যথাযোগ্য আসন পায় তেমন নয়।
ছন্দঃকুসুম বইটির লেখক প্রাকৃত-বাংলার ছন্দ সম্বন্ধে অনুষ্টভ্ ছন্দে বিলাপ করে বলছেন–
পাঁচালী নাম বিখ্যাতা সাধারণ-মনোরমা।
পয়ার ত্রিপদী আদি প্রাকৃতে হয় চালনা॥
দ্বিপাদে শ্লোক সংপূর্ণ তুল্যসংখ্যার অক্ষরে।
পাঠে দুই পদে মাত্র শেষাক্ষর সদা মিলে॥
পঠনে সে সব ছন্দঃ রাখিতে তালগৌরব।
পঠিছে সর্বদা লোকে উচ্চারণ-বিপর্যয়ে॥
লঘুকে গুরু সম্ভাষে দীর্ঘবর্ণে কহে লঘু।
হ্রস্বে দীর্ঘে সমজ্ঞানে উচ্চারণ করে সবে॥
কবির এই বিলাপের সঙ্গে আমিও যোগ দিচ্ছি। কেবল আমি এই বলতে চাই, প্রাকৃত বাংলার ছন্দে এমনতরো দুর্ঘটনা ঘটে না, এসব ঘটে সংস্কৃত-বাংলার ছন্দে। প্রাকৃত-বাংলার যে স্বকীয় দীর্ঘহ্রস্বতা আছে তার ছন্দে তার বিপর্যয় দেখি নে, কিন্তু সাধু ভাষায় দেখি।
এই প্রাকৃত-বাংলা মেয়েদের ছড়ায়, বাউলের গানে, রামপ্রসাদের পদে আপন স্বভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সাধুসভায় তার সমাদর হয় নি বলে সে মুখ ফুটে নিজের সব কথা বলতে পারে নি এবং তার শক্তি যে কত তারও সম্পূর্ণ পরিচয় হল না। আজকের দিনের ডিমোক্রেসির যুগেও সে ভয়ে-ভয়ে দ্বিধা করে চলেছে; কোথায় যে তার পংক্তি এবং কোথায় নয় তা স্থির হয় নি। এই সংকোচে তার আত্মপরিচয়ের খর্বতা হচ্ছে। আমরা একটা কথা ভুলে যাই প্রাকৃত-বাংলার লক্ষ্মীর পেট্রায় সংস্কৃত, পারসি, ইংরেজি প্রভৃতি নানা ভাষা থেকেই শব্দসঞ্চয় হচ্ছে, সেইজন্যে শব্দের দৈন্য প্রাকৃত-বাংলার স্বভাবগত বলে মনে করা উচিত নয়। প্রয়োজন হলেই আমরা প্রাকৃতভাণ্ডারে সংস্কৃত শব্দের আমদানি করতে পারব। কাজেই যেখানে অর্থের বা ধ্বনির প্রয়োজনবশত সংস্কৃত শব্দই সংগত সেখানে প্রাকৃত-বাংলায় তার বাধা নেই। আবার ফার্সি কথাও তার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা একসারে বসিয়ে দিতে পারি। সাধুবাংলায় তার বিঘ্ন আছে, কেননা সেখানে জাতি রক্ষা করাকেই সাধুতা রক্ষা করা বলে। প্রাকৃত ভাষার এই ঔদার্য গদ্যে পদ্যে আমাদের সাহিত্যের একটি পরম সম্পদ্, এই কথা মনে রাখতে হবে।
চৈত্র, ১৩২৪
ছন্দের মাত্রা – ১
বহুকাল পূর্বে একটি গান রচনা করেছিলেম। “সবুজপত্রে’ সেটি উদ্ধৃত হয়েছিল।
আঁধার রজনী পোহালো, জগৎ পুরিল পুলকে, বিমল প্রভাতকিরণে মিলিল দ্যুলোক ভূলোকে।
তাছাড়া এই ছন্দে পরবর্তী কালে দুই-একটি শ্লোক লিখেছিলুম। যথা–
গোড়াতেই ঢাক বাজনা, কাজ করা তার কাজ না।
আরেকটি–
শকতিহীনের দাপনি আপনারে মারে আপনি।
বলা বাহুল্য এগুলি নয় মাত্রার চালে লেখা।
“সবুজপত্রে’র প্রবন্ধে তার পরে দেখিয়েছিলুম ধ্বনিসংখ্যার কতরকম হেরফের করে এই ছন্দের বৈচিত্র্য ঘটতে পারে, অর্থাৎ তার চলন কত ভঙ্গির হয়। তাতে যে-দৃষ্টান্ত রচনা করেছিলেম তার পুনরুক্তি না করে নতুন বাণী প্রয়োগ করা যাক।
