৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৪
চিঠিপত্র – ৪ (শ্রীপ্যারীমোহন সেনগুপ্তকে লিখিত)
সংস্কৃত কাব্য-অনুবাদ সম্বন্ধে আমার মত এই যে, কাব্যধ্বনিময় গদ্যে ছাড়া বাংলা পদ্যচ্ছন্দে তার গাম্ভীর্য ও রস রক্ষা করা সহজ নয়। দুটি-চারটি শ্লোক কোনোমতে বানানো যেতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ কাব্যের অনুবাদকে সুখপাঠ্য ও সহজবোধ্য করা দুঃসাধ্য। নিতান্ত সরল পয়ারে তার অর্থটিকে প্রাঞ্জল করা যেতে পারে। কিন্ত, তাতে ধ্বনিসংগীত মারা যায়, অথচ সংস্কৃত কাব্যে এই ধ্বনিসংগীত অর্থসংগীত অর্থসম্পদের চেয়ে বেশি বই কম নয়।
মন্দাক্রান্তা ছন্দের আলোচনা-প্রসঙ্গে প্রবোধ বাঙালির কানের উল্লেখ করেছেন। বাঙালির কান বলে কোনো বিশেষ পদার্থ আছে বলে আমি মানি নে। মানুষেরস্বাভাবিক কানের দাবি অনুসরণ করলে দেখা যায়, মন্দাক্রান্তা ছন্দের চার পর্ব।যথা —
মেঘালোকে। ভবতি সুখিনো । প্যন্যথাবৃৎ। তি চেতঃ।
অর্থাৎ, মাত্রা-হিসাবে আট + সাত + সাত +চার। শেষের চারকে ঠিক চার বলা চলে না। কারণ, লাইনের শেষে একমাত্রা আন্দাজের যতি বিরামের পক্ষে অনিবার্য। এই ছন্দকে বাংলায় আনতে গেলে এই রকম দাঁড়ায় —
দূরে ফেলে গেছ জানি,
স্মৃতির বীণাখানি,
বাজায় তব বাণী
মধুরতম।
অনুপমা, জেনো অয়ি,
বিরহ চিরজয়ী
করেছে মধুময়ী
বেদনা মম।
সংস্কৃতের অমিত্রাক্ষররীতি অনুবর্তন করা যেতে পারে । যথা —
অভাগ্ যক্ষ কবে করিল কাজে হেলা, কুবের তাই তারে দিলেন শাপ,
নির্বাসনে সে রহি প্রেয়সী-বিচ্ছেদে বর্ষ ভরি স’বে দারুণ জ্বালা।
গেল চলি রামগিরি-শিখর-আশ্রমে হারায়ে সহজাত মহিমা তার,
সেখানে পাদপরাজি স্নিগ্ধছায়াবৃত সীতার স্নানে পুত সলিলধারা॥
চিঠিপত্র – ৫ (শ্রীদিলীপকুমার রায়কে লিখিত)
গীতাঞ্জলির কয়েকটি গানের ছন্দ সম্বন্ধে কৈফিয়ত চেয়েছ। গোড়াতেই বলে রাখা দরকার গীতাঞ্জলিতে এমন অনেক কবিতা আছে যার ছন্দোরক্ষার বরাত দেওয়া হয়েছে গানের সুরের ‘পরে। অতএব, যে-পাঠকের ছন্দের কান আছে তিনি গানের খাতিরে এর মাত্রা কম-বেশি নিজেই দুরন্ত করে নিয়ে পড়তে পারেন, যাঁর নেই তাঁকে ধৈর্য অবলম্বন করতে হবে।
১। “নব নব রূপে এসো প্রাণে’– এই গানের অন্তিম পদগুলির কেবল অন্তিম দুটি অক্ষরের দীর্ঘহ্রস্ব স্বরের সম্মান স্বীকৃত হয়েছে। যথা “প্রাণে’ “গানে’ ইত্যাদি। একটিমাত্র পদে তার ব্যতিক্রম আছে। এসো দুঃখে সুখে, এসো মর্মে– এখানে “সুখে’র এ-কারকে অবাঙালি রীতিতে দীর্ঘ করা হয়েছে। “সৌখ্যে’ কথাটা দিলে বলবার কিছু থাকত না। তবু সেটাতে রাজি হই নি, মানুষ চাপা দেওয়ার চেয়ে মোটর ভাঙা ভালো।
