পাষাণ মিলায়ে যায় গায়ের বাতাসে।
এর মধ্যে যে কতটা ফাঁক আছে তা যুক্তাক্ষর বসালেই টের পাওয়া যায়।
পাষাণ মূর্ছিয়া যায় গায়ের বাতাসে।
ভারি হল না।
পাষাণ মূর্ছিয়া যায় অঙ্গের বাতাসে।
এতেও বিশেষ ভিড় বাড়ল না।
পাষাণ মূর্ছিয়া যায় অঙ্গের উচ্ছ্বাসে।
এও বেশ সহ্য হয়।
সংগীত তরঙ্গি উঠে অঙ্গের উচ্ছ্বাসে।
এতেও অত্যন্ত ঠেসাঠেসি হল না।
সংগীততরঙ্গরঙ্গ অঙ্গের উচ্ছ্বাস।
অনুপ্রাসের ভিড় হল না বটে কিন্তু এখনো অন্ধকূপহত্যা হবার মতো হয় নি। কিন্তু এর বেশি আর সাহস হয় না। তবু যদি আরো প্যাসেঞ্জার নেওয়া যায় তাহলে যে একেবারে পয়ারের নৌকাডুবি হবে তা নয়, তবে কিনা হাঁপ ধরবে। যথা–
দুর্দান্তপাণ্ডিত্যপূর্ণ দুঃসাধ্য সিদ্ধান্ত।
কিন্তু দুই মাত্রার ছন্দ মাত্রেরই যে এই রকম অসাধারণ শোষণশক্তি তা বলতে পারি নে। যেখানে পদক্ষেপ ঘন ঘন সেখানে ঠিক উলটো। যথা–
২ ২ ২ ২ ২ ২ ২ ধরণীর আঁখিনীর মোচনের ছলে ২ ২ ২ ২ ২ ২ ২ দেবতার অবতার বসুধার তলে।
এও পয়ার কিন্তু যেহেতু এর পদক্ষেপ আটে নয়, দুইয়ে, সেইজন্যে এর উপরে বোঝা সয় না। যে দ্রুত চলে তাকে হালকা হতে হয়। যদি লেখা যায়–
ধরিত্রীর চক্ষুনীর মুঞ্চনের ছলে কংসারির শঙ্খরব সংসারের তলে।
তাহলে ও একটা স্বতন্ত্র ছন্দ হয়ে যায়। সংস্কৃতেও দেখো, সমমাত্রার ছন্দ যেখানে দুয়ের লয়ে চলে সেখানে দৌড় বেশি। যেমন–
২ ২ ২ ২ ২ ২ ২ ২ হরি রিহ বিহরতি সরস বসন্তে।
অসম অর্থাৎ তিন মাত্রার চলনও দ্রুত।
পাষাণ মিলায় গায়ের বাতাসে।
এর লয়টা দুরন্ত। পড়লেই বোঝা যায়, এর প্রত্যেক তিন মাত্রা পরবর্তী তিন মাত্রাকে চাচ্ছে, কিছুতে তর সচ্ছে না। তিনের মাত্রাটা টল্টলে, গড়িয়ে যাবার দিকে তার ঝোঁক। এইজন্যে তিনকে গুণ করে ছয় বা বারো করলেও তার চাপল্য ঘোচে না। দুই মাত্রার চলন ক্ষিপ্র, তিন মাত্রার চঞ্চল, চার মাত্রার মন্থর, আট মাত্রার গম্ভীর। তিন মাত্রার ছন্দে যে পয়ারের মতো ফাঁক নেই তা যুক্তাক্ষর জুড়তে গেলেই ধরা পড়বে। যথা–
গিরির গুহায় ঝরিছে নিঝর
এই পদটিকে যদি লেখা যায়
পর্বত- কন্দরে ঝরিছে নির্ঝর
তাহলে ছন্দের পক্ষে সাংঘাতিক হয়। অথচ পয়ারে
গিরিগুহাতল বেয়ে ঝরিছে নিঝর
এবং
পর্বতকন্দরতলে ঝরিছে নির্ঝর
ছন্দের পক্ষে দুইই সমান।
বিষমমাত্রার ছন্দের স্বভাব হচ্ছে, তার প্রত্যেক পদে এক অংশে গতি, আর-এক অংশে বাধা। এই গতি এবং বাধার সম্মিলনে তার নৃত্য।
