পূর্বপত্রেই লিখিয়াছি, বাংলা চলতি ভাষার ধ্বনিটা হসন্তের সংঘাত-ধ্বনি, এইজন্য ধ্বনিহিসাবে সংস্কৃতের চেয়ে ইংরেজির সঙ্গে তাহার মিল বেশি। তাই এই চলতি ভাষার ছন্দে মাত্রাবিভাগ বিচিত্র। বাংলা-প্রাকৃতের একটা চৌপদী নিচে লিখিলাম।–
কই পালঙ্ক, কই রে কম্বল,
কপ্নি-টুকরো রইল সম্বল,
এক্লা পাগ্লা ফির্বে জঙ্গল,
মিট্বে সংকট ঘুচ্বে ধন্দ।
ইহার সঙ্গে Ah distinctly I remember শ্লোকটি মিলাইয়া দেখিলে দেখা যাইবে, ধ্বনির বিশেষ কোনো তফাত নাই।
ইহার সাধু পাঠ এইরূপ–
শয্যা কই বস্ত্র কই,
কী আছে কৌপীন বই,
একা বনে ফিরে ঐ,
নাহি মনে ভয় চিন্তা।
সাধু ও অসাধুর মাত্রাভাগ নিচে নিচে লিখিলাম, মিলাইয়া দেখিবেন।–
১ ২ ৩ ৪ ১ ২ ৩ ৪
কই। পা। লঙ্। ক । । কই। রে। কম্। বল্ । ।
শ। য্যা। ক। ই । । বস্। ত্র। ক। ই । ।
১ ২ ৩ ৪ ১ ২ ৩ ৪
কপ। নি। টুক্। রো । । রই । ল। সম্। বল্ । ।
কী। আ। ছে। কৌ ॥ পী । ন। ব। ই ॥
১ ২ ৩ ৪ ১ ২ ৩ ৪
এক্। লা। পাগ্। লা । । ফির্। বে। জঙ্। গল্ । ।
এ। কা। ব। নে । । ফি । রে। ও। ই । ।
সাধুভাষার ছন্দটি যেন মোটা মোটা ফাঁকওয়ালা জালের মতো, আর অসাধুটির একেবারে ঠাসবুনানি।
ইংরেজিতে সমমাত্রার ছন্দ অনেক আছে, তাহার একটি দৃষ্টান্ত পূর্বেই দিয়াছি। অসম মাত্রা অর্থাৎ তিন মাত্রার দৃষ্টান্ত। যথা —
১ ২ ৩ ১ ২ ৩
। more । un। । for। । tu। nate । ।
১ ২ ৩ ১ ২ ৩
। ry। of। । breath — — । ।
শেষ হয়। একটি মনে পড়িতেছে।–
১ ২ ৩ ৪ ৫
। we । two। lar। ted । ।
১ ২ ৩ ৪ ৫
(In) si। lence। and। tears। — ।
১ ২ ৩ ৪ ৫
। bro। ken। heart। ed।
১ ২ ৩ ৪ ৫
(To) se। ver। for। years । — ।
এই শ্লোকটির দুই লাইনকে মিলাইয়া এক লাইন করিয়া পড়িলে ইহার ছন্দকে তিন মাত্রায় ভাগ করিয়া পড়া সহজ হয়। কিন্তু বিষম মাত্রার লয়ে ইহাকে পড়িলে চলেবলিয়াই এই দৃষ্টান্তটি প্রয়োগ করিয়াছি, বোধ করি এরূপ দৃষ্টান্ত ইংরেজি ছন্দে দুর্লভ।
দেখা গিয়াছে ইংরেজি ছন্দে ঝোঁক পদের আরম্ভেও পড়িতে পারে, পদের শেষেওপড়িতে পারে। আরম্ভে, যেমন–
। ।
। dreary moorland।
। ।
। barren shore।
পদের শেষে, যেমন–
। ।
। । the news is true
। ।
। । he’s well । ।
বাংলায় আরম্ভে ছাড়া পদের আর-কোথাও ঝোঁক পড়িতে পারে না।
। । । ।
একলা পাগলা ফিরবে জঙ্গল
কিম্বা–
। ।
একলা পাগলা ফিরবে জঙ্গল
এমনটি হইবার জো নাই।
