নির্ঝরিণী। (গীতি কাব্য) প্রথম খণ্ড। শ্রীদেবেন্দ্রনাথ সেন প্রণীত। মূল্য আট আনা।
এই কাব্যগ্রন্থখানিতে “আঁখির মিলন” প্রভৃতি দুই-একটি সুন্দর কবিতা আছে, কিন্তু সাধারণত সমস্ত কবিতাগুলি তেমন ভালো নহে।
রাজা-উদাসীন। প্রথম স্তবক। শাক্য সিংহ ও রামমোহন রায়। শ্রীদেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী কর্তৃক প্রকাশিত। মূল্য চারি আনা মাত্র।
এই ক্ষুদ্র কাব্যখানি স্থানে স্থানে বর্ণনা উত্তম হইয়াছে । কিন্তু বিষয়টি যেরূপ গুরুতর তদুপযুক্ত রচনা হয় নাই। বুদ্ধদেব বা রামমোহন রায়ের স্বগত-উক্তি ও কথোপকথনগুলি উপদেশ-প্রবাহের ন্যায় শুনায়, তাহার সহিত কল্পনা-মিশ্রিত করিয়া তাহাকে কবিতা করিয়া তোলা হয় নাই। কাব্যখানি পড়িয়া মনে হয়, লেখক তাঁহার বিষয়ের মহান ভাব যতটা কল্পনা করিতে পারিয়াছেন, ততটা প্রকাশ করিতে পারেন নাই।
ভারতী, ফাল্গুন, ১২৮৮
গ্রন্থসমালোচনা – ০৩
জন্ স্টুয়ার্ট মিলের জীবনবৃত্ত। শ্রীযোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ এম্ এ বিরচিত। মূল্য একটাকা চার আনা মাত্র।
ইতালীর ইতিবৃত্ত সম্বলিত ম্যাট্সিনির জীবন-বৃত্ত। শ্রীযোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ এম্ এ বিরচিত। মূল্য একটাকা চার আনা মাত্র।
এই গ্রন্থ দুইখানি বহুকাল হইল, প্রকাশিত হইয়াছে, আমরা সম্প্রতি সমালোচনার্থে পাইয়াছি। যদি কোনো পাঠক আজিও এ গ্রন্থদ্বয়ের পরিচয় না পাইয়া থাকেন, তবে তাঁহাদের অনুরোধ করি, এ দুইখানি পুস্তক ক্রয় করিয়া পাঠ করিবেন। ইহার পূর্বে ভালো জীবনবৃত্ত বঙ্গভাষায় প্রচারিত হয় নাই। যোগেন্দ্রবাবু এ বিষয়ে পথ দেখাইয়া বঙ্গসাহিত্যের যথার্থ উপকার করিয়াছেন। আমাদের মতে এই দুইখানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থের মধ্যে ম্যাট্সিনির জীবনবৃত্ত উৎকৃষ্টতর। তাহার দুই কারণ আছে– প্রথম, ম্যাট্সিনির জীবনবৃত্তে গ্রন্থের নায়কের সহিত লেখকের জ্বলন্ত সমবেদনা প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত সমভাবে প্রকাশ পাইতেছে; লেখক হৃদয়-লেখনী দিয়া সমস্ত পুস্তকখানি লিখিয়াছেন ,এই নিমিত্ত পাঠকদের হৃদয়ের পত্রে তাহার মুদ্রাঙ্কন পড়িয়াছে। দ্বিতীয়,প্রথম পুস্তকখানি মস্তিষ্ক ও জ্ঞান চর্চার বিবরণ, দ্বিতীয় পুস্তকখানি হৃদয় ও কার্যের কাহিনী, সুতরাং বিষয়ের গুণে শেষ গ্রন্থটি অধিকতর মনোরম হইয়াছে ।
হৃদয়োচ্ছাস,বা ভারত বিষয়ক প্রবন্ধাবলি। শ্রীযোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ এম্ এ প্রণীত। মূল্য ১টাকা।
আজকাল অনেকগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাসিক পত্র বাহির হইয়াছে। এই নিমিত্ত বঙ্গদেশের লেখকের সংখ্যা অল্প হইলেও লেখার আবশ্যক অত্যন্ত বাড়িয়া উঠিয়াছে, সুতরাং সাহিত্যসমাজে অত্যন্ত চুরির প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। সমালোচ্য গ্রন্থখানির বিজ্ঞাপনে দেখিতেছি, যোগেন্দ্রবাবুর আর্যদর্শনে প্রকাশিত অনেকগুলি প্রবন্ধ এইরূপ চুরি যায়; চোরের হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য