২। “অমল ধবল পা- লে লেগেছে মন্দমধুর হাওয়া’– এ গানে গানই মুখ্য, কাব্য গৌণ। অতএব, তালকে সেলাম ঠুকে ছন্দকে পিছিয়ে থাকতে হল। যদি বল, পাঠকেরা তো শ্রোতা নয়, তারা মাপ করবে কেন। হয়তো করবে না — কবি জোড়হাত করে বলবে, “তালদ্বারা ছন্দ রাখিলাম, ত্রুটি মার্জনা করিবেন।’
৩। চৌত্রিশ-নম্বরটাও গান। তবুও এর সম্বন্ধে বিশেষ বক্তব্য হচ্ছে এই যে, যে-ছন্দগুলি বাংলার প্রাকৃত ছন্দ, অক্ষর গণনা করে তাদের মাত্রা নয়। বাঙালি সেটা বরাবর নিজের কানের সাহায্যে উচ্চারণ করে এসেছে। যথা —
বৃষ্টি পড়ে- টাপুর টুপুর, নদেয় এল- বা- ন, শিবু ঠাকুরের বিয়ে- হবে- তিন কন্যে দা- ন।
আক্ষরিক মাত্রা গুনতি করে একে যদি সংশোধন করতে চাও তাহলে নিখুঁত পাঠান্তরটা দাঁড়াবে এই রকম —
বৃষ্টি পড়ছে টাপুর টুপুর, নদেয় আসছে বন্যা, শিবু ঠাকুরের বিবাহ হচ্ছে, দান হবে তিন কন্যা।
রামপ্রসাদের একটি গান আছে —
মা আমায় ঘুরাবি কত যেন। চোখবাঁধা বলদের মতো।
এটাকে যদি সংশোধিত মাত্রায় কেতাদুরস্ত করে লিখতে চাও তাহলে তার নমুনা একটা দেওয়া যাক–
হে মাতা আমারে ঘুরাবি কতই চক্ষুবদ্ধ বৃষের মতোই।
একটা কথা তোমাকে মনে রাখতে হবে, বাঙালি আবৃত্তিকার সাধুভাষা-প্রচলিত ছন্দেও নিজের উচ্চারণসম্মত মাত্রা রাখে নি বলে ছন্দের অনুরোধে হ্রস্বদীর্ঘের সহজ নিয়মের সঙ্গে রফানিষ্পত্তি করে চলেছে। যথা–
মহাভারতের কথা অমৃতসমান,
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান্।
উচ্চারণ-অনুসারে “মহাভারতের কথা’ লিখতে হয় “মহাভারতের্কথা’, তেমনি “কাশীরাম দাস কহে’ লেখা উচিত “কাশীরাম দাস্কহে’। কারণ, হসন্ত শব্দ পরবর্তী স্বর বা ব্যঞ্জন শব্দের সঙ্গে মিলে যায়, মাঝখানে কোনো স্বরবর্ণ তাদের ঠোকাঠুকি নিবারণ করে না। কিন্তু, বাঙালি বরাবর সহজেই “মহাভারতে- র্কথা’ পড়ে এসেছে, অর্থাৎ “তে’র এ-কারকে দীর্ঘ করে আপসে মীমাংসা করে দিয়েছে। তারপরে “পুণ্যবান্’ কথাটার “পুণ্যে’র মাত্রা কমিয়ে দিতে সংকোচ করে নি, অথচ “বান’্ কথাটার আক্ষরিক দুই মাত্রাকে টান এবং যতির সাহায্যে চার মাত্রা করেছে।
৪। “নিভৃত প্রাণের দেবতা’ — এই গানের ছন্দ তুমি কী নিয়মে পড় আমি ঠিক বুঝতে পারছি নে। “দেবতা’ শব্দের পরে একটা দীর্ঘ যতি আছে, সেটা কি রাখ না। যদি সেই যতিকে মান্য করে থাক তাহলে দেখবে, “দেবতা’ এবং “খোলো দ্বার’ মাত্রায় অসমান হয় নি। এসব ধ্বনিগত তর্ক মোকাবিলায় মীমাংসা করাই সহজ। লিখিত বাক্যের দ্বারা এর শেষ সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হবে কিনা জানি নে। ছাপাখানা-শাসিত সাহিত্যে ছন্দোবিলাসী কবির এই এক মুশকিল– নিজের কণ্ঠ স্তব্ধ, পরের কণ্ঠের করুণার উপর নির্ভর। সেইজন্যেই আমাকে সম্প্রতি এমন কথা শুনতে হচ্ছে যে, আমি ছন্দ ভেঙে থাকি, তোমাদের স্তুতিবাক্যের কল্লোলে সেটা আমার কানে ওঠে না। তখন আকাশের দিকে চেয়ে বলি, “চতুরানন, কোন্ কানওয়ালাদের’পরে এর বিচারের ভার।’