আমার কথাটি ফুরালো। ইংরেজি ছন্দকে আমি বাংলা ছন্দের রীতি-অনুসারে ভাগ করিয়া দেখিয়াছি, সেটা ভালো হইল কিনা জানি না। ইংরেজি ছন্দতত্ত্ব আমার একদম জানা নাই বলিয়াই বোধ করি এরূপ দুঃসাহস আমার পক্ষে সহজ হইয়াছে।fool দের কোথাও বাধা নাই। এরূপ সতর্কতায় সকল সময়েই যে এঞ্জেলরা জেতেন তাহা নহে, অনেক সময়েই ঠকিয়া থাকেন; অবুঝ হঠকারিতায় অপর পক্ষের কখনো কখনো জিত হইবার সম্ভাবনা আছে, এই আমার ভরসা। আপনার পক্ষে বোঝা সহজ হইতে পারে বলিয়াই আমি ইংরেজি দৃষ্টান্তগুলি ব্যবহার করিয়াছি, ইহাতে আমার বিদ্যা প্রকাশ না হইয়া বিদ্যা ফাঁস হইয়া যাইতে পারে।
১৮ আষাঢ়, ১৩২১
চিঠিপত্র – ৩ (শ্রীপ্রমথ চৌধুরীকে লিখিত)
চলতি কথায় একটা লম্বা ছন্দের কবিতা লিখেছি। এটা কি পড়া যায় কিম্বা বোঝা যায় কিম্বা ছাপানো যেতে পারে। নাম-রূপের মধ্যে রূপটা আমি দিলুম, নাম দিতে হয় তুমি দিয়ো। …
যারা আমার সাঁঝ-সকালের গানের দীপে জ্বালিয়ে দিলে আলো
আপন হিয়ার পরশ দিয়ে, এই জীবনের সকল সাদা-কালো
যাদের আলো-ছায়ার লীলা, বাইরে বেড়ায় মনের মানুষ যারা
তাদের প্রাণের ঝরনাস্রোতে আমার পরান হয়ে হাজার-ধারা
চলছে বয়ে চতুর্দিকে। কালের যোগে নয় তো মোদের আয়ু–
নয় সে কেবল দিবস-রাতির সাতনলি হার, নয় সে নিশাসবায়ু।
নানান প্রাণের প্রেমের মিলে নিবিড় হয়ে আত্মীয়ে বান্ধবে
মোদের পরমায়ুর পাত্র গভীর ক’রে পূরণ করে সবে।
সবার বাঁচায় আমার বাঁচা আপন সীমা ছাড়ায় বহুদূরে,
নিমেষগুলির ফল পেকে যায় বিচিত্র আনন্দরসে পূরে;
অতীত হয়ে তবুও তারা বর্তমানের বৃন্তদোলায় দোলে–
গর্ভ হতে মুক্ত শিশু তবুও যেমন মায়ের বক্ষে কোলে
বন্দী থাকে নিবিড় প্রেমের বাঁধন দিয়ে। তাই তো যখন শেষে
একে একে আপন জনে সূর্য-আলোর অন্তরালের দেশে
আঁখির নাগাল এড়িয়ে পালায়, তখন রিক্ত শীর্ণ জীবনময়
শুষ্ক রেখায় মিলিয়ে আসে বর্ষাশেষের নির্ঝরিণীসম
শূন্য বালুর একটি প্রান্তে ক্লান্তবারি স্রস্ত অবহেলায়।
তাই যারা আজ রইল পাশে এই জীবনের অপরাহ্ন-বেলায়
তাদের হাতে হাত দিয়ে তুই গান গেয়ে নে থাকতে দিনের আলো–
বলে নে ভাই, “এই যা দেখা, এই যা ছোঁওয়া, এই ভালো, এই ভালো।
এই ভালো আজ এ-সংগমে কান্নাহাসির গঙ্গাযমুনায়
ঢেউ খেয়েছি, ডুব দিয়েছি, ঘট ভরেছি, নিয়েছি বিদায়।
এই ভালো রে প্রাণের রঙ্গে এই আসঙ্গ সকল অঙ্গে মনে
পুণ্য ধরার ধুলো মাটি ফল হাওয়া জল তৃণ তরুর সনে।
এই ভালো রে ফুলের সঙ্গে আলোয় জাগা, গান-গাওয়া এই ভাষায়,
তারার সাথে নিশীথ-রাতে ঘুমিয়ে-পড়া নূতন প্রাতের আশায়।”
এই জাতের সাধু ছন্দে আঠারো অক্ষরের আসন থাকে। কিন্তু, এটাতে কোনোকোনো লাইনে পঁচিশ পর্যন্ত উঠেছে। ফার্স্ট ক্লাসের এক বেঞ্চিতে ছ-জনের বেশি বসবার হুকুম নেই কিন্তু থার্ড ক্লাসে ঠেসাঠেসি ভিড়, এ সেইরকম। কিন্তু, যদি এটা ছাপাও তাহলে লাইনে ভেঙো না, তাহলে ছন্দ পড়া কঠিন হবে।||||||