৫। “আজি গন্ধবিধুর সমীরণে’ — কবিতাটি সহজ নিয়মেই পড়া উচিত। অবশ্য, এর পঠিত ছন্দে ও গীতছন্দে প্রভেদ আছে।
৬। “জনগণমন-অধিনায়ক’ গানটায় যে মাত্রাধিক্যের কথা বলেছ সেটা অন্যায় বল নি। ঐ বাহুল্যের জন্যে “পঞ্জাব’ শব্দের প্রথম সিলেব্ল্টাকে দ্বিতীয় পদের গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখি —
পন্। জাব সিন্ধু গুজরাট মরাঠা ইত্যাদি।
“পঞ্জাব’কে “পঞ্জব’ করে নামটার আকার খর্ব করতে সাহস হয় নি, ওটা দীর্ঘকায়াদের দেশ। ছন্দের অতিরিক্ত অংশের জন্যে একটু তফাতে আসন পেতে দেওয়া রীতি যা গীতি-বিরুদ্ধ নয়।
এই গেল আমার কৈফিয়তের পালা।
তোমার ছন্দের তর্কে আমাকে সালিস মেনেছে। “লীলানন্দে’র যে-লাইনটা নিয়ে তুমি অভিযুক্ত আমার মতে তার ছন্দঃপতন হয় নি। ছন্দ রেখে পড়তে গেলে কয়েকটি কথাকে অস্থানে খণ্ডিত করতে হয় ব’লেই বোধ হয় সমালোচক ছন্দঃপাত কল্পনা করেছেন। ভাগ করে দেখাই —
নৃত্য। শুধু বি । লানো লা । বণ্য ছন্দ।
আসলে “বিলানো’ কথাটাকে দুভাগ করলে কানে খটকা লাগে।
নৃত্য শুধু লাবণ্যবিলানো ছন্দ
লিখলে কোনোরকম আপত্তি মনে আসে না, অর্থহিসাবেও স্পষ্টতর হয়। ঐ কবিতায় যে-লাইনে তোমার ছন্দের অপরাধ ঘটেছে সেটা এই —
সংগীতসুধা নন্দনে (র) সে আলিম্পনে।
ভাগ করে দেখো —
সংগী । ত সুধা । নন্দ । নের সে আ । লিম্পনে।
যদি লিখতে —
সংগীতসুধা নন্দনেরি আলিম্পনে
তাহলে ছন্দের ত্রুটি হত না।
যাক। তারপরে “ঐকান্তিকা।’ ওটা প্রাকৃত ছন্দে লেখা। সে ছন্দের স্থিতিস্থাপকতা যথেষ্ট। মাত্রার ওজনের একটু-আধটু নড়চড় হলে ক্ষতি হয় না। তবুও নেহাত ঢিলেমি করা চলে না। বাঁধামাত্রার নিয়মের চেয়ে কানের নিয়ম সূক্ষ্ম; বুঝিয়ে বলা বড়ো শক্ত, কেন ভালো লাগল বা লাগল না। “ঐকান্তিকা’র ছন্দটা বন্ধুর হয়েছে সে-কথা বলতেই হবে। অনেক জায়গায় দূরান্বয়ের জন্যে এবং ছন্দের বিভাগে বাক্য বিভক্ত হয়ে গেছে ব’লে অর্থ বুঝতে কষ্ট পেয়েছি। তন্ন তন্ন আলোচনা করতে হলে বিস্তর বাক্য ও কাল-ব্যয় করতে হয়। তাই আমার কান ও বুদ্ধি অনুসরণ করে তোমার কবিতাকে কিছু কিছু বদল করেছি। তুমি গ্রহণ করবে এ আশা করে নয়, আমার অভিমতটা অনুমান করতে পারবে এই আশা করেই।
১ কার্তিক, ১৩৩৬
চিঠিপত্র – ৬ (শ্রীদিলীপকুমার রায়কে লিখিত)
তুমি এমন করে সব প্রশ্ন ফাঁদ যে দুচার কথায় সেরে দেওয়া অসম্ভব হয়, তোমার সম্বন্ধে আমার এই নালিশ।
