ওরে বংশীবট, অক্ষয় বট, কোথা রে তমাল বন!
ওরে বৃন্দাবনের তরুলতা শুকায়েছে কি কারণ!
ওরে শ্যামকুঞ্জ, রাধা কুঞ্জ, কোথা গিরি গোবর্ধন!
গ্রন্থ হইতে একটি গান উদ্ধৃত করিয়া আমাদের বক্তব্যের উপসংহার করি।
ঐ বুঝি এসেছি বৃন্দাবন।
আমায় বলে দে রে নিতাই ধন॥
ওরে বৃন্দাবনের পশুপাখীর রব শুনি না কি কারণ!
কেন এ বিলাপ! এ বৃন্দাবনের মধ্যে সে বৃন্দাবন নাই বলিয়া। বর্তমানের সহিত অতীতের একেবারে বিচ্ছেদ হইয়াছে বলিয়া! তা যদি না হইত, আজ যদি সেই কুঞ্জের একটি লতাও দৈবাৎ চোখে পড়িত, তবে সেই ক্ষীণ লতাপাশের দ্বারা পুরাতন বৃন্দাবনের কত মাধুরী বাঁধা দেখিতে পাইতাম! আমাদের হৃদয়ের কত তৃপ্তি হইত!
স্ত্রী শিক্ষা বিষয়ক আপত্তি খণ্ডন।–
কালীকচ্ছের কোনো পণ্ডিত স্ত্রীশিক্ষা সম্বন্ধে কতকগুলি আপত্তি উত্থাপিত করায় কালীকচ্ছ সার্বজনিক সবান্তর্গত স্ত্রীশিক্ষা বিভাগের সম্পাদিকা শ্রীমতী গুণময়ী– সেই আপত্তি সকল খণ্ডন করিয়া উল্লিখিত পুস্তিকাখানি রচনা করিয়াছেন।
পণ্ডিত মহাশয় যে আটটি আপত্তি উত্থাপন করিয়াছেন, তাহার দারুণ গুরুত্ব পাঠকদিগকে অনুভব করাইবার জন্য আমরা নিম্নে সমস্তগুলিই উঠাইয়া দিলাম।
আপত্তি।
১। স্ত্রীলোকের বিদ্যাশিক্ষার আবশ্যক কী? শিখিলে উপকার কী?
২। স্ত্রীলোকে লেখাপড়া শিখিলে অন্ধ হয়।
৩। স্ত্রীলোকে লেখাপড়া শিখিলে বিধবা হয়।
৪। স্ত্রীলোকের, লেখাপড়া শিখিলে, সন্তান হয় না।
৫। স্ত্রীলোক শিক্ষিতা হইলে, অবিনীতা, লজ্জাহীনা ও অকর্মণ্যা হয়।
৬। লেখাপড়া করিয়া কি মেয়েরা চাকুরি করিবে না জমিদারি মহাজনী করিবে?
৭। মেয়ে লেখাপড়া না শিখিলে কী ক্ষতি আছে।
৮। বিদ্যাশিক্ষায় নারীগণের চরিত্র দোষ জন্মে?
আপত্তিগুলির অধিকাংশই এমনতর যে একজন বালিকার মুখেও শোভা পায় না– পণ্ডিতের মুখে যে কিরূপ সাজে তাহা সকলেই বুঝিবেন। শ্রীমতী গুণময়ী যে আপত্তিগুলি অতি সহজেই খণ্ডন করিয়াছেন তাহা ইহার পর বলা বাহুল্য।
ভাষাশিক্ষা–
গ্রন্থকারের নাম নাই। গ্রন্থকর্তা নিজেই লিখিয়াছেন যে এই পুস্তকখানি ইংরাজি প্রণালী অনুসারে লিখিত, বাস্তবিকই তাহা সত্য। আজকাল “A Higher English Grammar, by Bain.” “Studies in English” by W.Mc. Mordie, Translation and Retranslation by Gangadhor Banerjee, প্রভৃতি যে-সকল পুস্তক এন্ট্রেন্স পরীক্ষার্থী বালক মাত্রেই পড়িয়া থাকেন, বলা বাহুল্য যে এই পুস্তকগুলির সম্পূর্ণ সাহায্য গ্রহণ করিয়া এই পুস্তকখানি রচিত হইয়াছে। পুস্তকখানি পাঠে, লেখকের ভাষা শিক্ষা দিবার সুরুচি দেখিয়া আমরা সন্তুষ্ট হইয়াছি। ইঁহার সহিত আমাদের অনেকগুলি মতের ঐক্য হইয়াছে, এবং সে মতগুলি সুরুচিসংগত জ্ঞান করি। আমাদিগের বিশ্বাস যে পুস্তকখানি পাঠে ব্যাকরণজ্ঞ বালকদিগের উপকার জন্মিতে পারে।
ভারতী, ভাদ্র, আশ্বিন, ১২৯১
গ্রন্থসমালোচনা – ০৮
লালা গোলোকচাঁদ। পারিবারিক নাটক। শ্রীসুরেন্দ্রচন্দ্র বসু।