এইখানে বলে রাখা ভালো এই প্রবন্ধে ব্যবহৃত উদাহরণগুলিতে প্রত্যেক ভাগে তাল দিলে ছন্দের পার্থক্য ধরা সহজ হয়।
উপরের ছন্দে ৩+৩+৩এর লয়। নিচের ছন্দে ৩+২+৪এর লয়।
আসন । দিলে । অনাহূতে, ভাষণ । দিলে । বীণাতানে, বুঝি গো। তুমি । মেঘদূতে । পাঠায়ে । ছিলে । মোর পানে। বাদল রাতি এল যবে বসিয়াছিনু একা একা, গভীর গুরু গুরু রবে কী ছবি মনে দিল দেখা। পথের কথা পুবে হাওয়া কহিল মোরে থেকে থেকে; উদাস হয়ে চলে যাওয়া, খ্যাপামি সেই রোধিবে কে। আমার তুমি অচেনা যে সে কথা নাহি মানে হিয়া, তোমারে কবে মনোমাঝে জেনেছি আমি না জানিয়া। ফুলের ডালি কোলে দিনু, বসিয়াছিলে একাকিনী, তখনি ডেকে বলেছিনু, তোমারে চিনি, ওগো চিনি॥
তার পরে ৪+৩+২ —
বলেছিনু । বসিতে । কাছে, দেবে কিছু । ছিল না । আশা, দেব ব'লে । যেজন । যাচে বুঝিলে না । তাহারো । ভাষা। শুকতারা চাঁদের সাথি বলে, "প্রভু, বেসেছি ভালো, নিয়ে যেয়ো আমার বাতি যেথা যাবে তোমার আলো।" ফুল বলে, "দখিনাহাওয়া, বাঁধিব না বাহুর ডোরে, ক্ষণতরে তোমারে পাওয়া চিরতরে দেওয়া যে মোরে।"
তার পরে ৩ + ৬ —
বিজুলি । কোথা হতে এলে, তোমারে । কে রাখিবে বেঁধে। মেঘের । বুক চিরি গেলে অভাগা । মরে কেঁদে কেঁদে। আগুনে গাঁথা মণিহারে ক্ষণেক সাজায়েছে যারে, প্রভাতে মরে হাহাকারে বিফল রজনীর খেদে।
দেখা যাক ৪ + ৫ —
মোর বনে । ওগো গরবী, এলে যদি । পথ ভুলিয়া, তবে মোর । রাঙা করবী নিজ হাতে । নিয়ো তুলিয়া।
আরেকটা–
জলে ভরা । নয়নপাতে বাজিতেছে । মেঘরাগিণী, কী লাগিয়া । বিজনরাতে উড়ে হিয়া, । হে বিবাগিনী। ম্লানমুখে । মিলালো হাসি, গলে দোলে । নবমালিকা। ধরাতলে । কী ভুলে আসি সুর ভোলে । সুরবালিকা।
তার পরে ৪ + ৪ + ১। বলে রাখা ভালো এই ছন্দটি পড়াবার সময় সবশেষ ধ্বনিটিকে বিচ্ছন্ন করতে হবে।–
বারে বারে । যায় চলি । য়া, ভাসায় ন । য়ননীরে । সে, বিরহের । ছলে ছলি । য়া মিলনের । লাগি ফিরে । সে। যায় নয়নের আড়া লে, আসে হৃদয়ের মাঝে গো। বাঁশিটিরে পায়ে মাড়া লে বুকে তার সুর বাজে গো। ফুলমালা গেল শুকা য়ে, দীপ নিবে গেল বাতা সে, মোর ব্যথাখানি লুকা য়ে মনে তার রহে গাঁথা সে। যাবার বেলায় দুয়া রে তালা ভেঙে নেয় ছিনি য়ে, ফিরিবার পথ উহা রে ভাঙা দ্বার দেয় চিনি য়ে॥
৩ + ২ + ৪এর লয় পূর্বে দেখানো হয়েছে। ৫ + ৪এর লয় এখানে দেওয়া গেল।
আলো এল যে । দ্বারে তব, ওগো মাধবী । বনছায়া। দোঁহে মিলিয়া । নবনব তৃণে বিছায়ে । গাঁথ মায়া। চাঁপা, তোমার আঙিনাতে ফেরে বাতাস কাছে কাছে; আজি ফাগুনে একসাথে দোলা লাগিয়ো নাচে নাচে॥ বধূ, তোমার দেহলিতে বর আসিছে দেখিছ কি। আজি তাহার বাঁশরিতে হিয়া মিলায়ে দিয়ো, সখি।
