ছন্দ কবিতার বিষয়টির চারদিকে আবর্তন করছে। পাতা যেমন গাছের ডাঁটার চারদিকে ঘুরে ঘুরে তাল রেখে ওঠে এও সেইরকম। গাছের বস্তু-পদার্থ তার ডালের মধ্যে, গুঁড়ির মধ্যে, মজ্জাগত হয়ে রয়েছে; কিন্তু তার লাবণ্য, তার চাঞ্চল্য, বাতাসের সঙ্গে তার আলাপ, আকাশের সঙ্গে তার চাউনির বদল, এ সমস্ত প্রধানত তার পাতার ছন্দে।
পৃথিবীর আহ্নিক এবং বার্ষিক গতির মতো কাব্যে ছন্দের আবর্তনের দুটি অঙ্গ আছে, একটি বড়ো গতি, আর একটি ছোটো গতি। অর্থাৎ চাল এবং চলন। প্রদক্ষিণ এবং পদক্ষেপ। দৃষ্টান্ত দেখাই।
শারদ চন্দ্র পবন মন্দ, বিপিন ভরল কুসুমগন্ধ।
এরই প্রত্যেকটি হল চলন। এমন আটটি চলনে এই ছন্দের চাল সারা হচ্ছে। অর্থাৎ, ছয়ের মাত্রায় এ পা ফেলছে এবং আটের মাত্রায় ঘুরে আসছে। “শারদ চন্দ্র’ এই কথাটি ছয় মাত্রার,”শারদ’ তিন এবং “চন্দ্র’ও তিন। বলা বাহুল্য, যুক্ত অক্ষরে দুই অক্ষরের মাত্রা আছে, এই কারণে “শারদ চন্দ্র’ এবং “বিপিন ভরল’ ওজনে একই।
১ ২ ৩ ৪ শারদ চন্দ্র পবন মন্দ, বিপিন ভরল কুসুমগন্ধ, ৫ ৬ ৭ ৮ ফুল্ল মল্লি মালতি যুথি মত্তমধুপ- ভোরনী।
প্রদক্ষিণের মাত্রার চেয়ে পদক্ষেপের মাত্রার পরেই ছন্দের বিশেষত্ব বেশি নির্ভর করছে। কেননা এই আট পদক্ষেপের আবর্তন সকল ছন্দেই চলে। বস্তুত এইটেই হচ্ছে অধিকাংশ ছন্দের চলিত কায়দা। যথা–
১ ২ ৩ ৪ মহাভার- তের কথা অমৃত স- মান, ৫ ৬ ৭ ৮ কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্য- বান্।
এও আট পদক্ষেপ।
এই জাত নির্ণয় করতে হলে চালের দিকে ততটা নয় কিন্তু চলনের দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে। দিলে দেখা যাবে, ছন্দকে মোটের উপর তিন জাতে ভাগ করা যায়। সমচলনের ছন্দ, অসমচলনের ছন্দ এবং বিষমচলনের ছন্দ। দুই মাত্রার চলনকে বলি সমমাত্রার চলন, তিন মাত্রার চলনকে বলি অসমমাত্রার চলন এবং দুই-তিনের মিলিত মাত্রার চলনকে বলি বিষমমাত্রার ছন্দ।
ফিরে ফিরে আঁখি- নীরে পিছু পানে চায়। পায়ে পায়ে বাধা প'ড়ে চলা হল দায়।
এ হল দুই মাত্রার চলন। দুইয়ের গুণফল চার বা আটকেও আমরা এক জাতিরই গণ্য করি।
নয়ন- ধারায় পথ সে হারায়, চায় সে পিছন পানে, চলিতে চলিতে চরণ চলে না, ব্যথার বিষম টানে।
এ হল তিন মাত্রার চলন। আর–
যতই চলে চোখের জলে নয়ন ভ'রে ওঠে, চরণ বাধে, পরান কাঁদে, পিছনে মন ছোটে।
এ হল দুই-তিনের যোগে বিষমমাত্রার ছন্দ।
তাহলেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, চলনের ভেদেই ছন্দের প্রকৃতি-ভেদ।
বৈষ্ণবপদাবলীতে বাংলাসাহিত্যে ছন্দের প্রথম ঢেউ ওঠে। কিন্তু দেখা যায়, তার লীলাবৈচিত্র্য সংস্কৃত ছন্দের দীর্ঘহ্রস্ব মাত্রা অবলম্বন করেই প্রধানত প্রকাশ পেয়েছে। প্রাকৃত বাংলায় যত কবিতা আছে তার ছন্দসংখ্যা বেশি নয়। সমমাত্রার ছন্দের দৃষ্টান্ত–
কেন তোরে আনমন দেখি। কাহে নখে ক্ষিতিতল লেখি।
এ ছাড়া পয়ার এবং ত্রিপদী আছে, সেও সমমাত্রার ছন্দ। অসমমাত্রার অর্থাৎ তিনের ছন্দ চার রকমের পাওয়া যায়–
মলিন বদন ভেল, ধীরে ধীরে চলি গেল। আওল রাইর পাশ। কি কহিব জ্ঞান- দাস॥ ১॥ জাগিয়া জাগিয়া হইল খীন অসিত চাঁদের উদয়দিন ॥ ২॥ সদাই ধেয়ানে চাহে মেঘপানে না চলে নয়ন- তারা। বিরতি আহারে রাঙা বাস পরে যেমত যোগিনী- পারা॥ ৩॥ বেলি অবসান- কালে কবে গিয়াছিলা জলে। তাহারে দেখিয়া ইষত হাসিয়া ধরিলি সখীর গলে॥ ৪॥
বিষমমাত্রার দৃষ্টান্ত কেবল একটা চোখে পড়েছে, সেও কেবল গানের আরম্ভে– শেষ পর্যন্ত টেকেনি।
চিকনকালা, গলায় মালা, বাজন নূপুর পায়। চূড়ার ফুলে ভ্রমর বুলে, তেরছ নয়ানে চায়॥
বাংলায় সমমাত্রার ছন্দের মধ্যে পয়ার এবং ত্রিপদীই সবচেয়ে প্রচলিত। এই দুটি ছন্দের বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, এদের চলন খুব লম্বা। এদের প্রত্যেক পদক্ষেপে আট মাত্রা। এই আট মাত্রার মোট ওজন রেখে পাঠক এর মাত্রাগুলিকে অনেকটা ইচ্ছেমতো চালাচালি করতে পারেন।