পুনশ্চ এই ছন্দেরই মাত্রাসমষ্টি সমান রেখে এরই পদক্ষেপমাত্রার পরিবর্তন করে যদি পড়া যায় তাহলে শ্লোকটি চোখে দেখতে একই রকম থাকবে কিন্তু কানে শুনতে অন্য রকম হবে। এইখানে বলে রাখি, ছন্দের প্রত্যেক ভাগে একটা করে তালি দিলে পড়বার সুবিধা হবে এবং এই তালি অনুসারে ভিন্ন ছন্দের ভিন্ন লয় ধরা পড়বে। প্রথমে সাত মাত্রাকে তিন এবং চারে স্বতন্ত্র ভাগ করে পড়া যাক। যেমন–
তালি তালি তালি তালি ফাগুন এল দ্বারে কেহ যে ঘরে নাই, পরান ডাকে কারে ভাবিয়া নাহি পাই।
তারপরে পাঁচ-দুই ভাগ করা যাক। যেমন–
তালি তালি তালি তালি ফাগুন এল দ্বারে কেহ যে ঘরে নাই, পরান ডাকে কারে ভাবিয়া নাহি পাই।
এই চোদ্দ মাত্রা-সমষ্টির ছন্দ আরো কত রকম হতে পারে তার কতকগুলি নমুনা দেওয়া যাক। দুই-পাঁচ দুই-পাঁচ ভাগের ছন্দ, যথা–
। । । । সে যে আপন মনে শুধু দিবস গণে, তার চোখের বারি কাঁপে আঁখির কোণে।
চার-তিন চার-তিন ভাগ–
। । । । নয়নের সলিলে যে কথাটি বলিলে রবে তাহা স্মরণে জীবনে ও মরণে।
কিম্বা এক-ছয় এক-ছয় ভাগ–
। । । । যে কথা নাহি শোনে সে থাক্ নিজমনে, কে বৃথা নিবেদনে রে ফিরে তার সনে।
সাত-চার-তিনের ভাগ–
। । । চাহিছ বারে বারে আপনারে ঢাকিতে, মন না মানে মানা মেলে ডানা আঁখিতে।
এই কবিতাটাকেই অন্য লয়ে পড়া যায়–
। । । । চাহিছ বারে বারে আপনারে ঢাকিতে, মন না মানে মানা মেলে ডানা আঁখিতে।
তিন-তিন-তিন-তিন-দুইয়ের ভাগ–
। । । । ব্যাকুল বকুল ঝরিল পড়িল ঘাসে, বাতাস উদাস আমের বোলের বাসে।
একেই ছয়-আটের ভাগে পড়া যায়–
। । ব্যাকুল বকুল ঝরিল পড়িল ঘাসে, বাতাস উদাস আমের বোলের বাসে।
পাঁচ-চার-পাঁচের ভাগ–
। । । নীরবে গেলে ম্লানমুখে আঁচল টানি, কাঁদিছে দুখে মোর বুকে না-বলা বাণী।
এই শ্লোককেই তিন-ছয়-পাঁচ ভাগ করা যায়–
। । । নীরবে গেলে ম্লানমুখে আঁচল টানি, কাঁদিছে দুখে মোর বুকে না-বলা বাণী।
এর থেকে এই বোঝা যাচ্ছে, প্রদক্ষিণের সমষ্টিমাত্রা চোদ্দ হলেও সেই সমষ্টির অংশের হিসাব কে কী ভাবে নিকাশ করছে তারই উপর ছন্দের প্রভেদ ধরা পড়ে। কেবল ছন্দরসায়নে নয়,বস্তুরসায়নেও এইরকম উপাদানের মাত্রা-ভাগ নিয়েই বস্তুর প্রকৃতিভেদ ঘটে, রাসায়নিকেরা বোধ করি এই কথা বলেন।
পয়ার-ছন্দের বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, তাকে প্রায় গাঁঠে গাঁঠে ভাগ করা চলে, এবং প্রত্যেক ভাগেই মূল ছন্দের একটা আংশিক রূপ দেখা যায়। যথা–
ওহে পান্থ, চলো পথে, পথে বন্ধু আছে
একা বসে ম্লানমুখে, সে যে সঙ্গ যাচে।
“ওহে পান্থ’, এইখানে একটা থামবার স্টেশন মেলে। তার পরে যথাক্রমে, “ওহে পান্থ চলো’,”ওহে পান্থ চলো পথে’, “ওহে পান্থ চলো পথে পথে’। তার পরে “বন্ধু আছে’, এই ভগ্নাংশটার সঙ্গে পরের লাইন জোড়া যায়, যেমন– “বন্ধু আছে একা’, “বন্ধু আছে একা বসে’, “বন্ধু আছে একা বসে সে যে’। কিন্তু তিনের ছন্দকে তার ভাগে ভাগে পাওয়া যায় না, এইজন্যে তিনের ছন্দে ইচ্ছামতো থামা চলে না। যেমন, “নিশি দিল ডুব অরুণসাগরে’। “নিশি দিল’, এখানে থামা যায়, কিন্তু তাহলে তিনের ছন্দ ভেঙে যায়; “নিশি দিল ডুব’ পর্যন্ত এসে ছয় মাত্রা পুরিয়ে দিয়ে তবেই তিনের ছন্দ হাঁফ ছাড়তে পারে। কিন্তু আবার, “নিশি দিল ডুব অরুণ’ এখানেও থামা যায় না; কেননা তিন এমন একটি মাত্রা যা আর একটা তিনকে পেলে তবে দাঁড়াতে পারে, নইলে টলে পড়তে চায়; এইজন্য “অরুণসাগর’এর মাঝখানে থামতে গেলে রসনা কূল পায় না। তিনের ছন্দে গতির প্রাবল্যই বেশি, স্থিতি কম। সুতরাং তিনের ছন্দ চাঞ্চল্যপ্রকাশের পক্ষে ভালো কিন্তু তাতে গাম্ভীর্য এবং প্রসার অল্প। তিনের মাত্রার ছন্দে আমিত্রাক্ষর রচনা করতে গেলে বিপদে পড়তে হয়, সে যেন চাকা নিয়ে লাঠিখেলার চেষ্টা। পয়ার আট পায়ে চলে বলে তাকে যে কত রকমে চালানো যায় মেঘনাদবধকাব্যে তার প্রমাণ আছে। তার অবতারণাটি পরখ করে দেখা যাক। এর প্রত্যেক ভাগে কবি ইচ্ছামতো ছোটো বড়ো নানা ওজনের নানা সুর বাজিয়েছেন; কোনো জায়গাতেই পয়ারকে তার প্রচলিত আড্ডায় এসে থামতে দেন নি। প্রথম আরম্ভেই বীরবাহুর বীরমর্যাদা সুগম্ভীর হয়ে বাজল– “সম্মুখসমরে পড়ি বীরচূড়ামণি বীরবাহু’। তার পরে তার অকালমৃত্যুর সংবাদটি যেন ভাঙা রণপতাকার মতো ভাঙা ছন্দে ভেঙে পড়ল– “চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে’। তার পরে ছন্দ নত হয়ে নমস্কার করলে– “কহ হে দেবি অমৃত-ভাষিণি’। তার পরে আসল কথাটা, যেটা সবচেয়ে বড়ো কথা, সমস্ত কাব্যের ঘোর পরিণামের যেটা সূচনা, সেটা যেন আসন্ন ঝটিকার সুদীর্ঘ মেঘগর্জনের মতো এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে উদ্ঘোষিত হল– “কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতিপদে পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি রাঘবারি’।