নাটকটি অসম্ভব আতিশয্যে পরিপূর্ণ। সমস্তটা একটা ভেলকির মতো। কতকগুলি অদ্ভুত ভালো লোক এবং অদ্ভুত মন্দ লোক একটা অদ্ভুত সমাজে যথেচ্ছা অদ্ভুত কাজ করিয়া যাইতেছে, মাথার উপরে একটা বুদ্ধিমান অভিভাবক কেহ নাই। স্থানে স্থানে লেখকের পারিবারিক চিত্ররচনার ক্ষমতা প্রকাশ পাইয়াছে। তীর্থযাত্রাকালে বৃদ্ধ কর্তা-গিন্নির গৃহত্যাগের দৃশ্য গ্রন্থের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট অংশ।
দেহাত্মিক-তত্ত্ব। ডাক্তার সাহা প্রণীত।
এই গ্রন্থে শ্রীদর্শন রাজচক্রবর্তী নামক একব্যক্তি গুরুর আসনে উপবিষ্ট। ভোলানাথ দাস নামক এক ব্যক্তি তাঁহার উপযুক্ত শিষ্য। উভয়ের মধ্যে কথোপকথন চলিতেছে। গুরুজি রূপকচ্ছলে জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিতেছেন– শিষ্য সেই উপদেশ শুনিয়া কৃতার্থ হইতেছেন। দেহ-মন ও জগতের শক্তি সকলকে দেব-দেবী রূপে কল্পনা করিয়া জগৎ-ব্রহ্মবাদের ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। “যোগাকর্ষণ-দেব” “মাধ্যাকর্ষণ-দেব” “রসায়ন-দেব” “মস্তিষ্কাদেবী” প্রভৃতি দেব-দেবীর অবতারণা করা হইয়াছে। গ্রন্থের সার মর্ম এই যে, ব্রহ্ম কতকটা দৈহিকভাবে ও কতকটা আত্মিকভাবে আত্মস্বরূপ প্রকাশ করিয়াছেন। এবং সকল ধর্মের মধ্যেই কতকটা দৈহিক ও কতকটা আত্মিক ভাব বিদ্যমান। উপদেশের কিঞ্চিত নমুনা নিম্নে দেওয়া যাইতেছে।
“বলি, মস্তিষ্কা দেবি! আপনার কয়টি পুত্র ও কয়টি কন্যা আমায় বলিবেন কি?”
“ভোলানাথ! তুমি কী নিমিত্ত এরূপ প্রশ্ন করিতেছ? তোমার সাধ্য নয় যে, তুমি এ সকল বুঝিতে পার। এই দেখো, আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা, ইহার নাম স্পর্শ সত্তা বা ত্বক্, এই আমার দ্বিতীয় কন্যা, রসনা। এই আমার প্রথম পুত্র নয়ন, দ্বিতীয় পুত্র শ্রবণ, এই আমার তৃতীয় কন্যা নাসিকা” ইত্যাদি। গ্রন্থের “দৈহিক ভাবটি” অতি পরিপাটি। গ্রন্থের আত্মিক ভাব বুঝিবার জন্য ভোলানাথের ন্যায় সমজদার ব্যক্তির আবশ্যক। যাহা হউক, আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এইটুকু বুঝিতে পারি, এই গ্রীষ্মপ্রধান দেশে “মস্তিষ্কা দেবী” কে বিবিধ শৈত্য-উপচারে ঠাণ্ডা রাখা কর্তব্য।
সাধনা, ফাল্গুন, ১২৯৮
গ্রন্থসমালোচনা – ০৯
সংগ্রহ। শ্রীনগেন্দ্রনাথ গুপ্ত।
গ্রন্থখানি ছোটো ছোটো গল্পের সমষ্টি। ইহার অধিকাংশ গল্পই সুপাঠ্য। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় ইহাই লেখকের পক্ষে যথেষ্ট প্রশংসার বিষয় নহে। যিনি “শ্যামার কাহিনী” লিখিতে পারেন তাঁহার নিকট হইতে কেবলমাত্র কৌতূহল অথবা বিস্ময়জনক গল্প আমরা প্রত্যাশা করি না। “শ্যামার কাহিনী” গল্পটি আদ্যোপান্ত জীবন্ত এবং মূর্তিমান, ইহার কোথাও বিচ্ছেদ নাই। অন্য গল্পগুলিতে লেখকের নৈপুণ্য থাকিতে পারে কিন্তু এই গল্পেই তাঁহার প্রতিভার পরিচ পাওয়া যায়।