অহহ কল- য়ামি বল- য়াদিমণি- ভূষণং হরি্বিরহ- দহনবহ- নেন বহু- দূষণং।
তিন মাত্রার “অহহ’ যে ছাঁদে চলবার জন্যে বেগ সঞ্চয় করলে, দুই মাত্রার “কল’ তাকে হঠাৎ টেনে থামিয়ে দিলে, আবার পরক্ষণেই তিন যেই নিজমূর্তি ধরলে অমনি আবার দুই এসে তার লাগামে টান দিলে। এই বাধা যদি সত্যকার বাধা হত তাহলে ছন্দই হত না; এ কেবল বাধার ছল, এতে গতিকে আরো উস্কিয়ে দেয় এবং বিচিত্র করে তোলে। এইজন্যে অন্য ছন্দের চেয়ে বিষমমাত্রার ছন্দে গতিকে আরো যেন বেশি অনুভব করা যায়।
যাই হোক আমার বক্তব্য এই, ছন্দের পরিচয়ের মূলে দুটি প্রশ্ন আছে। এক হচ্ছে, তার প্রত্যেক পদক্ষেপে ক’টি করে মাত্রা আছে। দুই হচ্ছে, সে মাত্রা সম, অসম, না বিষম অথবা সম-বিষমের যোগ। আমরা যখন মোটা করে বলে থাকি যে, এটা চোদ্দ মাত্রার ছন্দ, বা, ওটা দশ মাত্রার, তখন আসল কথাটাই বলা হয় না। তার কারণ পূর্বেই বলেছি, চাল অর্থাৎ প্রদক্ষিণের মাত্রায় ছন্দকে চেনা যায় না, চলন অর্থাৎ পদক্ষেপের মাত্রায় তার পরিচয়। চোদ্দ মাত্রায় শুধু যে পয়ার হয় না, আরো অনেক ছন্দ হয়, তার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।
বসন্ত পাঠায় দূত রহিয়া রহিয়া, যে কাল গিয়েছে তারি নিশ্বাস বহিয়া।
এই তো পয়ার, এর প্রত্যেক প্রদক্ষিণে দুটি পদক্ষেপ। প্রথম পদক্ষেপে আটটি উচ্চারিত মাত্রা, দ্বিতীয় পদক্ষেপে ছয়টি উচ্চারিত মাত্রা এবং দুটি অনুচ্চারিত অর্থাৎ যতির মাত্রা। অর্থাৎ, প্রত্যেক প্রদক্ষিণে মোটের উপর উচ্চারিত মাত্রা চোদ্দ । আমরা পয়ারের পরিচয় দেওয়ার কালে প্রত্যেক প্রদক্ষিণের উচ্চারিত মাত্রার সমষ্টি হিসাব দিয়ে থাকি। তার প্রধান কারণ, কিছুকাল পূর্বে পয়ার ছাড়া চোদ্দ মাত্রা-সমষ্টির ছন্দ আমাদের ব্যবহারে লাগত না। নিম্নলিখিত চোদ্দ মাত্রার ছন্দেও ঠিক পয়ারের মতোই প্রত্যেক প্রদক্ষিণে দুটি করে পদক্ষেপ।
ফাগুন এল দ্বারে কেহ যে ঘরে নাই, পরান ডাকে কারে ভাবিয়া নাহি পাই।
অথচ এটা মোটেই পয়ার নয়। তফাত হল কিসে যাচাই করে দেখলে দেখা যাবে যে, এর প্রতি পদক্ষেপে আটের বদলে সাত উচ্চারিত মাত্রা। আর অনুচ্চারিত মাত্রা প্রতি পদক্ষেপের শেষে একটি করে দেওয়া যেতে পারে। যেমন–
ফাগুন এল দ্বারে-এ কেহ যে ঘরে না-আ-ই।
কিম্বা কেবল শেষ ছেদে একটি দেওয়া যেতে পারে। যেমন-
ফাগুন এল দ্বারে কেহ যে ঘরে না-আ-ই।
কিম্বা যতি একেবারেই না দেওয়া যেতে পারে।