১। “আবার এরা ঘিরেছে মোর মন’– এই পঙ্ক্তির ছন্দোমাত্রার সঙ্গে “দাহ আবার বেড়ে ওঠে ক্রমে’র মাত্রার অসাম্য ঘটেছে এই তোমার মত। “ক্রমে’ শব্দটার “ক্র’র উপর যদি যথোচিত ঝোঁক দাও তাহলে হিসাবের গোল থাকে না। “বেড়ে ওঠেক্রমে’ — বস্তুত সংস্কৃত ছন্দের নিয়মে “ক্র’ পরে থাকাতে “ওঠে’র “এ’ স্বরবর্ণে মাত্রা বেড়ে ওঠা উচিত। তুমি বলতে পার, আমরা সাধারণত শব্দের প্রথম বর্ণস্থিত র-ফলাকে দুই মাত্রা দিতে কৃপণতা করি। “আক্রমণ’ শব্দের “ক্র’কে তার প্রাপ্য মাত্রা দিই, কিন্তু “ওঠে ক্রমে’র “ক্র’ হ্রস্বমাত্রায় খর্ব করে থাকি। আমি সুযোগ বুঝে বিকল্পে দুইরকম নিয়মই চালাই।
২। ভক্ত । সেথায় । খোলো দ্বা । ০০র্ । এইরকম ভাগে কোনো দোষ নেই। কিন্তু, তুমি যে ভাগ করেছিল । র০০ । এটা চলে না; যেহেতু “র’ হসন্ত বর্ণ, ওর পরে স্বরবর্ণ নেই, অতএব টানব কাকে।
৩। “জনগণ’ গান যখন লিখেছিলেম তখন “মারাঠা’ বানান করি নি। মরাঠিরাও প্রথমবর্ণে আকার দেয় না। আমার ছিল “মরাঠা’। তারপরে যাঁরা শোধন করেছেন তাঁরাই নিরাকারকে সাকার করে তুলেছেন, আমার চোখে পড়ে নি।
৪। “জাগিয়ে’ ও “রটিয়ে’ শব্দের “গিয়ে’ ও “টিয়ে’ প্রাকঁত-বাংলার মতে একমাত্রাই। আমি যদি পরিবর্তন করে থাকি সেটাকে স্বীকার করবার প্রয়োজন নেই।
১০ নভেম্বর, ১৯২৯
চিঠিপত্র – ৭ (শ্রীদিলীপকুমার রায়কে লিখিত)
তুমি যে “ম্লান’ শব্দটিকে হসন্তভাবে উচ্চারণ কর এ আমার কাছে নতুন লাগল। আমি কখনই “ম্লান্’ বলি নে। প্রকৃত-বাংলায় যে-সব শব্দ অতিপ্রচলিত তাদেরই উচ্চারণে এইরকম স্বরলুপ্তি সহ্য করা চলে। “ম্লান’ শব্দটা সে-জাতের নয় এবং ওটা অতি সুন্দর শব্দ, ওকে বিনা দোষে জরিমানা করে ওর স্বরহরণ কোরো না, তোমার কাছে এই আমার দরবার।
যতি বলতে বোঝায় বিরাম। ছন্দ জিনিসটাই হচ্ছে আবৃত্তিকে বিরামের বিশেষ বিধির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা।
ললিত ল । বঙ্গ ল । তা পরি । শীলন।
প্রত্যেক চারমাত্রার পরে বিরাম।
বদসি যদি । কিঞ্চিদপি।
পাঁচ পাঁচ মাত্রার শেষে বিরাম। তুমি যদি লেখ “বদসি যদ্যপি’ তাহলে এই ছন্দে যতির যে পঞ্চায়তি বিধান আছে তা রক্ষা হবে না। এখানে যতিভঙ্গ ছন্দোভঙ্গ একই কথা। প্রত্যেক পদক্ষেপের সমষ্টি নিয়ে নৃত্য, কিন্তু একটিমাত্র পদপাতে যদি চ্যুতি ঘটে তাহলে সে ত্রুটি পদবিক্ষেপের ত্রুটি, সুতরাং সমস্ত নৃত্যেরই ত্রুটি।
৯ শ্রাবণ, ১৩৩৮
চিঠিপত্র – ৮ (শ্রীদিলীপকুমার রায়কে লিখিত)
“তোমারই’ কথাটাকে সাধুভাষার ছন্দেও আমরা “তোমারি’ বলে গণ্য করি। এমন একদিন ছিল যখন করা হত না। আমিই প্রথমে এটা চালাই। “একটি’ শব্দকে সাধুভাষায় তিনমাত্রার মর্যাদা যদি দেও তবে ওর হসন্ত হরণ করে অত্যাচারের দ্বারা সেটা সম্ভব হয়। যদি হসন্ত রাখ তবে দ্বৈমাত্রিক বলে ওকে ধরতেই হবে। যদি মাছের উপর কবিতা লেখার প্রয়োজন হয় তবে “কাৎলা’ মাছকে কা-ত-লা উচ্চারণের জোরে সাধুত্বে উত্তীর্ণ করা আর্যসমাজি শুদ্ধিতেও বাধবে। তুমি কি লিখতে চাও —