উক্ত গ্রন্থকার-রচিত দুই-চারিখানি গীতিনাট্য আমরা সমালোচনার্থ পাইয়াছি। গীতগুলি রাগ-রাগিণী সংযোগে গাহিলে কিরূপ শুনায় বলিতে পারি না, কিন্তু পড়িতে ভালো লাগিল না।
ভারতী, বৈশাখ, ১২৮৯
গ্রন্থসমালোচনা – ০৪
বনবালা। ঐতিহাসিক উপন্যাস। মূল্য বারো আনা।
এই ঐতিহাসিক উপন্যাসে না আছে ইতিহাস,না আছে উপন্যাস। নভেলের সমস্ত কাঠ-খড় আনা হইয়াছে, কেবল মূর্তি গড়া হয় নাই।
হরবিলাপ। শ্রীরাধানাথ মিত্র কর্তৃক প্রকাশিত। মূল্য চারি আনা।
এই গীতিনাট্যখানিতে কতকগুলি সুন্দর গান আছে। পড়িতেই যখন ভালো লাগিতেছে,তখন সুর-সংযোগে শুনিলে আরও ভালো লাগিবার কথা। এই গ্রন্থখানি অভিনয়ের যোগ্য কি না বলিতে পারি না, কারণ ইহাতে উপাখ্যান ভাগ কিছুই নাই বলিলেও হয়, কিন্তু গ্রন্থখানি পাঠের যোগ্য ও গানগুলি গাহিবার যোগ্য সন্দেহ নাই।
কমলে কামিনী বা ফুলেশ্বরী । শ্রীরাধানাথ মিত্র প্রণীত ও প্রকাশিত । মূল্য চারি আনা ।
এই গীতিনাট্যখানি পড়িতে তেমন ভালো লাগিল না । কমলে-কামিনী দেখিয়া শ্রীমন্ত যে গান গাহিয়া উঠিয়াছে, সেই গানটিই পুস্তকের মধ্যে ভালো লাগিল ।
কল্পনা-কুসুম । শ্রীমতী কামিনী সুন্দরী দেবী-কর্তৃক বিরচিত । মূল্য আট আনা ।
এই গ্রন্থখানি পড়িয়া স্পষ্টই মনে হয়, লেখিকার কবিত্ব শক্তি আছে । “অভাগিনীর বিলাপ” “নারদ” প্রভৃতি কতকগুলি যথার্থ কবিতা এই গ্রন্থে প্রকাশিত হইয়াছে ।
কবিতাবলী। প্রথম ভাগ। শ্রীরামনারায়ণ অগস্তি প্রণীত মূল্য দশ আনা।
কবিতাবলীর এই প্রথম ভাগ দেখিয়া দ্বিতীয় ভাগ দেখিবার আর বাসনা রহিল না । যে বন্ধু গ্রন্থকারকে এই কবিতাগুলি ছাপাইতে অনুরোধ করিয়াছিলেন তিনি বাস্তবিকই বন্ধুর মতো কাজ করেন নাই ।
কুসুমারিন্দম । শ্রীইন্দ্রনারায়ণ পাল প্রণীত । মূল্য ১ টাকা ।
এই উপন্যাসখানি পড়িয়া আমরা বিস্মিত হইলাম । ইহার আদ্যোপান্ত একটা ঘোরতর বিশৃঙ্খল গোলমাল । ইহার অনেক জায়গায় বাস্তবিকই লেখকের ছেলেমানুষী প্রকাশ পাইয়াছে, আবার স্থানে স্থানে লেখকের ক্ষমতা ব্যক্ত হইয়াছে ।
ভারতী, ভাদ্র, ১২৮৯
গ্রন্থসমালোচনা – ০৫
সমালোচক কাব্য । মূল্য এক আনা ।
সমালোচনা স্থলে ভারতী বর্তমান গ্রন্থকারের কোনো একটি কাব্যকে ভালো বলেন নাই, এই অপরাধে ভারতীকে আক্রমণ করিয়া এই গ্রন্থখানি লিখিত হইয়াছে । কিন্তু এই কাব্যখানি পড়িয়া তাঁহার পূর্বতন গ্রন্থ সম্বন্ধে আমাদের মতের কিছুমাত্র পরিবর্তন হইল না। এই লেখার দরুন পাঠকদিগের নিকটেও যে তাঁহার পূর্বগ্রন্থের বিশেষ আদর বাড়িবে, তাহাও নহে। তবে লিখিয়া ফল কী হইল ? লেখক কি মনে বড়ো আনন্দ উপভোগ করিতেছেন ? তবে তাহাই করুন, তাহাতে আমরা ব্যাঘাত দিব না ।