আর্যদর্শন-সম্পাদক তাঁহার ভারত-বিষয়ক প্রবন্ধগুলি পুস্তকাকারে মুদ্রিত করিয়াছেন। অনেকগুলি প্রবন্ধে লেখকের চিন্তাশীলতার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু যথার্থ কথা বলিতে কি, প্রাচীন ভারতের উন্নতি লইয়া গর্ব, আধুনিক ভারতের অবনতি লইয়া দুঃখ,ঐক্যের অভাব লইয়া বিলাপ, বদ্ধপরিকর হইবার জন্য উত্তেজনা এত শুনা গিয়াছে যে, ও বিষয়ে শুনিবার আর বাসনা নাই। শুনিয়া যত দূর হইতে পারে তাহা এত দিনে হইয়াছে বোধ করি, বরঞ্চ ভাবগতিকে বোধ হয় মাত্রা অধিক হইয়া গিয়াছে। না যদি হইয়া থাকে তো আশ্চর্য বলিতে হইবে। ভারতের বিষয়ে কতকগুলো বিলাপ ও উদ্দীপন বাক্য উচ্চারণ করিবার কাল চলিয়া গিয়াছে। যখন দেশানুরাগের ভাব মাত্র লোকে জানিত না, তখন তাহা উপযোগী ছিল। ভারতের যে পূর্বে উন্নতি ছিল ও এখন যে অবনতি হইয়াছে, ভারতের উন্নতি সাধন করিতে সকলের যে সম্মিলিত হওয়া উচিত এ বিষয়ে বঙ্গীয় পাঠকমাত্রেই এতবার শুনিয়াছেন, যে, এ বিষয় বোধ করি কাহারো জ্ঞানের অগোচর নাই। অতএব আর অধিক নহে। “ঐক্য” “উন্নতি” “বন্ধন” প্রভৃতি কতকগুলা সাধারণ কথা পরিত্যাগ করিয়া, ঐক্য ও উন্নতি সাধনের যে শত সহস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাধা আমাদের সহিত এক পরিবারভুক্ত হইয়া বাস করিতেছে সেই-সকল বিশেষ বিশেষ বিষয়ের আলোচনা করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। বড়ো বড়ো কথা শুনিয়া আমাদের যুবকদিগের একটা বিষম রোগ উপস্থিত হইয়াছে। তাঁহারা তাঁহাদের দুই দুর্বল হস্তে দুই গুরুভার তরবারি লইয়া অধীনতা ছেদন করিবার জন্য দিগ্বিদিক্ হাতড়াইয়া দাপাদাপি করিয়া বেড়াইতেছেন। তাঁহাদের যদি বলা যায়, অত হাঙ্গাম করিবার আবশ্যক কী? অধীনতার অন্বেষণে ছুঁচাবাজির মতো চারি দিকে ধড়্ফড়্ করিয়া বেড়াইতেছেন কেন? অধীনতা যে তোমাদের দুয়ারের কাছে। এমন-কি, তোমাদের গৃহের কোণ হইতে শত শত অধীনতার পাশ অতি সূক্ষ্ম মাকড়সার জালের মতো তোমাদের হাত-পা বেষ্টন করিয়া ধরিয়াছে। তলোয়ার দুটা রাখো। একে একে ধীরে ধীরে সেই সূক্ষ্ম গ্রন্থিগুলা মোচন করো। এ কথা শুনিলে তাঁহারা নিতান্ত নিরুৎসাহ হইয়া পড়েন। তাঁহারা জাহাজের কাছি, লোহার শিকল ছিঁড়িবার জন্য তলোয়ার ঝন্ঝন্ করিয়া বেড়াইতেছেন, তাঁহাদের ওই সরু সুতাগুলি দেখাইয়া দিলে তাঁহারা অপমান বোধ করেন। কেবল বড়ো বড়ো ভারী ভারী কথা শুনিয়া আমাদের এই দশা হইয়াছে। এখন ছোট ছোট ঘরের কথা কহিবার সময় আসিয়াছে। এখন এই মহাবীরবৃন্দকে ঠাণ্ডা করিয়া তাঁহাদের মুখের কথাগুলাকে ছাঁটিয়া, তাঁহাদের হাতের তলোয়ার দুটাকে নামাইয়া ছোটখাটো ঘরের কাজে নিযুক্ত করানো আবশ্যক হইয়াছে। বনে মহিষ তাড়াইতে যাইবার পূর্বে ঘরে ইন্দুরের উৎপাত দূর করা হউক। তাই বলিতেছি হৃদয়োচ্ছ্বাসের অনেকগুলি প্রবন্ধে লেখকের দেশানুরাগ প্রকাশিত হইয়াছে, কিন্তু বর্তমান পাঠকদের পক্ষে তাহার আবশ্যকতা অল্প। তাই বলিয়া হৃদয়োচ্ছ্বাসের সকল প্রবন্ধ সম্বন্ধেই আমরা এমন কথা বলিতে পারি না। ইহাতে অনেকগুলি প্রবন্ধ আছে যাহা সময়োপযোগী, বিশেষ-বিষয়গত ও সমাজের হিতসাধক।