৬ + ৩এর ঠাটেও নয় মাত্রাকে সাজানো চলে। যেমন–
সেতারের তারে । ধানশী মিড়ে মিড়ে উঠে । বাজিয়া। গোধূলির রাগে । মানসী সুরে যেন এল । সাজিয়া।
আরেকটা–
তৃতীয়ার চাঁদ । বাঁকা সে, আপনারে দেখে । ফাঁকা সে। তারাদের পানে । তাকিয়ে কার নাম যায় । ডাকিয়ে, সাথি নাহি পায় । আকাশে।
এতক্ষণ এই যে নয় মাত্রার ছন্দটাকে নিয়ে নয়-ছয় করছিলুম সেটা বাহাদুরি করবার জন্যে নয়, প্রমাণ করবার জন্যে যে এতে বিশেষ বাহাদুরি নেই। ইংরেজি ছন্দে এক্সেন্টের প্রভাব; সংস্কৃত ছন্দে দীর্ঘহ্রস্বের সুনির্দিষ্ট ভাগ। বাংলায় তা নেই, এইজন্যে লয়ের দাবিরক্ষা ছাড়া বাংলা ছন্দে মাত্রা বাড়িয়ে-কমিয়ে চলার আর-কোনো বাধা নেই। “জল পড়ে পাতা নড়ে’ থেকে আরম্ভ করে পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ মাত্রা পর্যন্ত বাংলা ছন্দে আমরা দেখি। এই সুযোগে কেউ বলতে পারেন, এগারো মাত্রার ছন্দ বানিয়ে নতুন কীর্তি স্থাপন করব। আমি বলি, তা করো কিন্তু পুলকিত হোয়ো না, কেননা কাজটা নিতান্তই সহজ। দশ মাত্রার পরে আর-একটা মাত্রা যোগ করা একেবারেই দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। যেমন–
চামেলির ঘনছায়া বিতানে বনবীণা বেজে ওঠে কী তানে। স্বপনে মগন সেথা মালিনী কুসুমমালায় গাঁথা শিথানে॥
অন্যরকমের মাত্রাভাগ করতে চাও সেও কঠিন নয়। যেমন–
মিলনসুলগনে । কেন বল্, নয়ন করে তোর । ছল্ছল্। বিদায়দিনে যবে । ফাটে বুক, সেদিনো দেখেছি তো । হাসিমুখ।
তারপরে তেরো মাত্রার প্রস্তাবটা শুনতে লাগে খাপছাড়া এবং নতুন, কিন্তু পয়ার থেকে একমাত্রা হরণ করতে দুঃসাহসের দরকার হয় না। সে কাজ অনেকবার করেছি, তা নিয়ে নালিশ ওঠে নি। যথা–
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
এক মাত্রা যোগ করে পয়ারের জ্ঞাতিবৃদ্ধি করাও খুবই সহজ। যথা–
হে বীর, জীবন দিয়ে মরণের জিনিলে, নিজেরে নিঃস্ব করি বিশ্বেরে কিনিলে।
ষোলো মাত্রার ছন্দ দুর্লভ নয়। অতএব দেখা যাক সতেরো মাত্রা–
নদীতীরে দুই । কূলে কূলে । কাশবন দুলি । ছে । পূর্ণিমা তারি । ফুলে ফুলে । আপনারে ভুলি । ছে ।
আঠারো মাত্রার ছন্দ সুপরিচিত। তার পরে উনিশ —
ঘন মেঘভার গগনতলে, বনে বনে ছায়া তারি, একাকিনী বসি নয়নজলে কোন্ বিরহিণী নারী।
তারপরে কুড়ি মাত্রার ছন্দ সুপ্রচলিত। একুশ মাত্রা, যথা–
বিচলিত কেন মাধবীশাখা, মঞ্জরি কাঁপে থরথর। কোন্ কথা তার পাতায় ঢাকা চুপিচুপি করে মরমর।
তারপরে– আর কাজ নেই, বোধ হয় যথেষ্ট প্রমাণ করতে পেরেছি যে, বাংলায় নতুন ছন্দ তৈরি করতে অসাধারণ নৈপুণ্যের দরকার করে না।