কথাটা এই যে, নিজের লেখা ভালো বলিয়া লেখকের দৃঢ় বিশ্বাস থাকিতে পারে, তাহা লইয়া কেহ তাঁহার সহিত বিবাদ করিবে না, কিন্তু সমালোচকেরও যে সে বিষয় তাঁহার সহিত মতের সম্পূর্ণ ঐক্য হইয়া যাইবে এরূপ আশা করাটা কিছু অতিরিক্ত হয় । আমাদের মতে অনর্থক গালিমন্দ দেওয়া বা ঠাট্টা বিদ্রূপ করা সমালোচকের কর্তব্য কাজ নহে । কিন্তু যে সমালোচক কোনো প্রকার অভদ্রাচরণ না করিয়া শুদ্ধ মাত্র নিজের মত ব্যক্ত করিয়াছেন, তাঁহার সহিত লেখকের ঝগড়া করা ভালো দেখায় না । সমালোচকের কাজটা দেখিতেছি, ঘরের কড়ি খরচ করিয়া বনের মহিষ তাড়ানো , মাঝে মাঝে গুঁতাটাও খাইতে হয় ।
তৃণপুঞ্জ । শ্রীজ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ বিরচিত । মূল্য আট আনা ।
ইহা একখানি কাব্যগ্রন্থ । মনে হয় যেন,ইহার অনেকগুলি কবিতাতে লেখকের যাহা মনে আসিয়াছে তাহাই লিখিয়াছেন ; তাহার একটা বিশেষ ভাব নাই, একটা দাঁড়াইবার স্থান নাই, একটা উদ্দেশ্য নাই– অথচ তাহার একটা নাম আছে ও তাহার সহিত মিল বা অমিল বিশিষ্ট, বাংলায় বা বিকৃত বাংলায় লিখিত কয়েকটি ছত্র সংলগ্ন আছে । তবে, স্থানে স্থানে কবিত্বের রেখা পড়ে, কিন্তু আবার তখনি মুছিয়া যায়– কবিত্বে সমস্ত ছত্রগুলি ভরিয়া উঠে না, কঠিন ও বিকৃত ভাষার উৎপীড়নে ও ভাবের অভাবে কল্পনা ক্লিষ্ট হইয়া পড়ে । লেখক অনেক স্থলে অনেক ইংরাজি ভাব বাংলায় আনিতে চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা দোষের কথা নহে , কিন্তু তিনি ইংরাজিকে বাংলা করিতে পারেন নাই , মাঝের হইতে বাংলাকে কেমন ইংরাজি করিয়া তুলিয়াছেন। এই গ্রন্থ পড়িয়া স্পষ্ট বুঝা যায়, লেখক বাংলায় কবিতা লিখিতে নূতন প্রবৃত্ত হইয়াছেন। এই নিমিত্ত এখনো তাঁহার ভাবের প্রবাহ উন্মুক্ত হয় নাই, এখনো তিনি প্রতিকূল ভাষাকে আপনার অনুকূল করিয়া লইতে পারেন নাই, ভাষা তাঁহাকে অপরিচিত দেখিয়া তাঁহার ভাবগুলির প্রতি ভালোরূপ আতিথ্য-সৎকার করিতেছে না । দেখা যাউক ভবিষ্যতে কী হয় ।
শান্তি-কুসুম। শ্রীবিহারীলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ।
বিষয়টা কিছুই নহে, লিখিবার যোগ্যই নয় । বোধ করি গ্রন্থখানি ব্যক্তিবিশেষের জন্য লিখিত, সাধারণের জন্য লেখা হয় নাই । সুতরাং এ গ্রন্থ সমালোচনা করিবার কোনো আবশ্যক দেখিতেছি না । তবে প্রসঙ্গক্রমে বলিতেছি, লেখাটি বড়ো ভালো হইয়াছে । বাংলা ভাষাটি অবিকল বজায় আছে । আধুনিক গ্রন্থগুলি পড়িতে পড়িতে এ গ্রন্থখানি সহসা পড়িলে ইহার ভাষা দেখিয়া কিছু আশ্চর্য বোধ হয় । কিন্তু ইহার আর কোনো গুণ নাই ।